স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশে নারী স্বাস্থ্যের অগ্রগতি

স্বাধীনতার পাঁচ দশকে বাংলাদেশে নারী স্বাস্থ্যের অগ্রগতি
ডাঃ ইফতিখার মাহমুদ
প্রতিষ্ঠাতা, হোপ ফাউন্ডেশন 
সংযুক্ত অধ্যাপক, জনস্বাস্থ্য বিভাগ, নেব্রাস্কা ইউনিভার্সিটি, ফ্যাকাল্টি মেম্বার, টাফ্টস মেডিকেল কলেজ, বস্টন। 

আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক ছোট একটি দেশের জন্ম। যুদ্ধকালিন ও যুদ্ধ পরবর্তী কয়েকবছর নানান ধরনের গভীর সংকটে জর্জরিত ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু, বাংলাদেশ সরকারের সাহসী এবং দূরদর্শী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে সকল সংকট কাটিয়ে আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশ পরিণত হয়েছি। সে সময় দেশের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, বিশেষ করে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব ছিল ভয়ানক।  কিন্তু, পরবর্তীতে নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এরই ফল সরূপ, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে নারী স্বাস্থ্যের বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
যেকোন দেশে সুস্থ ও কল্যাণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কারিগর হলেন নারীরা। তাই বর্তমান ও আগামীর প্রয়োজনেই নারীদের স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা করা সব দেশের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নারীস্বাস্থ্য বলতে আমরা সাধারণত প্রজনন সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের কথা মনে করি। কিন্তু, নারীস্বাস্থ্যে নারীর শুধু প্রজনন স্বাস্থ্যই অন্তর্গত নয়, বরং নারীর সামগ্রিক শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের বিষয়াবলী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। “স্বাস্থ্য বলতে এমন একটি সামগ্রিক অবস্থা নির্দেশিত হয় যা কেবল রোগের অনুপস্থিতিই বোঝায় না, পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সকল দিক থেকেই সম্পূর্ণভাবে ভালোথাকাকেও বোঝায়” (বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা)।
নারী স্বাস্থ্যের উন্নতির সঙ্গে শিক্ষার গভীর যোগসূত্র রয়েছে। শিক্ষিত নারী সহজে স্বাস্থ্যের তথ্য পান, গুরুত্ব বুঝেন এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ২০% এর নিচে। এখন এই হার ৭৫% এর কিছু বেশি। দেশে সরকারি ব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা বিনা বেতনে চলছে। পাশাপাশি, মেয়েরা স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশোনা করতে পারেন। নারীশিক্ষার এই অগ্রগতি নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়েছে এবং ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে যার সুফল পেয়েছে স্বাস্থ্য খাত। নিরক্ষর মায়েদের ৭৩% কোনো না কোনো প্রসবপূর্ব সেবা পান। উচ্চমাধ্যমিক পাস বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষা পাওয়া মায়ের ক্ষেত্রে এই হার ৯৯%। নিরক্ষর মায়েদের ৫১% দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে প্রসবসেবা পান, অন্যদের ক্ষেত্রে এই হার ৯৩%।

তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৫‘শ কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে এবং এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ নারী স্বাস্থ্যের অগ্রগতির একটি উদাহরণ হল এই কমিউনিটি ক্লিনিক যা গ্রামীণ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগন ও সরকারের যৌথ প্রয়াসে বাস্তবায়িত একটি কার্যক্রম। জনমূখী এ কার্যক্রম ১৯৯৬ সালে গৃহীত হয় এবং ১৯৯৮ সালে “কমিউনিটি  ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা (CBHC)” নামে একটি কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে বস্তবায়ন শুরু হয়, যার লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ মানুষের দোরগাড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে তৎকালীন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধনের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন। এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সব সামাজিক শ্রেণী ও পেশার প্রান্তিক এবং গ্রামের নারীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক বিশেষ করে নারীদের কল্যাণে সত্যিকার অর্থে ব্যাপকভাবে সফল একটি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, গর্ভবতী ও প্রসূতির স্বাস্থ্য সেবা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, পুষ্টি সেবা, ইপিআই, কিশোর-কিশোরী ও নববিবাহিত দম্পতিদের সেবা, স্তন ও জরায়ু মুখে ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাভাবিক প্রসব সহ অনেক ধরনের সেবা চালু আছে। বিগত ৪ বছরে কমিউনিটি ক্লিনিক হতে মোট ৩৫ কোটি ৬০ লক্ষের অধিক সেবাগ্রহীতা স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে ৮ লক্ষ ৯০ হাজার জন গর্ভবতী মহিলা গর্ভকালীন সেবা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে ৮০ হাজার এর অধিক স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ৪র্থ সেক্টর (৪র্থ HPNSDP) কর্মসূচিতে কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা (CBHC) অপারশেনাল প্ল্যান জানুয়ারি ২০১৭ হতে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়িত হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে সব বয়সের সকল মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৩টি সূচকের মধ্যে বেশীরভাগই কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে ৩.৮ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিসেবা (Essential Service Package) সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রাটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
নারী স্বাস্থ্যের অগ্রগতির অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত হল গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং বর্তমানে দেশে পুরুষের চেয়ে নারীদের গড় আয়ু বেশি। ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৬ বছর। ২০২৩ সালে নারীদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৪ বছর এবং পুরুষদের গড় আয়ু ৭৩ বছর হয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি পরিস্থিতি, মোট প্রজনন হার—এ ধরনের বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে ভালো করেছে বলেই দেশে গড় আয়ু বেড়েছে।  
বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর মাতৃমৃত্যুর হার উন্নয়নে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৫৩। অর্থাৎ এক লাখ জীবিত সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ১৫৩ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে যা ১৯৮৬ সালে ছিল ৫৭৪ জন। এই মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ সালে ৩৮৪ এবং ২০১৫ সালে ১৭৬ যা ধারাবাহিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত বহন করে। পাশাপাশি, বর্তমানে শিশুর মাতৃমৃত্যুর হার ২৫। অর্থাৎ ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের মধ্যে ২৫টি শিশু মারা যায় বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এবং ৩১টি শিশু মারা যাচ্ছে বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই। ১৯৯০ সালে প্রতি ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের মধ্যে ১০০ টি শিশু মারা যেতো বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে এবং পাঁচ বছর হওয়ার আগেই ১৪৪ টি শিশু মারা যেতো।  
একদা দেশে নারীদের বাল্য বিবাহ ছিল একটি সাধারণ বিষয় এবং এজন্য নারীদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যেত। বিগত ৫০ বছরে দেশে বিয়ের বয়স ধীরে ধীরে বেড়েছে। এখন প্রায় ৫০% মেয়েদের বিবাহের বয়্স ১৮ বছরের উপরে। ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে করা মেয়েদের অনুপাত ২০১১ সালে ছিল ৬৫% যা হ্রাস পেয়ে ২০২২ সালে ৫০% হয়েছে। বর্তমানে ৮২% নারী একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে কমপক্ষে একটি প্রসবপূর্ব চেক-আপ সেবা গ্রহণ করেন যা ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৬৫%। একসময় দেশে প্রসবপূর্ব চেক-আপ সেবা বলতে কিছুই ছিল না। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বাচ্চা প্রসবও।
বাংলাদেশকে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দ্রুত এবং উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ফাস্ট ট্রাক দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষ দশে স্থান দিয়েছে। বাংলাদেশ যেসব উল্লেখযোগ্য অর্জনের জন্য WHO কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেঃ ১) কমিউনিটি ক্লিনিক এবং প্রসূতি কেন্দ্র স্থাপন, ২) মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম যা প্রায় ১৫ লাখ গর্ভবতী মহিলাকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সহায়তা করেছে, ৩) পাঁচ লক্ষ নারীকে দরিদ্র গর্ভবতী মাতৃত্ব ভাতা বিতরণ, ৪) দুই লক্ষ বুকের দুধ খাওয়ানো মাকে ভাতা প্রদান, এবং ৫) ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৫৭৪ থেকে ১৭৬ এ নামিয়ে আনা। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণ মোটেও সহজকথা নয়। বাংলাদেশ সরকারের নারী স্বাস্থ্যের অগ্রগতির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি ছিল বলেই এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.