মিয়ানমারের সেনাদের নগ্ন পলায়নে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

মিয়ানমারের সেনাদের নগ্ন পলায়নে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৭৪টি কলাম প্রকাশ করেছে। আমাদের কলামগুলোতে কোন বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল না, ছিল আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে ভুক্তভোগী উদ্বিগ্ন কক্সবাজারবাসীর মনের কথা। আমাদের সবগুলো লেখার সারমর্ম হলো অর্ধশতাব্দির উর্ধ্ব কাল ব্যাপী মিয়ানমার শাসনকারী সেনাবাহিনী দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সুচিন্তিতভাবে লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের তাদের বাপ-দাদার বসতভিটা থেকে গণহত্যা, গণধর্ষণ, বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের মাধ্যমে বাস্তÍুচ্যুৎ করে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে বা রোহিঙ্গাদের মাতৃভুমি থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯২ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। মিয়ানমারের সেনা শাসকরা পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশ ও বর্হিবিশ্বের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার ফেরত নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা বাড়ীঘরে বসবাস করার সুযোগ দিয়েছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর,চাষাবাদের জমি,মসজিদ-মাদ্রাসা,কবরস্থান ইত্যাদির কোন চিহৃ রাখে নাই সেনা শাসকরা,সব ভারী বুলড্রোজার দিয়ে সমতল করে চীন এবং ভারতকে উন্নয়নের নামে ভাগ করে দিয়েছে বলে অভিযোগে প্রকাশ। যাতে করে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ফিরে গিয়ে নিজেদের ফেলে আসা বাড়ীঘরে আবার বসবাস শুরু করতে না পারে বা বাড়ীভিটা সনাক্ত করতেও না পারে এবং ফিরে যেতে আগ্রহী না হয়। 

