উপাধ্যক্ষ মাওলানা ছালামত উল্লাহ রহ. : আমার দেখা একজন প্রাজ্ঞ আলিম ও আদর্শ শিক্ষক

উপাধ্যক্ষ মাওলানা ছালামত উল্লাহ রহ. : আমার দেখা একজন প্রাজ্ঞ আলিম ও আদর্শ শিক্ষক
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর :

আমার দেখা একজন বিদগ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ, প্রাজ্ঞ আলিম, আদর্শ শিক্ষক ও বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক তিনি। চিন্তা-চেতনায় ঈমানী দৃঢ়তাসম্পন্ন, উচ্চমানের ইলমী যোগ্যতায় বলিয়ান, সুন্নাতে রাসুল স. এর প্রতি অতিশয় যত্নবান, চলনেবলনে ভদ্র-নম্র, আচরণে-বিচরণে শান্ত-শিষ্ট, প্রাতিষ্ঠানিকতা-আনুষ্ঠানিকতায় সুশৃঙ্খল, জীবনধারায় সময়ানুবর্তী, রুচিশীলতায় মার্জিত, মেধা-প্রতিভায় মননশীল, অত্যন্ত প্রচারবিমুখ,  নির্লোভ, নিরহঙ্কারী এমন ব্যক্তিত্বের সংখ্যা সমাজে বিরল। 
বলছিলাম রামু মেরংলোয়া রহমানিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ, উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের দারিয়ারদীঘির বাসিন্দা, আমাদের মুহতারাম উস্তায মাওলানা মোহাম্মদ ছালামত উল্লাহ রহ. এর কথা। তিনি ১ ফেব্রুয়ারি'১৯৭২ ঈসায়ীতে কক্সবাজার শহরতলীর কলাতলী এলাকায় এক দ্বীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম নূর আহমদ। পৈত্রিক বাড়ি কক্সবাজারের কলাতলী হলেও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের সুবাদে তিনি রামুর দারিয়ারদীঘিতে গড়ে তুলেছিলেন আপন নিবাস। 
বহুমাত্রিক প্রতিভাধর আলিম মাওলানা ছালামতুল্লাহ শিক্ষার প্রতিটি স্তরে অনন্য কৃতিত্বের নজীর স্থাপন করেন। তিনি ১৯৮৬ ঈসায়ীতে দাখিল, ১৯৮৮ ঈসায়ীতে আলিম, ১৯৯০ ঈসায়ীতে ফাযিল, ১৯৯২ ঈসায়ীতে কামিল এবং ১৯৯৯ ঈসায়ীতে এম. এ পাশ করেন ।

