চুপ

চুপ
খালেদা বেগম জ্যোৎস্না :

বেশিই কথা বলিস,  চুপ কর তো- এই বলে বড় বোন ছোট বোনটাকে থামিয়ে দিল, সে হয়ত কোন কথা বলতে চাইছিল। যা তাকে বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। কোন বিষয়ই না, আমাদের জন্য। কারণে অকারণে চুপ করিয়ে দেওয়াটাতে আমরা কিছু মনে করি না। বরং মনে করি এটা আমাদের দায?িত্ব। কিন্তু এই চুপ করিয়ে দেওয়াটার ফল যে কত বহুমুখী ও দীর্ঘ ফলপ্রসু তা আমাদের অনুমানের বাইরে। এ চুপ অর্থ তার টুটি চেপে দিলাম, সেই ছোটবেলা থেকে।
আমাদের ধারণা চুপচাপ থাকা ভাল। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার! শান্তি চাই, আমরা শান্তির ধারক বাহক, এই ধারনা যদি বাস্তবে হতো তা হলে তো পায়রা না হয়ে, হয়তো বা শান্তির প্রতীক হিসেবে আমাদের উড়ানো হতো।
চুপ নিয়ে নিজের কথা দিয়েই শুরু করি— ছোট থেকে শুনে আসছি  ভালো সাজতে হলে বেশি কথা বলা ঠিক না, তোমার সম্পর্কে কেউ কিছু বল্লেও চুপ করে থাকবে, প্রতিবাদ তো সুদুরের কথা ন্যায্য কথাটাও বলতে নিষেধ। কোন বিষয়ে ,কোন স্কুলে, কোন কলেজে, কি জামা, কোথায় যাবে, কার সাথে বন্ধুত্ব করবে , সব কিছুতেই চুপ থাকতে বাধ্য, নতুবা বেহায়া, বেয়াদপ। চুপ থাকতে থাকতে যার সাথে সারা জীবন, যে সুখ দুখের সাথী, যে বন্ধু, সারথী সে কেমন হবে, নিজে কেমন চাই, তা বলতে পারি না, কি অদ্ভুদ! চুপ থাকা থেকেই শুরু। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ, বলেন তো কথাটা সব ক্ষেত্রে ঠিক না। মনে না নিলেও মেনে নিতে হয়। তবে দিন পাল্টেছে, এখন চুপ থাকে না এসব বিষয়ে, ভালো লক্ষণ। 

