জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস : কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস : কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার পরিচালনা সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম আমাকে ফোন করে স্মরণ করিয়ে দেন যে ২৮এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। যা ব্যাপক কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করা হবে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে রোববার সকাল ৮ টায় কক্সবাজার জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান মুনসী আব্দুল মজিদ কতৃর্ক বর্ণাঢ্য র্যা লী উদ্বোধন এবং উদ্বোধনের পর র্যািলীটি কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করবে। একই দিন সকাল ৯টায় জেলা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় আইগত সহায়তা দিবসের তাৎপর্য বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি পালন উপলক্ষে দিনব্যাপী অভিজ্ঞ আইনজীবীদের মাধ্যমে জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে আগ্রহী সেবাপ্রার্থীদের বিনামূল্যে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনী সেবা প্রদান,ডকুমেন্টারি প্রদর্শন,রক্তদান কর্মসূচী,বিনামূল্যে ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা,ওজন পরিমাপ,ফ্রি মেডিকেল চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বহুল প্রচারিত দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ মুনসি আব্দুল মজিদ এর বাণী এবং লিগ্যাল এইড বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমার নিয়মিত অতিথি কলামের জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস সম্পর্কে একটি লেখা প্রস্তুত করার অনুরোধ করেন।

২০০০ সাল থেকেই আইনগত সহায়তা প্রদান আইন পাশ করা হয়েছে,জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গঠন করা হয়েছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন,দায়িত্ব,কার্যাবলী ইত্যাদি) প্রবিধানমালা,২০১১,আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা,২০১৪, আইনী পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি বিধিমালা,২০১৫, আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা,২০১৫, চৌকি আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন,দায়িত্ব,কার্যাবলী ইত্যাদি  প্রবিধানমালা,২০১৬ এবং শ্রম আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন,দায়িত্ব,কার্যাবলী ইত্যাদি প্রবিধানমালা, ২০১৬ নামের আইনগুলি প্রণীত হয়েছে আর্থিকভাবে অসচ্ছল,সহায়—সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ—সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা প্রদান করার উদ্দেশ্যে। দেশের সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা, আইনজীবী, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাংবাদিকরাও উল্লেখিত আইনগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত নন। দেশের সাধারণ মানুষ তাদের স্বার্থে প্রণীত আইনগুলি জানেন না। দেশের অসচ্ছল ও অক্ষম জনগণকে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের এত আয়োজন সম্পর্কে জনগণকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মসজিদ,মন্দির,ক্যায়াং ও অন্যান্য ধর্মশালার মাধ্যমেও প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে বিষয়গুলো অতি সহজে প্রচারের ব্যবস্থা করা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে জনস্বার্থে প্রণীত আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না,অনেক আইন ছাপানো অক্ষরে বইতেই বন্দী থাকে। বিভিন্ন দিবসগুলো একদিন গুরুত্ব সহকারে পালন করা হলেও তা প্রচার