ভারত আমাদের বিপদের বন্ধু ও চীন আমাদের উন্নয়নের বন্ধু হলেও ছলে বলে কৌশলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে দেওয়ার ক্ষেত্রে আ লিক ও আর্ন্তজাতিকভাবে মিয়ানমার সেনাশাসকদের প্রধান সহায়তাকারী এই দুই প্রতিবেশী দেশ। বিশ্ববিবেক  থেকে ও জাতিসংঘের চাপ থেকে মিয়ানমারকে কৌশলে রক্ষা করার জন্য চীন বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের দ্বিপাক্ষিকভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য তড়িঘরি করে চুক্তি সম্পাদন করতে প্রলুব্ধ করেছে। তখনই দৈনিক কক্সবাজারের পক্ষে লেখা হয়েছিল দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন চুক্তি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না করে বিশ্ববাসী ও জাতিসংঘকে ধোকা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। যার প্রমাণ প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী সেনা শাসকরা একজন রোহিঙ্গাকেও ৭ বছরে ফিরিয়ে নেয় নাই। বরং চীনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিনিধিদল আসা-যাওয়া, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পাইলট প্রকল্প ইত্যাদি নাটক করে সময়ক্ষেপন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান সুপরিকল্পিতভাবে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে,হচ্ছে। মিয়ানমারের জন্মভুমি থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত ও বিতাড়িত  করে তাদের ফেলে আসা জমি চীন ও ভারত দখল করার মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সংক্রান্তে জাতিসংঘে ও অন্যান্য আর্ন্তজাতিক ফোরামে চীন ও ভারত মিয়ানমারের বিপক্ষে,মানবতার পক্ষে কোন সময় ভোট দেয় নাই। বরং চীন ও রাশিয়া তাদের ভেটো পাওয়ার অবৈধভাবে ও নিলজ্জভাবে মিয়ানমারের পক্ষে ব্যবহার করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সংক্রান্তে চীন,ভারত ও রাশিয়ার আচরণ আমাদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বরং শত্রæতামূলক।
রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। বার্মার ঐতিহাসিক নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার রাখা হয়েছে। আরাকানে হাজার বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমান ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টি করে ’ডিভাইড এন্ড রূল’ নীতি প্রয়োগ করার উদ্দেশ্যেই আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাজ্য পুনঃনামকরণ করা হয়েছে। সেনা শাসকদের কুটকৌশল বুঝতে পেরে স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে আরাকানের রাখাইনরা আরাকান আর্মি গঠন করে যুদ্ধ শুরু করেছে বেশ আগে। আরাকান আর্মি তাদের সকল নাগরিক অধিকার স্বীকার করে রোহিঙ্গাদেরও তাদের সাথে বার্মার নিষ্ঠুর সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য আহŸান জানিয়েছে। চীন এতদিন মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে সকল ধরনের মদদ দিলেও এখন নিজেদের স্বার্থে কৌশল পরিবর্তন করে আরাকান আর্মিসহ যুদ্ধরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকেও সাহায্য করছে। আরাকানে অবস্থিত ভারতের স্থাপনাগুলোকে আরাকান আর্মি টার্গেট করলেও চীনের স্থাপনাগুলো এখনও নিরাপদে আছে বলে জানা যায়। সম্প্রতি আরাকান আর্মির প্রচন্ড আক্রমনে রাখাইন রাজ্যে জান্তাবাহিনী বিভিন্ন শহরে পরাজিত হচ্ছে,সামরিক স্থাপনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মসমর্পণ করছে বা পালিয়ে যাচ্ছে। সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ৩৩০জন মিয়ানমারের সেনা সদস্য,বিজিপি,পুলিশ,সরকারী কর্মকর্তা অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে। সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশীরা অবাক হয়ে দেখছে জান্তা বাহিনীর সেনা ও বিজিবি সদস্যরা অনেকে নদী সাতরিয়ে দিগম্বর অবস্থায় হাত জোর করে বাংলাদেশীদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। এত দিন সীমান্ত এলাকায় গরুছাগল চড়াতে গিয়ে বা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে মিয়ানমারের বিজিপি বা জান্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্যাতিত হয়েছেন, মগের মুল্লুকের কারাগারে মাসের পর মাস করাভোগ করেছেন হতভাগ্য বাংলাদেশীরা। এত দিন তাদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানরা লাখে লাখে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন,এখন সেই নির্যাতনকারীরা,গণহত্যাকারী জান্তা সদস্যরা দেশপ্রেমিক আরাকান আর্মির হাত থেকে প্রাণ রক্ষার আশায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের ওপার থেকে নিক্ষেপ করা মটারশেল ও গুলিতে বাংলাদেশে ২জন নিরীহ মানুষ নিহত ও শিশুসহ ২০জন আহত হয়েছেন। এলাকাবাসী গুলাগুলির শব্দে আতংকিত হলেও অত্যাচারী মিয়ানমার জান্তা সদস্যদের অস্ত্র নিয়ে বা অস্ত্র ফেলে দিগম্বর বা প্রায় নগ্ন অবস্থায় হাত উচু করে বা হাত জোর করে বাংলাদেশীদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার দৃশ্য খুব মজা করে উপভোগ করছেন ভুক্তভোগী সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশীরা।
 জানা গেছে, মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী ২৩জন রোহিঙ্গাকে ১২টি অস্ত্রসহ আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে মামলা দায়ের করেছে বিজিবি। বাংলাদেশে একইভাবে অনুপ্রবেশকারী ৩৩০জন গণহত্যাকারী মিয়ানমারের জান্তাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও সাথে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য দখলে রাখার অপরাধে কি কোন মামলা দায়ের করা হয়েছে?

এটা মৃত্যুর মত সত্য যে, আমাদের মাথার উপর অসহনীয় বোঝা আশ্রিত প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গাকে সরকারীভাবে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী কেয়ামত পর্যন্ত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করার কোন সম্ভাবনা নাই। চীনের মত কৌশল পরিবর্তন করতে হবে,আরাকান আর্মির সাথে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। মিয়ানমারের জান্তাবাহিনীর এজেন্ট ’আরসা’ সদস্যদের কুমন্ত্রণায় কান না দিয়ে যেভাবে বেসরকারীভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে ঠিক সেভাবেই নিজেদের উদ্যোগে মাতৃভুমি আরাকানে আস্তে আস্তে ফিরে গিয়ে আবার বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করা উচিত। রোহিঙ্গা তরুণদের আরাকান আর্মিতে যোগ দেওয়া উচিত। এখনই রোহিঙ্গাদের যুদ্ধে যাওয়ার, স্বদেশে গিয়ে জন্মভুমির সেবা করার উপযুক্ত সময়।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.