তিনি ১ আগষ্ট'১৯৯৩ ঈসায়ী সন থেকে রামু মেরংলোয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার সহ-সুপার এবং ২০১৫ ঈসায়ী সন থেকে উপাধ্যক্ষ হিসেবে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সুদীর্ঘ তিন দশকেরও অধিক সময় দ্বীনি শিক্ষাদানের খেদমতে নিবেদিত থেকে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 
আমি ২০০৭ সালে উল্লেখিত মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দেয়ার সুবাদে বিদগ্ধ এ আলেমেদ্বীনের ছাত্রত্ব লাভের খোশনসীব হয়। তিনি আমাদেরকে "মুনতাখাবুল আরবী" নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব পড়াতেন। তখনই থেকেই আমি হুজুরের ইলমী যোগ্যতার সাথে পরিচিত হই। সুন্নাতী লেবাস-পোশাকে সুশোভিত হুজুরের আদর্শিক জীবনধারায়ও আমি অনুপ্রাণিত হতাম । তিনিও আমাকে খুবই মুহব্বত করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতেন। আদর্শিক পথচলায় উৎসাহ দিতেন, অনুপ্রেরণা সঞ্চার করতেন।
আমি রামু রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার খেদমতকালে হুজুরের একমাত্র ছেলে স্নেহাস্পদ আবু ইমতিনান রায়েদকে পড়ানোর সুযোগ হয়েছে। হুজুর আমাকে বলতেন, "তোমাদেরকে আমরা পড়িয়েছি, এবার তোমরা আমাদের সন্তানদের পড়াও।" ওই সময় আমি দেখেছি একজন সন্তানের প্রতি কতটা সচেতন ও দরদী অভিভাবক, আদর্শ পিতা তিনি। 
ক'বছর আগে রহমানিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিষদ গঠন, প্রীতি সম্মেলন আয়োজন ও "সৌহার্দ" নামক স্মারকগ্রন্থ প্রকাশে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রেরণা। ওই সময় তিনি দায়িত্বশীলদের বলেছিলেন, "সম্পাদনায় মঞ্জুরকে কাজে লাগালে তোমাদের স্মারকটি সুন্দর হবে।" আমি হুজুরের তাগাদায় সে দায়িত্বটি পালন করেছিলাম। 
কোমলমতি  সন্তানদের আদর্শ প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি নিজের প্রিয় ছাত্রদের উদ্ধুদ্ধ করে  রহমানিয়া মাদ্রাসায় নূরানী বিভাগও চালু করেছিলেন। গভীর দরদ নিয়ে তিনি সেটি পরিচালনা করে আসছিলেন। মাঝেমধ্যে দেখা হলে তিনি সে বিষয়ে মত-অভিমত ব্যক্ত করতেন।
প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে হুজুরের এক অনুপম ভালোবাসাপূর্ণ বন্ধন ছিলো। তিনি সবসময় শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মত করে উপদেশ দিতেন। বিশেষতঃ সুন্নাত মোতাবেক দাড়ি রাখা, চুল কাটা, লেবাস-পোশাক পরিধান করা, সময়মত নামায আদায় করাসহ পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতিতে জীবন গড়ার প্রতি তিনি সবসময় শিক্ষার্থীদের তাগিদ দিতেন।
আমাদের শ্রদ্ধেয় এ শিক্ষক গত ৩০ এপ্রিল মাদ্রাসায় যাওয়ায় পথে রামু চৌমুহনী স্টেশনে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩ মে ( জুমাবার) ভোর সাড়ে ৪ টায় তিনি ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৫৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়েসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে যান।
আজ হুজুরের মত একজন মহৎপ্রাণ, আদর্শ শিক্ষকের চিরবিদায়ে হৃদয়রাজ্যে শোকের প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। হুজুরের সাথে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য স্মৃতি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আহ! শিক্ষক-ছাত্রের সেতুবন্ধন কতটা আত্মিক তা শোকাবহতা নিয়ে ভাবতেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে নয়নযুগল । 
বরেণ্য এ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালে কক্সবাজারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।  জুমাবার (৩ মে) বাদ আছর দারিয়ারদীঘি মারকাযুল হুদা মাদ্রাসা মাঠে মরহুমের একমাত্র ছেলে হাফেজ আবু ইমতিনান রায়েদের ইমামতিতে বিশাল নামাযে জানাযা শেষে মরহুমকে দাফন করা হয়। নামাযে জানাযায় বিশিষ্ট আলেম-ওলামা, রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিবর্গসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তৌহিদী জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীক হন।
বিশিষ্ট এ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালে আমরা একজন সমাজসচেতন, দ্বীনি কর্তব্যপরায়ণ আলেমেদ্বীনকে হারালাম। তবে অসংখ্য কীর্তিময় অবদানে তিনি আমাদের মাঝে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন যুগ-যুগান্তরে। 
আমরা আল্লাহ তা'আলার দরবারে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করি এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। 
আল্লাহ মরহুম হুজুরকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন এবং পরিবার-পরিজনকে সবরে জমিল দান করুন। আমিন। 
লেখক-সভাপতি, রামু লেখক ফোরাম। পরিচালক, দারুল কুরআন নূরানী একাডেমী, হিফজখানা ও এতিমখানা, লম্বরীপাড়া, রামু। 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম


পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.