কাক

কাক
খালেদা বেগম জ্যোৎস্না :

আম্মু দেখ দেখ আমার পরোটা টা কাকে নিয়ে গেছে বলে বড় মেয়ে মিহি চিৎকার দিতে দিতে ঘরের ভিতরে আসলো, সে ভাই, বোন সহ আমাকে টেনে নিয়ে গেল দেখাতে। আমরা দেখলাম কাকটা ইলেকট্রিক তারের উপর বসে পরোটাটা পা দিয়ে ধরে রাখছে, খাবার জন্য। এটা তো নুতুন কিছু না হর হামেশা আমরা এ রকম ঘটতে দেখি। এ টা জানা কথা এক মাত্র মানুষ ছাড়া ক্ষিদে (তবে মানুষের ক্ষিদের সীমা কতটুকু জানা নেই) না পেলে অন্য কোন প্রাণী কাউকে আঘাত বা খাবার নিয়ে টানাটানি করে না ।
কাককে পাখিজগতের সর্বাপেক্ষা চালাক পাখি বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয, প্রাণীজগতের অন্যতম চালাক প্রাণী হিসেবে এদের গণ্য করা হয়। আমরা সবাই জানি কাক আর কলসির গল্পটা। তাতেই বুঝা যায় কাকের চালাকি। মানুষ সব সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শুধু তাই না সৃষ্টিকর্তা সমস্ত গুনাগুন দিয়ে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকর্তা মহাবিশ্বে অগনিত প্রাণী সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু মানুষকে সমস্ত প্রাণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আশরাফুল মাখলুকাত উপাধি দেওয়া হয়েছে  এর মধ্যে মানুষকে বা কাকের কথা নিয়ে লিখার বা বলার কি আছে! মাঝে মধ্যে মনে হয়  কাকের সাথে আমাদের অনেক মিল ।
কাকের সাথে মানুষের মিল , যেমন: কাক পরিকল্পনা করে কাজ করে, যা প্রতিটি মানুষ যে যার অবস্তান থেকে তার মতো করে। মানুষের মত পরিকল্পনা করে কাজ করার কারণে কাকের অনেক সুনাম আছে বলে জানা যায়। কাক কখন কি খাবার খাবে, কোথায় খাবার পাবে, সে তার সঙ্গীকে খাবার থেকে কতটুকু দিবে এগুলো সে আগেই পরিকল্পনা করে রাখে। খুব সুযোগসন্ধানী ও চতুরতার কারণে কাকের ‘চোর’ হিসেবেও বদনাম আছে। মাঝে মাঝে কাক গর্ত করে তার খাবার লুকিয়ে রাখে। এ বিষয়টি শিক্ষানীয় যা আমরা সবাই জানি, কাজটি করতে সে আরেকদিকে চোখ রাখে, অন্য কাক এই লুকানোর ব্যাপারটি দেখে ফেলল কি না সেটা সে নিশ্চিত হতে চায়! একটু নিজস্ব গন্ডি থেকে বের হয়ে ভাবুন তো আমাদের মধ্যে এমনটা দেখা যায় কিনা!

কখনও লক্ষ্য করেছেন কাকেরা মিটিং করে, দেখা যায় একজন কাকের ভাষায় বলছে, বাকিরা বসে থাকে, আবার এক কাক পর আরেক কাক যায়। নেতার মতো এক কাক থাকে। আমার আব্বা ছোট বেলায় কাকের মিটিং দেখিয়ে ছিলেন, একটু সময় থাকলে নিজেও দেখতে পারেন।  এখন আমাদের সভা, সমাবেশ, মিটিং এ লক্ষ্য করি। তবে আমাদের মাঝে ধৈর্য্য আর শৃংখলার অভাব।
কাক সমাবেশ প্রিয়, আমরা কি নয়? পাতি মিটিং, মাঝারি. মহা সমাবেশ ইত্যািদ এ রকম হাজারো বল্লে ভুল হবে, কত কত সমাবেশ। তীর্থের কাকের মতো আমরা শ্রোতারা বসে থাকি! 
কাক এতই চতুর প্রাণী যে, এদের সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে আপনাকে হয়তো বছরের পর বছর পর্যবেক্ষণ করা লাগতে পারে। যেমন একজন মানুষকে বুঝতে সারা জীবনেও পারা যায় কি না সন্দেহ, সে সন্তান, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, বা পারিবারিক, কর্ম, সামাজিক যে কোন পরিবেশই হোক না কেন? আমার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে যদি কোন দূর্বোধ্য প্রানী থেকে থাকে তা মানুষ!!! কেউ যদি দাবী করেন , মানুষকে বুঝতে পেরেছেন, তাঁকে  অভিবাদন জানাই। 
কাকের পছন্দের কাজ হচ্ছে  গোসল করা, যা সব মানুষের মাঝে আছে। তবে কাক বিলাসি না, আমাদের যাদের প্রাচুর্য্যক আছে, কত ধরনের বডিওয়াস, বডিফোম, লোসন, সুগন্ধীযুক্ত মোমবাতি, বাথটব, গিজার, আলোআধঁরি বাথরুম, আর না বলাই ঠিক। কাকের পছন্দ, বিলাশিতা আমাদের!
