এখন কক্সবাজার জেলার জন্য একজন পাবলিক প্রসিকিউটর আছেন। তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জন্য তিন জন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আছেন। পদাধিকার বলে সিনিয়র স্পেশাল জজ (কক্সবাজার দায়রা জজ) আদালতের জন্য দুদকের মামলার জন্য দুইজন পাবলিক প্রসিকিউটর আছেন। আমি ১৯৮৮ সালের মার্চ মাস থেকে ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলাম। তখন নারী শিশু নির্যাতন বিষয়ক মামলা ও দুর্নীতির মামলার জন্য আলাদা পিপি না থাকায় আমাকেই সেই দায়িত্ব পালন করতে হতো। কিছু দিন আগে সংবাদপত্রে দেখলাম দুদকের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ চট্টগ্রামের এক থানায় পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন । তিনি কক্সবাজারে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ইন্সপেক্টর হিসেবে ও পরে জেলা এন্টি-করাপশন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। একজন সৎ, নির্লোভ, আন্তরিক ও দক্ষ অফিসার ছিলেন। সংবাদপত্রে পড়েছি, তার এক শত্রু ভাড়াটিয়া বাদী দিয়ে তার বিরুদ্ধে আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে পরোয়ানা ইস্যু করাতে সক্ষম হয়েছেন। পুলিশ তাকে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান। তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাকে সাথে ঔষধপত্র নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় নাই। তাঁর স্ত্রী ও পুত্র থানায় ঔষধ নিয়ে যান এবং গুরুতর অসুস্থতার কথা বলে ঔষধ দিতে চাইলে তা দিতে দেওয়া হয় নাই। কিছুক্ষণ পরে তিনি থানা হেফাজতেই ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ এই ভাল মানুষটার গুনাহখাতা মাফ করে তাঁকে বেহেস্তে নসীব করুন। তাঁর স্বজনরা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মিথ্যা মামলা দায়েরকারী বাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে সাময়িক বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত চলছে মর্মে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছে।
বিগত ৪৫ বছর ধরে উকালতি পেশায় আছি বিধায় আমার কাছে পরিচিত, অপরিচিত, বন্ধুবান্ধব অনেকে আইনী পরামর্শের জন্য আসেন। কয়েক দিন আগে কক্সবাজার এন্ডারসন রোডের আমার নিকট প্রতিবেশী বয়সে আমার প্রায় এক দশক ছোট অত্যন্ত নম্র ভদ্র,পরিশ্রমী ও সফল ব্যবসায়ী তমিজ সওদাগরের (মরিচ্যা বাজারের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী) মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে চেম্বারে বসে অন্য কাজে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিলাম। তখন একজন ৭০+ বয়সের ১০ বছর আগে কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেওয়া অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্থ, উদ্বিগ্ন, নার্ভাস, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে চিকিৎসাধীন অসুস্থ বন্ধু পরামর্শের জন্য আসেন। তার বিরুদ্ধে ও ৭৭+ বয়সী মেজর অপারেশনের অসুস্থ ও প্রায় অচল চট্টগ্রামে বসবাসকারী তার বৃদ্ধ মামার বিরুদ্ধে ভুমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এর ৯ ও ১৬ ধারায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছে জেনে পরামর্শ করার জন্য এসেছেন। তার কথা শুনে আমার নিজেকেই আসামী ও অপরাধী মনে হচ্ছিল। মামলার বাদী কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির একজন সদস্য। তার অভিযোগ হলো বাদী তাদের আত্মীয়। বাদীর সব কিছু জানা থাকা সত্তে¡ও তিনি ফৌজদারী দরখাস্তে ১নং আসামীর বয়স দিয়েছেন ৬৫বছর, ২নং আসামীর বয়স ৬২বছর। ১নং আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হল ২৮বছর আগে টাকা পয়সা নিয়ে জমি রেজিষ্ট্রী দিয়ে জমির দখল