পারিবারিক  কথায় যদি আসি, মজার মজার চুপ যাওয়ার নাটকীয়তা আছে। বয়স্ক থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত সংসারে অশান্তি হবে এ ভয়ে চুপ। এ ফিরিস্তি শেষ হওয়ার নয়, বুঝার বয়স থেকে শুরু করে বয়স্ক সবার কিছু না কিছু মনের কথা থাকে, কিন্তু কয়জনে মুখ ফুটে বলি, ওই যে ছোট বেলায় চুপ থাকতে শিখেছেন তাই চুপ যাই, কি বলেন। এ যেন শ্বাস নেওয়াকে যদি বেঁচে থাকা বলে এই ধরনের। যদি মুখ খুলে, তাকে নাদান বলে আখ্যায়িত করবে। বিত্ত বিশেষে ক্লসিফাইট আছে। তবে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের আওতার বাইরে। 
একটা দ্বন্দ্ব আছে। নীরব থাকা আর চুপ থাকা এক কি না! ‘চুপ’ অনেকটা শাসন, আদেশ আর ‘নীরব‘ জেনে বুঝে এড়িয়ে যাওয়া খুব কাছকাছি দুটি শব্দ, কিন্তু ক্ষেত্রে বিশেষে ফারাক অনেক। 
এই যে চুপ করিয়ে দিলাম, তার ফলে সে পরবতীর্তে মুখ খুলে কথা বলার সৎ সাহস হারিয়ে ফেলি। এই ‘চুপ‘ সত্য কে হারিয়ে দেয়, প্রতিবাদ করার সাহসকে নত করে, ন্যায্যতা থেকে বিরত থাকে, বঞ্চিত করে, চির উন্নত মম শির এর জায়গায়, চির নত  শির শিক্ষা দেয়। কেউ বিপদে পড়লে অনেক ক্ষেত্রে আমরা চুপ থাকি সেফ জোনে থাকার জন্য । 
তবে তাই বলে শাসন করবো না, অবশ্যই করবো, কিন্তু যে শাসন সত্য, ন্যয্যতা, অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য এ সব থেকে নিজেকে দূরে রেখে চুপ থাকার জন্য না।
নীরবতা নিয়ে অনেক জ্ঞাণগর্ব বাণী আছে, এই যেমন মূর্খের সাথে তর্ক করার চেয়ে নীরবতা উত্তম, জ্ঞাণীদের ভীড়ে নীরব থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। আবার কিছু মুখোশধারী ব্যক্তিত্ব ধরে রাখার জন্য নীরব থাকেন, আরে ভাই ব্যক্তিত্ব নিয়ে টানাটনির কি আছে! আপনার জ্ঞান, ব্যবহার, আচরণ, সৌজন্যবোধ ইত্যাদি নিয়েই তো আপনার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।
আমরা বেশীরভাগ লোক মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, অর্থাৎ চুপ থাকতে পছন্দ করি। যেমন জীবন বাচাঁনোর ঔষুধে ভেজাল! তো থাকুন চুপ, প্যাথোলোজি টেস্টের রিপোট ভুল, কি হবে ! কার বিরুদ্ধে লড়বেন, বিচারের রায় কার পক্ষে যাবে, তো চুপ। 
আমার এক সহকর্মী বলতো আপা, দু'মুঠো ভাতের জন্য এতো কষ্ঠ করি আপা। আর এই খাবারে ভেজাল!!! কত লিখা, কত র্যা লী, কত মিটিং, ভোক্তা অধিকার, কই কোথাও কিছু কমেছে, ফরমালিন আর রং এর কারবার চলছেই। হ্যাঁ তাই বলে সোচ্চার হবে না, অবশ্যই হবে, কিন্তু দৃশ্যমান কিছু হতে হয়ত সময় লাগবে, নিজেকে বাচিঁয়ে লিখলাম। আরে ভাই থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর! চলছে তো চলুক। এই দু’টো ভাতের যা পাওয়া দরকার তা কি পাচ্ছি! ওই যে  চুপ যাও জেনেছি, তা ছালাদিয়া থেকে শুরু করে বীরজেস রেস্টুরেস্ট কত জায়গায় যায়, সব জায়গায় সুজনের মতো মেনে চলি, না হয় ইমেজ নষ্ট হবে! 
কর্ম পরিবেশে যদি আসি, এর চেয়ে জাদুকরি জায়গা আর কোথায় পাবেন না! সহকর্মীদের বাঁকা চাহনি, টিটকিরি মার্কা কথা, অধস্তনদের অবজ্ঞা, তখন পলিসি সমূহ কোথায় থাকে! আর অতি মানব বসদের কথা না  বলা উচিৎ, উনারা নমস্য। তবে কিছু আছে যোগ্যতার মাপকাঠিতে না তেলের মাপকাটিতে জায়গা পেয়েছে  তাদের দাপট, চ্যাটাং চ্যাটাং কচকচানি চোখে পড়ে। কি করবেন, চাকুরিইতো করেন হয় মেনে চলুন না হয় খবর হবে। মজার জিনিস নুতন কেউ প্রমোশন পেয়েছে, কেউ  জয়েন করেছে জ্ঞান দিতেই থাকবে, তখন মনে হয় আমার মতো গাধার বাচ্চা পৃথিবীতে দ্বীতিয়টা নেই। সৃস্টিকর্তা কি ভাবে এত গুণ, জ্ঞান দিয়ে উনাদের আদমের দুনিয়াতে পাঠালেন , এই যেমন ধরেন সক্রেটিস, আইস্টাইন, গান্ধী, লুথার, কীটস, বায়রন, শেকশপীয়ার, গালিব, মেশি, বচ্চন, দালাই লামা, গুলজার, রবি ঠাকুর, নজরুল, হুমায়ূন আহমেদ, নির্মেলেন্দু সব নখদর্পনে, এ সব গুনীজনের সামনে মাথা হেট করে চুপচাপ শোনা ছাড়া কি আছে? আর একটা জোট আছে যাদের কথা না বলে পারছি না: মালিকপক্ষ, দাতা গোষ্ঠী, ভাড়াকরা পরামর্শক। অনেক সময় মনে হয় যারা ছড়ি চালায়, আসলে তারা কি চান নিজেরাও আদৌ জানে কি না সন্দেহ, কিন্তু মাতবরী করেই যান।
আত্মীয়দের কথা বলতে চাই না, তবে আপনার যদি কিছু সম্পদ থাকে ইংজাংশন, প্রিয়ামশন, গোলাভাগের মামলা, জবর দখলের মামলা হরেক রকম উপায় দেখাবে, কাজের বেলায় সে কিন্তু ফোনও রিসিভ করবে না। সুতরাং চুপ করে শুনে যাওয়া ছাড়া কি আছে! টাকা ধার দিছেন, চাইতে গেলে মনে হয় নিজে উনার কাছে ভিক্ষুক, ফোনও রিসিভ করবে না। অগত্যা চুপ থাকা ছাডা উপায় নেই।
বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, নিজের সন্তানদের দিকে তাকান, মাছ, মাংসের টুকরা সমান না হলে, তুলকালাম, ঈদের সময় কারটা দাম বেশি। এতো গেলো বিয়ের আগের কথা, বিয়ের পরে সে তো ভিন্ন জগতের। কত রকমের খূঁত ধরা যায়, অন্য ভাই বোনের সাথে প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে। তো তর্ক করবেন? কার সাথে আত্মজার সাথে, সীতার মতোতো মাটির নীচে যেতে পারবো না, অগত্যা চুপ। কোথায় জানি পড়েছিলাম, এমনভাবে বলো যা অন্যরা বিশ্বাস আর মুগ্ধতার সাথে শুনবে, আর এমন ভাবে শুনো, যাতে অন্যরা তোমাকে শোনাতে আগ্রহী হয়, চলুন না একটু চেষ্টা করি, অসুবিধা কোথায়!
চুপ থাকা কিন্তু সব সময় কাম্য নয়, মুখ খুলুন, ন্যায় কথা বলুন, অন্যায়, শোষনের মোকাবিলা করুন, তবে উগ্রতা পরিহার করে।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.