প্রচারণায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এতে করে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা,নিষ্ঠা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। একটু সজাগ,সতর্ক ও আন্তরিক হলে বছরের প্রত্যেক দিনই ন্যায় বিচার প্রত্যাশী জনগণকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার সুযোগ আছে। প্রাথমিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান,থানার পুলিশ,আইনজীবী ও বিচারকরা আইনগত সহায়তা দিতে পারেন সারা বছর ধরে। একজন ইউনিয়র পরিষদ চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতেরও চেয়ারম্যান। তার গ্রাম আদালত আইনের তপশিলে উল্লেখিত অনেক ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিরোধ বা মামলা চেয়ারম্যান সাহেব রাজনৈতিক বিশ্বাসের উর্ধ্বে উঠে নিস্পত্তি করতে পারেন। আদালতে আসতে না দিয়ে গ্রামেই বিরোধ নিস্পত্তি করতে পারা একজন নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানের জন্য দেওয়া আইনগত সহায়তা। হত্যা,ধর্ষণ,ডাকাতি ইত্যাদির মত গুরুতর অপরাধ হলে মামলা করার সময় নির্দোষ মানুষকে জড়িত করতে না দেওয়াও সেই নির্দোষ মানুষগুলোকে আইনগত সহায়তা প্রদান। আমার ব্যক্তিগত গবেষনায় পেয়েছি যে মামলাগুলো আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণে সত্য প্রমাণিত হয়ে আসামীদের শাস্তি হয় ও নির্দোষ প্রমাণিত আসামীদের খালাস দেওয়া হয় তাদের মধ্যে প্রায় ১৮% আসামী দন্ডিত হয়,৮২% আসামী নির্দোষ খালাস পান। একটি সত্য ঘটনার হত্যা মামলায় ৫জন আসামী হত্যার ঘটনা করেছে,আসামী দেওয়া হলো ৩০ জন। বিশ বছর ত্রিশ বছর পর বিচারের পর দেখা গেল ৫জন আসামীর শাস্তি হয়েছে,২৫জন আসামী খালাস পেয়েছে। সেই নির্দোষ ২৫জনকে আসামী না করার জন্য সংবাদদাতা/বাদীকে সৎ পরামর্শ দিয়ে প্রভাবিত করতে পারেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান,সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও থানার পুলিশ। 
মনে করেন থানায় ৫জন আসামীর বিরুদ্ধে একটি চাঁদা দাবী ও ভাংচুরের এজাহার রুজু করা হয়েছে। একজন আসামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা গেল যে এজাহারনামীয় ১জন আসামী ঢাকায় ডেন্টাল কলেজের অধ্যাপক হিসেবে ঢাকায় বসবাস করেন। ১জন ওমরা হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে সৌদী আরব অবস্থান করছেন। একজন অনেক দিন পূর্ব থেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। কথিত ঘটনার সময় বিদেশে অবস্থান করলেও তাদের মিথ্যাভাবে এজাহারে আসামী করা হয়েছে এবং ও/সি তা রেকর্ড করেছেন। সেই মর্মে একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় পুলিশের যোগ্যতা ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং পুলিশের ভাবমূর্তি জনসমক্ষে ক্ষুন্ন হয়েছে। তখন সংবাদদাতা—বাদীকে মিথ্যা এজাহার দায়ের করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে আইনী কার্যক্রম শুরু করা হলে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীরা নিরুৎসাহিত হইত এবং  নিরীহ নির্দোষ মানুষের প্রতি অনানুষ্ঠানিকভাবে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হতো। পুলিশের ভাবমূর্তি কিছুটা পুনরুদ্ধার হতো। অনুষ্ঠান না করেও প্রতি দিন আইনগত সহায়তা প্রদান করা যায়।