দিচ্ছে না। বাদী জমির দখল নিয়ে ঘেড়াবেড়া দিতে গেলে ২নং আসামী সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে বাঁধা দিয়েছেন। সারা জীবন কলেজে শিক্ষকতা করে দশ বছর আগে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছি। আমার পরিচয় গোপন করে বৃদ্ধ বয়সে আমাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হলো ? এই দুঃখ,হতাশা ও অপমানের কথা কাকে বলবো? আমার অনেক ছাত্রও এখন আইনজীবী। আবেগাপ্লুত সাবেক অধ্যক্ষ সাহেবের কথাগুলো আমার বুকে তীরের মত বিদ্ধ হচ্ছিল। বাদী পূর্বে ১নং আসামীর বিরুদ্ধে ক্রয় করা জমির দখল নিয়ে ঘর তৈরী করেছেন দাবী করে দেওয়ানী মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই দেওয়ানী মামলায় সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা নিয়ে বাদী আপোসনামা দিয়ে মামলা সোলেসুত্রে নিস্পত্তি হয়েছে ২০০৯সালে। কক্সবাজারে যে দিন ঘটনার তারিখ বলা হয়েছে সেই দিন ২নং আসামী দিনাজপুর সরকারী মেডিকেল কলেজের ৪র্থ বর্ষে পড়ুয়া তার একমাত্র কন্যাকে দেখতে বিমানে দিনাজপুর গিয়েছিলেন, বিমানের টিকিটও আছে। তার দুই পুত্র উচ্চশিক্ষিত ও স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ডাহা মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানামূলে পুলিশ যদি আমাকে গ্রেপ্তার করেন সাবেক অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার শিরোনামে তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হবে। আমার ছেলেমেয়ের মানসম্মান কি সমাজে বাকী থাকবে?
২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখ রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভ করা নতুন আইনটি প্রথম বারের মত পড়লাম। এই আইনের ১৯ ধারায় আছে ৪ ও ৫ এ বর্ণিত অপরাধ অজামিনযোগ্য,অন্যান্য ধারায় বর্ণিত অপরাধ জামিনযোগ্য। সুতরাং ৯ ও ১৬ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য বিধায় পুলিশ গ্রেপ্তারী পরোয়ানামূলে গ্রেপ্তার করলেও আদালতে আত্মসমর্পণ করার শর্তে সাথে সাথে জামানত নিয়ে জামিন দিয়ে দিতে পারেন। আইনের প্রতিষ্ঠিত বিধান হল জামিনযোগ্য ধারার অপরাধের মামলায় জামিন পাওয়া আসামীর অলংঘনীয় অধিকার। ২৮ বছর আগের বিরোধটি ১৫ বছর আগেই দেওয়ানী আদালতে বাদী সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা গ্রহন করে আপোসনামা দেওয়ায় নিস্পত্তি হয়েছে তার কাগজপত্র নিয়ে দরখাস্ত দাখিল করলে বিজ্ঞ ম্যাজিষ্ট্রেট মামলা খারিজ করে দেওয়ার শত ভাগ সম্ভাবনা আছে। অতিরিক্ত টেনশন করার দরকার নেই। অনতিবিলম্বে মামা-ভাগিনা সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের প্রার্থনা করুন। অপরাধজনকভাবে গোপন করা সত্য কথাগুলো দালিলিক প্রমাণসহ আদালতে উপস্থাপন করে প্রতিকার চাইলে অবশ্যই ন্যায় বিচার পাবেন। আদালতের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।
দেশের সিনিয়র সিটিজেন বা বৃদ্ধদের শেষ বয়সে মানসম্মান নিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা কি রাষ্ট্র দেবে না? বিবেকের তাড়নায় সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্কতার জন্য কলামটি লিখলেও মামলাটি এখনও বিচারাধীন বিধায় মামলার নম্বর,বাদীর নাম,আসামীদের নাম ও আদালতের নাম সঙ্গত কারণে উল্লেখ করা হয় নাই।
যদি গ্রেপ্তারী পরোয়ানামূলে বৃদ্ধ,অসুস্থ হৃদরোগী আসামীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ থানায় নিয়ে আসতেন তখন হতভাগ্য সাবেক দুদক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর মত ঘটনার পুনারাবৃত্তি হতো না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আল্লাহর দরবারে হাজারো শুকরিয়া পুলিশ, আদালত ও আইনজীবী, সকলের মানসম্মান রক্ষা হয়েছে।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।