নির্বাচন, দুর্নীতি ও অপরাধ

নির্বাচন, দুর্নীতি ও অপরাধ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে বলে অর্থনীতিবিদরা আগে থেকেই সতর্ক করে দেন। জাতীয় নির্বাচন হউক, আর স্থানীয় নির্বাচন হউক নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে খরচ করার বৈধ অধিকার প্রার্থীদের আছে তা আইনদ্বারা স্বীকৃত। তবে কত টাকা খরচ করতে পারেন তার একটা সীমা আছে। আমাদের দেশে নির্বাচন করে যারা নির্বাচিত হন তারা সবাই নির্ধারিত সীমার কয়েক গুণ বা শত গুণ বেশী খরচ করেন। কিন্তু নির্ধারিত সীমার মধ্যে খরচ করা হয়েছে বলে একটি মিথ্যা বিবরণীতে দস্তখত করেন। আমাদের সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী থেকে বিরোধী দলের নেতানেত্রী পর্যন্ত (কয়েকজন সম্মানজনক ব্যতিক্রম হয়তঃ থাকতে পারেন) সবাই মিথ্যা বিবরণীতে স্বাক্ষর দিয়েই প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে তাদের পবিত্র কর্ম শুরু করেন। তা না হলে দেশে মিথ্যার বেসাতি ও দুর্নীতির পতাকা উড়বে না কেন? চোরের মার বড় গলা হবে না কেন? 