কাক ভোজনরসিকও বটে, খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, পোকামাকড়, ফলমূল, ফসলের বীজ, পাখির ডিম, ছোট সরীসৃপ, সাপ, ব্যাঙসহ প্রায় সব খাবারই খায়। আমরাও ভোজনরসিক, যদিও স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে রসিকজন বেরসিক হয়ে পড়েছেন, তবে আগেকার দিনে ধুতির কোঁচা খুলে দিত বলে শুনেছি, আমার জেঠা বলতেন আমি কি এখন মানুষ আছি, মাত্র আধাসের চালের ভাত খেতে পারি না। ভাবুন আমরা কতটুকু খায়। খাবারের ভেজালের জন্য কি খাবো আর খাবো না এ ভেবে অনেক কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকি। কাকের সে বালাই নাই। তবে আমরা যে খাবার খাচ্ছি তা কি সঠিক উপার্জনের ? কাক উচ্ছিষ্ট খায় , আর আমরা খাবারের জন্য কি না করি, যেমন  ঘুষ, সুদ, ঠকিয়ে, ভেজাল মিশিয়ে, ক্ষেত্র বিশেষে মারামারি করি। যা কাকের খাওয়ার চেয়ে জঘন্য। ফরমালিন খেতে খেতে মনে হয় আমাদের মৃতদেহ বরফ বা ফ্রিজার ভ্যানে রাখতে হবে না  এমনিতেই রাখা যাবে! 
কথায় বলে কাকের বাসায় কোকিলের ছানা, যৌক্তিক ভাব কাক বাসা তৈরী করে। যা মূলত রাস্তায় পড়ে থাকা বা পরিত্যক্ত  সব কিছু দিয়েই কাকের মতো করে বাসা তৈরি করে। আমরাও বাসা তৈরী করি, ঝুপড়ি, কুঁড়ে ঘর, সেমি পাকা, ফ্ল্যাট, এপার্টম্যান্ট, দালান, প্রাসাদ কত বাহারের। ভিতরে তো দুরের কথা বাইরে দেখেই পড়ে না চোখের পলক!
আর এ বাড়ী করতে গিয়ে সম্রাট শাহজাহানকেও হার মানায়। ইট, সিমেন্ট, বালির কথা বাদই দিলাম, সজ্জার জন্য, দেশীয় বাদ দিয়ে ইতালিয়ান, ইন্ডিয়ান, তার্কিস কোথাকার পাথর, ঝাড়বাতি আরো কত কি! এর জন্য কত খাটুনি, ঝগড়া এ বলে শেষ করা যাবে না। 
কাকের কিন্তু এসবের দরকার নেই, তাই ঝগড়া বাগড়া দেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। কারা এগিয়ে আমরা না কাক! তবে অনেকেই বলবেন, এটা বাড়াবাড়ি! ভাই বোনেরা, ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র চিন্তা।
সারা পৃথিবীতে বিভিন্নরকম কাকের প্রজাতি বসবাস করে। যেমন- মারিয়ানা কাক, ফিশ কাক, ক্যারিয়ান কাক, পাইড কাক, দাঁড় কাক, পাতি কাকসহ আরও অনেক। আমার দেখা মতো আফ্রিকান কাকের  বুকের অংশটা সাদা পালকের !
মানুষের মধ্যেও কি নেই! এই যেমন ধরেন, উচ্চ বিত্ত,উচ্চ মধ্য বিত্ত, মধ্য বিত্ত, নিম্ন বিত্ত, হরিজন, চৌধুরী, খান, বেগম, নবাব। আবার কর্ম পরিবেশে সরকারি, সুশীল, লেখক, কবি, করপোরেট, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, এনজিও, অবসরপ্রাপ্ত যদিও সবাই শ্রমিক তবে গলার বেল্ট ভিন্ন। আমাদের দেহে প্রবাহিত রক্ত যদিও লাল কিন্তু গ্রুপের নাম এ,বি, এবি, ও, পজিটিভ, নেগেটিভ, যা কাকের মধ্যে আছে কি না জানি না ! এক্ষেত্রে কাক এগিয়ে! আমরা ভিন্নতা সৃষ্টি করি বিত্ত, পেশা, আয় দেখে, তবে জ্ঞানের  চেয়ে এর চতুরতার মূল্য দিতে দেখা যায়। যেমন কাকের চতুরতা খ্যাত, তবে  এখন সময় এসেছে মানুষের কাছ থেকে শেখার।
কাক নিয়ে কয়েকটি বাগধারা বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে যা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যেমন, বিপর্যস্ত অবস্থাকে বোঝাতে ঝড়ো কাক, পরিষ্কার স্বচ্ছ জল বোঝাতে কাকচক্ষু জল, অত্যধিক চেষ্টা অর্থে কাকচেষ্টা এবং খুব প্রাতঃকাল বুঝাতে কাকভোর বাগধারাগুলো  ব্যবহার করে থাকি। তবে শুধু কাক না অন্য প্রাণীর যেমন, বাঘ, হাতি, হরিণ, কোকিল, গাধা, ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল এরকম অনেক।
