কবিতা সংগ্রহ : আসিফ নূরের সমুদ্র মনস্কতা

কবিতা সংগ্রহ : আসিফ নূরের সমুদ্র মনস্কতা
আলম তৌহিদ :

বাংলা কবিতার আধুনিক যাত্রায় আশির দশকে বেড়ে ওঠা যৌবনকালে স্বদেশ ও বৈশ্বিক ঘটনাবহুল ঘাতপ্রতিঘাত, ধর্ম-পুরাণ, দর্শন, ইতিহাস এবং রাজনীতির জটিল সমীকরণ থেকে আহরিত অভিজ্ঞতার সঞ্জীবনী, অন্তরতাড়িত কাব্যিক তৃষ্ণায় আসিফ ধারণ করেছিলেন বাঙালির ঐতিহ্যিক চেতনায়। সেই সঞ্জীবনী ভাববোধের রংতুলিতে সফলভাবে প্রয়োগ করলেন কবিতার কৌশলী নির্মাণে। 
২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছরে আসিফের কাব্য প্রকাশিত হয়েছে ৫টি। কবিতা রচনা বা গ্রন্থ প্রকাশ করা প্রতিযোগীতার বিষয় নয়। এটি একান্ত সাধনার বিষয়। আসিফের নিরলস কাব্যসাধনার পরিপক্ক ফল হলোÑমৃগয়াসুন্দরী (২০০১), বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে (২০০৭), শরবিদ্ধ স্বরের শহর (২০১১), খেয়ালি খেয়া (২০১১) ও অপার অপেরা (২০২০) কাব্য। এই প  কাব্য নিয়ে অমর একুশে বইমেলা’২৪ উপলক্ষে ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলো ‘কবিতা সংগ্রহ’ কাব্য। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, ম্যাগাজিন ও ছোটকাগজে প্রকাশিত আরও ৯৬টি অগ্রন্থিত কবিতা ‘নীলযাপনের নকশিকথা’ শিরোনামে এ গ্রন্থে অভিযোজিত হয়েছে। 
আসিফের প্রতিটি কাব্যে আমরা লক্ষ্য করি সমুদ্রের প্রতি দুর্বার টান। তার এই সমুদ্র মনস্কতার মূলে চরম সত্য হলো আসিফ দরিয়াপাড়ের সন্তান। সুতরাং সমুদ্র তাকে টানবে, বিমোহিত করবে। তার কবিমন শুনতে পাবে সমুদ্রের ডাক। আসিফ ‘সমুদ্র দর্শন’ কবিতায় লিখেন‘সমুদ্র আমাকে ডাকে।/দূরাগত কোনো এক সুরের মতোন,/দূরতমা কোনো এক নারীর মতোন,/ ঘুমের গভীরে এসে সমুদ্র আমাকে ডাকে; আয় আয় আয়।’ সমুদ্রের এমন হৃদয়গ্রাহী আহবান আসিফের পক্ষে উপেক্ষা করা অসম্ভব। কেননা সমুদ্রের প্রতি রয়েছে তার নাড়ির টান। তার শিরায় শিরায় প্রতিটি স্পন্দন উতরোল হয় সামুদ্রিক কল্লোলে। আসিফ সমুদ্রের ডাকে সাড়া দেন ‘বাঁকখালী’ কবিতায়। আসিফ লিখেন‘বহুদিন পরে আজ বাঁকখালী তীরে,/আবারো পেয়েছি ফিরে প্রিয় তীর্থ জোয়ারি প্রহরে;/মাঝি ও মাল্লার মুখে সমুদ্রজয়ের আশাগান।’ সমুদ্রের ডাকে আসিফ ফিরে এলেন তার প্রিয় তীর্থ বাঁকখালী নদীর তীরে। বাঁকখালীর তীরে ফিরে আসার কারণ, আসিফ ভালো করেই জানেন এখান থেকে মাঝি ও মাল্লারা জীবন ও জীবিকার তাগিদে আশা জাগানিয়া গান গাইতে গাইতে সমুদ্র বিজয়ে যাত্রা করেন। এই অভিজ্ঞতা আসিফের বহু দিনের। 