মামলার আসামী করা হলেই তাদের দোষী মনে করা আইনের প্রতিষ্ঠিত বিধানের পরিপন্থী। সকল আসামীকে আদালতে বিচারের সময় নির্দোষ হিসাবেই গণ্য করেই বিচার শুরু ও শেষ করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক লিখিত সাক্ষীদের কার্যবিধির ১৬১ ধারার জবানবন্দিকে শতভাগ সত্য মনে করে সাক্ষীদের সেই অনুযায়ী আদালতে সাক্ষ্য দিতে হুমকী ধমকি দিয়ে বাধ্য করা ও আসামীকে শাস্তি দেওয়া ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। পাবলিক প্রসিকিউটারের আইনানুগ দায়িত্ব হল প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের মাধ্যমে নিরপেক্ষভাবে আদালতকে ন্যায় বিচার করতে সহায়তা করা। ছলে বলে কৌশলে আসামীকে শাস্তি করানো পাবলিক প্রসিকিউটারের আইনী দায়িত্ব নয়। তিনি অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকবেন। বাদী ও আসামী উভয়ই ন্যায় পাওয়ার হকদার। বাদীপক্ষে অতি উৎসাহী না হয়ে বা আসামীপক্ষের বশে না গিয়ে নিরপেক্ষ ও আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালন করাই সংশ্লিষ্ট জনগণকে আইনগত সহায়তা দান করা যায়। ফৌজদারী মামলায় অজামিনযোগ্য ধারার অপরাধের আসামী হলেই তাদের সবাইকে দোষী মনে না করে এজাহার,নালিশী দরখাস্ত ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে যার বিচারের পর যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাকে জামিন না দিয়ে মূল আসামীর সহযোগীর অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীদের জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশনা ফৌজদারী কার্যবিধিতে ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তসমূহে আছে। একটু সদয় হলে একজন বিচারক প্রতিদিন ন্যায় বিচার প্রত্যাশী জনগণকে প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকেই আইনগত সহায়তা দিতে পারেন। বিগত ১৫/০১/১৯৮৫ সালে কক্সবাজার জেল ও দায়রা জজ আদালত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিগত দুই বছর আগে পর্যন্ত আসামীদের জামিননামা সম্পাদনের মাধ্যমেই জামিন দেওয়া হত। হঠাৎ করে দুই বছর আগে থেকে কক্সবাজার জেলায় জামিননামার অতিরিক্ত ব্যাংকে নগদ টাকা জামানত হিসেবে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া শুরু করা হয়। এই পর্যন্ত কক্সবাজারবাসী আসামীদের প্রায় ৪০ কোটি টাকা জামানত হিসেবে সোনালী ব্যাংকে জমা হয়েছে বলে জানা যায়। সেই জামানতের টাকা জরিমানার টাকার মত সরকারী টাকা নয়। সরকার ইচ্ছা করলেও জামানতের টাকা খরচ করতে পারবে না। মহামান্য সুপ্রীমকোর্টে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামিনের সাথে শর্ত আরোপ করা সম্পূর্ণ বেআইনী। ৪৫ ডিএলআর(এডি) ৮ পৃষ্টায় প্রকাশিত মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, বিচারপতি শাহাবউদ্দিন আহমেদ, বিচারপতি এমএইচ রহমান ও বিচারপতি এটিএম আফজলকর্তৃক (তাঁরা সকলে সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন) প্রদত্ত রায়ে ঘোষণা করেছেন যে, শর্তযুক্ত জামিন মঞ্জুর করা অবৈধ। ৯ বিএলডি(এডি) ৩ পৃষ্টায় প্রকাশিত মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীও জামিনের সাথে শর্ত আরোপ করা অবৈধ।  নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগাতার উর্ধ্বগতির মূখে কক্সাবাজার জেলার মত ’মরার উপর খাড়ার ঘা’ এর মত নিষ্ঠুর এই নিয়ম  বাংলাদেশের আর কোন জেলায় চালু নাই। কক্সবাজারে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে মুনসি আব্দুল মজিদ যোগদান করার পর থেকে তিনি অনেক মামলায় জামিন দিয়েছেন,কিন্তু জামিননামার অতিরিক্ত নগদ টাকা জামানত হিসেবে ব্যাংকে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন নাই বা শর্ত আরোপ করেন নাই। আলহামদুলিল্লাহ। কক্সবাজার জেলাবাসীর জন্য আইনগত সহায়তা দিবস—২০২৪ এর সব চেয়ে বড় আইনগত সহায়তা দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা আইনগত সহায়তা কমিটির চেয়ারম্যান মাননীয় জেলা ও দায়রা জজ মুনসি আব্দুল মজিদ। আমরা কক্সবাজারবাসী তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি এবং আশা করি কক্সবাজার জেলায় কর্মরত সকল বিচারক উনাকে অনুসরণ করবেন, তা হবে কক্সবাজারবাসীর জন্য বড় আইনগত সহায়তা।

লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.