কাকের একটা ছানা যদি কোথাও পড়ে, ঐ ছানার জন্য এলাকার সব কাক জড়ো হয়ে সমানতালে কা কা করতে থাকে, আর চেষ্টা করে ছানাটাকে বাসায় তোলার জন্য, আমরাও তাই করি। তবে নবজাতক চুরি করি, বিভিন্ন অনৈতিক কাজে নিয়োজিত করি চারপাশে তাকান দেখবেন আমরা কি করি।
দিনের বেলায় কাক খাবারের সন্ধানে দলবেঁধে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যায়। আমরা যেমন যে যার কাজে যায়, তাও তো এক ধরনের খাবারের সন্ধানে, নয় কি? ভোরে ও সন্ধ্যায় নজর রাখলে এরকম দলে দলে কাক উড়ে যাবার দৃশ্য দেখা যায়। রাত এলে কাকেরা বেশ অসহায় বোধ করে। আমাদের মাঝেও অসহায়ত্ব আছে, তবে তার মাত্রা ভিন্ন।  দিনের বেলায় খাবার সংগ্রহ শেষে রাত নামার আগেই তারা দল বেঁধে নিজেদের আশ্রয়ে চলে যায়। যেমন যে যার কাজের শেষে বাসায় ফিরি। নিজের বাসা থেকে দূরে চলে এলে দলবদ্ধ কাক অপেক্ষাকৃত যৌক্তিক ও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। আমরাও তো কোথাও গেলে কোন হোটেল, গেস্ট হাউস, রিসোর্ট নিরাপদ তাই খুজিঁ।
কাককে একক সংগী বলা হয়, কোন এক দেবী অভিশাপের ফল স্বরুপ। যা টিভি সিরিয়ালে দেখেছি। গুগুল স্যার জানান, কাক দ্বিতীয়বার জোড় বাধেঁ না, কারণ সংগী হারানোর কষ্ঠ কখনও কাটিয়ে উঠতে পারে না। দ্বিতীয়বার যে আসে সে ভালোবেসে না বিপদে পড়ে আসে। আবার কোথাও কোথাও জানান কাক সংগী থাকলওে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে। কিছুটা আমাদের সাথে মিলে, আবার নাও মিলতে পারে।
কাক অনেক সময় উপহার দেয়, যে তাকে খাবার দেয়। আমরাও উপহার পেতে এবং দিতে পছন্দ করি। কাক নিয়ে অনেক কুসংস্কার আছে। অনেক লেখা আছে। তবে মাহবুবুল আলমের মতে আমরা সবাই কি লেখক (প্রথম আলো ২৯.২.২০২৪) সে দু:সাহস আমার নেই।
এতো কথার অবতারণা একটা বাগধারা নিয়ে“ কাকের মাংস কাকে খায় না“। এটা হয়ত কাকের বেলায় ঠিক। আমরাও মানুষের মাংস খায় না। কিন্তু যা খেতে পছন্দ করি, তা হলো, মানুষের সম্মান হানি করা, হেয় করা, মানুষকে নিয়ে আলু আর চনা করা, অশ্লীল কথা বলা, ঠকানো, ভেজাল মিশানো, ভেজাল করা, চতুরতার আশ্রয় নিয়ে হয়রানি করা, অন্যের উন্নতিতে আত্মজালনি, সরাসরি না বলে গুতা খোচা মারা, অস্বাস্থকর প্রতিযোগিতা করা, নিজেকে জাহির করা, টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নিজেকে জাহির করার নামে দৈন্যতা প্রকাশ করা, একের পিছনে অন্যকে লাগিয়ে মজা দেখা, সুশীল না হয়ে সুশীলের ভাব নেওয়া, জ্ঞানীর ভাব নেওয়া, সন্দেহ পোষন এবং সন্দেহ করা, হাতটা কানে না দিয়ে চিলের পিছনে দৌঁড়ানো ।এসব কাকের প্রয়োজনের তালিকায় নেই।
কথায় বলে অষ্টদিকবন্দন্যম যা আমরা করি যেমন  আরেকজনের র্কীতি, সৃস্টি, খ্যাতি, অর্থ, বিশ্বাস, ভালোবাসা,নৈতিকতা নষ্ট করি যার ফলে কেউ মারা যায় , কেউ হার্টের রোগী, কেউ মানসিক বিপর্যয় বা যন্ত্রনায় ভোগে,কেউ ড্রাগ আসক্ত, কেউ ধুকেঁ ধুঁকে বেঁচে থাকে। তবে যে আঘাত আজ করেছেন তা আগামীতে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে। কাকের এই অসম প্রতিযোগিতা নাই। তা হলে কাকের চেয়ে আমরা ভাল না মন্দ!!!!
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.