‘বিষকন্যা এসেছিল বেহুলার বেশে’ কাব্যের জন্য আসিফের প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ ছয় বছরের। জীবন জিজ্ঞাসা, জ্ঞান অণে¦ষা, স্বদেশ ভাবনা এবং সময়কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে একজন কবির জন্য অবশ্যই যথেষ্ট সময়। অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে স্বদেশের অবক্ষয়ের সত্যবদ্ধ চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইতিহাসের অংশ করে তুললেন এ কাব্যে। ‘মৃগয়াসুন্দরী’ কাব্যের চেয়ে এ কাব্যে আসিফের সমুদ্র মনস্কতা আরও জোরালো হয়েছে। এ কাব্যে আসিফ বঙ্গোপসাগরকে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে ও প্রতীকে উপস্থাপন করে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ‘পাঁচ নদী সহোদরা’ কবিতায় বঙ্গোপসাগর হলো স্বামী, ‘নন্দিত নাট্যকার’ কবিতায় বঙ্গোপসাগর সাহসের প্রতীক, ‘নষ্টা’ কবিতায় বঙ্গোপসাগর সাচ্চা বহুভাতারি, ‘সমুদ্রও রজঃসলা হয়’ কবিতায় বঙ্গোপসাগর হলো রজঃসলা নারী ও ‘বঙ্গোপসাগর’ কবিতায় সমুদ্র অবিরল গতিশীল।  
‘শরবিদ্ধ স্বরের শহর’ কাব্যে আমরা দেখি প্রেম ও প্রকৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন-আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জীবনের টানাপোড়েন। এরই ভেতর চলে আসিফের দার্শনিক নিরীক্ষণ। এখনেও আসিফ সমুদ্র বিমুখ নন। ‘প্লাঙ্কটন’ কবিতায় তিনি আমাদের অতি ক্ষুদ্র প্লাঙ্কটন নামক সামুদ্রিক প্রাণির কথা জানান কাব্যিক ভাষায় ‘সমুদ্রের ¯স্রোতে ভাসে ছোটবড় অসংখ্য প্লাঙ্কটন।/এদের হাত-পা আছে, তবু হায় নিজস্ব চেষ্টায়/ একচুলও এগোতে পারে না! ওরা খুব অসহায়/ওদের চালনকর্তা জোয়ারভাটার চিরবর্তমান ঢেউ।’     
আসিফের ‘অপার অপেরা’ কাব্য মহাকালের এক বিশাল নাট্যম । এ কাব্যে সমুদ্র মনস্ক কবিতার সংখ্যা অধিক। এগুলো হলো লুসাই, জলসাগরের জলসাঘরে, পাহাড়ের চোখ, সমুদ্রকথা, স্মৃতি চরে বালুচরে, নিখোঁজ সংবাদ, গুপ্তরসায়ন, নিসর্গসংগীত প্রভৃতি। ‘জলসাগরের জলসাঘরে’ কবিতায় সমুদ্রকে চিত্রিত করেন অসাধারণ রূপকে। আসিফ লিখেন জলসাগরের জলসাঘরে ঢেউরা সব নর্তকী/সাদা ফেনার ওড়না-তোলা মাতাল নাচের তালে/ঝিনুক-শামুক দিয়ে বাঁধা নূপুর বাজায় পায়ে।’ 
‘নীলযাপনের নকশিকথা’ শিরোনামে বিন্যাসিত অধিকাংশ কবিতার প্রধান সুর প্রেম ও প্রকৃতি। এখানে সমুদ্র মনস্ক কবিতা পাই হঠাৎ, মুই দরিয়ার পুত, নদী ও সাগর, সমুদ্র, জলপরি ও মৎস্যকন্যা প্রভৃতি। ‘নদী ও সাগর’ কবিতায় আসিফ সমুদ্রকে চিত্রিত করেন প্রেমিক হিসেবে। তিনি লিখেন‘মোহনা তো পথমাত্র, গন্তব্য সাগর;/নদীদের সংসারে সাগরই নাগর।’ তাছাড়া আসিফ যে নিঁখাদ সমুদ্র সন্তান এই স্বীকারোক্তি তিনি নিজেই দিয়েছেন ‘মুই দরিয়ার পুত’ কবিতায়। আসমান সমান সাহস নিয়ে তিনি প্রেমখেলাপিদের সাবধান করেন এভাবে 'মুই দরিয়ার পুত, বরাবর বাপেরই লাহান;/আছস যত প্রেমখেলাপি, সদাবেইমান শয়তান/জলজনমের ক্ষুধার কসম কাইটা কই; সাবধান, তোরা সাবধান।’  
লেখক: ধষধসপীন০৫৩@মসধরষ.পড়স
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.