দেশে আবার নির্বাচনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। দেশে একেকটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি কত হয় বা কি পরিমাণ দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় তা কেউ হিসেব করে দেখেন নি। নির্বাচনের সময় অনেক অপরাধ বা দুর্নীতি জায়েজ হয়ে যায়, যুদ্ধে ও প্রেমে সব কিছু জায়েজের মত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বে যারা আছেন তারা যেন কিছুই দেখেন না। নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী সকল প্রার্থী বা দলের সবার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে জয় লাভ করা। ভোট কিনে হউক, ভোট জালিয়াত করে হউক, ভোট কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সীল মারা হউক, অস্ত্রবাজী ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোট কেন্দ্র দখল করে হউক, সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের ঘুষ বা চাপ দিয়ে বশ করে ইচ্ছামত ভোটের মিথ্যা ফলাফলের বিবরণী তৈরী করে হউক ভোটে জয়ী হওয়া চায়। যে কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা সবকিছুকে ইয়েস করে যে কোনভাবে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য নেতা/কর্মীদের নির্দেশ দেন। 
দেশে প্রচলিত আইনে অর্থাৎ ১৮৬০ সালের দন্ডবিধিতে নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধের ও শাস্তির তালিকাও আছে। তাতে ১৭১ক থেকে ১৭১ঝ পর্যন্ত নয়টি ধারা আছে। দন্ডবিধির ১৭১ঙ ধারায় উল্লেখ আছে যদি কেউ নির্বাচনে ঘুষ প্রদান বা গ্রহনের অপরাধ করে সে এক বৎসর অবধি কারাদন্ড বা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন । ১৭১চ ধারায় উল্লেখ আছে যদি কেউ নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব প্রয়োগের অথবা ছদ্মবেশ ধারণের অপরাধ করে সে এক বৎসর মেয়াদের যে কোন ধরণের কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। ১৭১ছ ধারায় উল্লেখ আছে যদি কেউ নির্বাচনের ফলে প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন নির্বাচন প্রার্থীর চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেয় সে অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবে। ১৭১ঝ ধারায় উল্লেখ আছে যদি কেউ সমকালে বলবৎ থাকা কোন আইন বা বিধি অনুসারে নির্বাচনে বা নির্বাচন সুত্রে ব্যয়িত অর্থের হিসাব রাখতে বাধ্য হওয়া সত্বেও ঐরূপ হিসাব রাখতে অক্ষম হয় তবে তাকে অর্থদন্ডে দন্ডিত করা যাবে যার পরিমাণ পাঁচশত টাকা অবধি হতে পারে।  উল্লেখিত আইনগুলি আইনের বইতে থাকলেও বাস্তবে তা সব সময় অকার্যকর থাকতেই দেখা যায়।
দেশে ১/১১ এর অচিন্তনীয় ও কল্পনাতীত পরিবর্তনের পর ১৬ মাসের অধিক কাল দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বহু রাঘব বোয়ালকে ধৃত করা হয়েছে। তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া কি দেশের সাধারণ রাজনৈতিক নেতাদের উপর পড়েছে? সম্প্রতি একটি অতি সম্মানিত একটি জেলা ভিত্তিক সমিতির নির্বাচন হয়ে গেল যার ভোটার ও প্রার্থীর কমপক্ষে যোগ্যতা হল যুগ্ন স্নাতক বা ডবল-গ্রেজুয়েট । একটি জেলার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও এই সমিতির ভোটার ও প্রার্থী হয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে রাজনৈতিক দলগুলোর গোপন সভাতে সিদ্ধান্ত  হয়েছে যে কোনভাবে উক্ত নির্বাচনে জয়ী হতে হবে, প্রয়োজনে যত টাকা লাগে ভোট কিনতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকল দলই বিনাদ্বিধায় নির্লজ্জভাবে ভোট ক্রয় করার চেষ্টা করেছেন এবং কমবেশী ভোট কিনেছেনও। কোন দলের নেতা ধোয়া তুলশীপাতা নন। যারা বেশী টাকা খরচ করেছেন সে দলের প্রার্থীই নির্বাচিত হয়েছেন। গভীর অনুসন্ধান করে জানা যায় আগেও নির্বাচনের সময় ঐ সম্মানজনক সমিতির শতকরা ৫ ভাগ ভোটার টাকার বিনিময়ে ভোট দিয়েছেন। এই বার রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে শতকরা ১৮জন ভোটারকে কিনতে সক্ষম হয়েছেন। নেতাদের অনেক চেষ্টার পরও শতকরা ৮২জন এখনও সৎ আছেন। তবে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাও টাকার বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে ভোট বিক্রী করেছেন বলে লজ্জাজনক সংবাদ আছে। অবশ্য তা প্রমাণ করা খুবই দুঃসাধ্য। এ সমিতির নির্বাচনে যারা ভোট বিক্রী করেছেন তারা জীবনে কোন দিন অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকেননি। দেশে যে নিরব দুর্ভিক্ষ বা চলমান গোপন ক্ষুধার জ্বালায় গরীব মানুষগুলো অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেন যেখানে রাজনৈতিক দলের জেলা উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের অবৈধভাবে লুন্ঠিত টাকার পাহাড় প্রায় বহাল তবিয়তে আছে, সেখানে কালো টাকার প্রভাবমুক্ত সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন কিভাবে আশা করা যায? সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সম্মানজনক সমিতির নির্বাচনগুলোকে যদি মানদন্ড হিসাবে ধরা হয় তবে বলা যাবে শত ওয়াজ নছিহত ধারপাকড় সত্বেও কালোটাকার মালিক, সন্ত্রাসীদের গডফাদার, দুনীতিবাজ রাজনীতিজীবীরা বা রাজনীতি ব্যবসায়ীরাই (প্রকৃত রাজনীতিবিদ নন) বেশীর ভাগ নির্বাচিত হবেন। নতুন বোতলে পুরাতন মদ নয়, অনেকটা পুরাতন বোতলে পুরাতন মদ। সে চিরচেনা চোরের মার বড় গলা।       

উল্লেখিত লেখাটি গত ৩০ এপ্রিল ২০০৮ খ্রিঃ তারিখ দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় অতিথি কলামে প্রকাশিত হয়েছিল, যা এখনও প্রাসঙ্গিক। আগামী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দেশের প্রচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে তা শতভাগ নিশ্চিত বলে আমজনতার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম বারের মত ভোট দেওয়ার সুযোগ পাওয়া কয়েক কোটি নতুন ভোটারসহ ভোটাররা ভোট দিয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে কে বসবেন-জাতীয় পার্টি, ঈগল, নাকি ট্রাক তাদের নির্বাচন করবেন। শত উত্তেজনা, হানাহানি, মারামারি, খুনাখুনি করেও অন্য কোন ফলাফল আনার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।  যেন নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো Something is better than nothing) । যেন নাই গণতন্ত্রের চেয়ে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ভালো?
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.