সকল প্রকার অধিকার, লিগ্যাল এইডে প্রতিকার

সকল প্রকার অধিকার, লিগ্যাল এইডে প্রতিকার
আব্দুল মান্নান :

কেউ অপরাধ করলেও আইনি পন্থা অবলম্বন ব্যতীত তাকে শাস্তি প্রদানের সুযোগ নেই। আবার কোনো ব্যক্তি আইনের বিষয়ে অজ্ঞ হওয়ার কারণে কোনো অপরাধ সংগঠন করলেও শাস্তি হতে রেহাই নেই। উপরোক্ত দুইটি ক্ষেত্রেই আইনের প্রাধান্য দেখা যায়। সুতরাং আইন জানা ও আইনের আশ্রয় লাভ করা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আইনের অজ্ঞতা আইনের আশ্রয় লাভের পক্ষে বাধাস্বরূপ। আইনের আশ্রয় লাভ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। এই অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে যে সকল কারণে তা দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই দায়িত্বের অংশ হিসেবে সরকার আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ প্রণয়ন করে আর্থ—সামাজিক কারণে আইনের আশ্রয় লাভ করতে অসমর্থ ব্যক্তিদের আইনগত সহায়তা প্রদানের বিধান করেন। তবে আইন প্রণয়নের পরও আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। 
এই আইনে শুরুতে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের নিয়োগ, দায়িত্ব ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার আইনগত সহায়তা প্রার্থী কে আইনগত পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। এছাড়াও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ায় আদালতের বাইরে স্বল্প সময়ে মামলা—মোকদ্দমার পক্ষদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি করেন। দুঃস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদেরকে লিগ্যাল এইড প্যানেল আইনজীবীর সহায়তায় বিনা খরচে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগের দরখাস্ত বিবেচনার জন্য জেলা কমিটির বরাবরে প্রেরণ করেন। 
লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগের পর আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রথাগত আদালতে আইনের নানান সূত্রে—সমীকরণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিকার পেতে অধিকারী নয় মর্মে সাব্যস্ত হলেও লিগ্যাল এইড অফিসার আইনের সেইসব জটিল সমীকরণ এক পাশে রেখে পক্ষগণের সম্মতির ভিত্তিতে ন্যায়পরায়ণতার নীতি কে ভিত্তি করে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন। ফলতঃ একদিকে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হচ্ছে, অপর দিকে আদালতে দীর্ঘদিন মামলা পরিচালনা করে হেরে গিয়ে আম—ছালা দুটোই হারাতে হচ্ছে না বিচারপ্রার্থীদের।

নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সারা দেশের ন্যায় কক্সবাজার জেলার লিগ্যাল এইড অফিস সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান কার্যক্রম কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে এই অফিসে ১০৭২ টি আবেদন দায়ের করা হয় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর)'র জন্য যেখানে এই বছরে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ১০৮৪ টি আবেদন। আপসে প্রায় ১ কোটি টাকা আদায় করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২৭৪ জন ব্যক্তি কে বিনা খরচে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রম সম্পর্কে গণসচেতনতা এখনও অনেক কম। এই অফিস এখনও গণমানুষের নিকট স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায় নি। অনেকে এখনও এটিকে আদালতের অংশ মনে করেন এবং এখানে মীমাংসা সভায় অংশগ্রহণ করা কে মানহানিকর বা 'মামলার বেড়াজালে' আটকে গেছেন মর্মে বিশ্বাস করেন। এটি দূর করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ও এর অধীনস্হ কমিটিগুলো গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বছরব্যাপী নানান কর্মসূচি গ্রহণ করে। ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হয়। কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি জনাব মুনসী আব্দুল মজিদ—এর নেতৃত্বে এবারও এই দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। এই দিন জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী ফ্রি আইনগত পরামর্শ প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে, যেখানে যে কেউ সেবাগ্রহণ করতে পারবে। এছাড়াও, র্যা লী, আলোচনা সভা, রক্তদান কর্মসূচি ও ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই সকল কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে আইনগত সহায়তা ও আপসে মামলা বা বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও তাদেরকে এই প্রক্রিয়ায় এসে সেবা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা।
অধিকাংশ ফৌজদারি মোকদ্দমার প্রেক্ষাপটে স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের ঘটনা থাকে। একটা দেওয়ানী বিরোধ হতে একাধিক ফৌজদারি মামলা সৃষ্টি হওয়া নতুন কিছু নয়। তাই, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) প্রক্রিয়ায় সমাধান করলে মামলার জট কমবে। তবে, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য লিগ্যাল এইড অফিসারের সরেজমিন পরিদর্শন করা আবশ্যক হলেও নানান লজিস্টিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা করা সম্ভব হয় না। সীমাবদ্ধতা দূর করার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে এর কার্যকর সুফল পাওয়া যাবে।
লেখক : জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ), কক্সবাজার।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.