‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে উপচে পড়ছে ফল

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’তে উপচে পড়ছে ফল
॥ অমল সরকার ॥

ভোট বাংলাদেশে। সেই নির্বাচন অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করতে মাথার চুল ছিঁড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভাঙা রেকর্ডের মতো প্রতি সপ্তাহেই জো বাইডেনের প্রশাসন বলে চলেছে, বাংলাদেশে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ভোট চাই।
মার্কিন হুঁশিয়ারির বিরুদ্ধে রাশিয়ার তোপ ঠান্ডা যুদ্ধের দিনগুলোর তথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মস্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রক পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, বাংলাদেশের ভোট নিয়ে আমেরিকা পরামর্শ দেওয়ার কে? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভোট নিয়ে শেষ কথা বলবে সে দেশের জনগণ। আমেরিকার মাথাব্যথা কীসে!
সক্রিয় ঢাকার চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও। তাঁর কথায়, যে যাই বলুক, বেইজিং শেখ হাসিনার পাশে আছে এবং ভোট হবে বাংলাদেশের সংবিধান মেনে। অর্থাৎ বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চীনের সায় নেই, বুঝিয়ে দিয়েছেন শি জিন পিংয়ের ঢাকার দূত।

বাংলাদেশের পাশে আছে ভারতও এবং শেখ হাসিনার দেশে আমেরিকার ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল অভিভাবকত্ব’, যে নয়াদিল্লির পছন্দ নয় নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিদেশ সচিব বিনয় কোয়াত্রা ভদ্র ভাষায় সে কথা মার্কিন বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
যে চারটি দেশের কথা এ পর্যন্ত উল্লেখ করলাম, সেগুলোর মধ্যে ভারতকে বাকিদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে রাখা চলে না। কারণ, ভারত ও বাংলাদেশ জন্মসূত্রে একে-অপরের পরম বন্ধু, সাফল্য-ব্যর্থতার ভাগিদার এবং দুই দেশের সম্পর্ক এখন বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করার মতো।
কিন্তু বাকি তিন মহাশক্তিধর দেশ কেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একে-অপরের বিরুদ্ধে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে? গণতন্ত্রের স্বঘোষিত গুরুঠাকুর আমেরিকার অবাধ-অংশগ্রহণমূলক ভোটের বুলি আসলে আধিপত্য স্থাপনের গুলি, বিশ্বের নানাপ্রান্তের মানুষ যা বহুবার টের পেয়েছেন। চীন-রাশিয়ার বাংলাদেশ প্রীতির পিছনেও আছে তাদের সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা।
প্রশ্ন হলো, এত দেশ থাকতে তিন বিশ্ব শক্তির শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যার দেশের প্রতি নজর পড়েছে কেন? মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতসহ এই চার দেশকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল অথবা ইতিবাচক অবস্থান নেয়নি। এই বন্ধনীতে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সাবেক মার্কিন বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার শতবর্ষ পার করে এমন সময় জীবনের ইনিংস শেষ করলেন যখন বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ দেশটিকে তিনি গর্ভাবস্থায় হত্যার যাবতীয় চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রসব আটকাতে না পেরে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে বিদ্রƒপ করেন। আমি তো মনে করি বাংলাদেশের মানুষের এবার আরও বেশি সংখ্যায় ভোটদান করে কিসিঞ্জারের অসম্মানের প্রতিবাদ জানান সময়ের দাবি।
ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে, কেন শক্তিধর দেশগুলোর শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যার দেশের প্রতি নজর পড়েছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সাম্প্রতিক মন্তব্যে এই প্রশ্নের খানিক জবাব আছে। চার বছর পর দেশে ফিরে লাহোরের জনসভায় তিনি এই বলে আক্ষেপ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামান্য পাট ছাড়া আর কী হতো। অথচ সেই দেশ এখন পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একই কথা শোনা গেছে ইমরান খানের গলাতেও। আসলে ১৯৭১-পরবর্তী ৫২ বছরে পাকিস্তান শুধুই পিছিয়ে গেছে, এগিয়েছে বাংলাদেশ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা সবারই জানা। আমার মনে হয়, সেটাই শেখ হাসিনার শাসনামলে শক্তিধর দেশগুলোর বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের একমাত্র কারণ নয়। বরং দেশটির অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রগতিই তাদের শেখ মুজিবের দেশের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। বাংলাদেশ এখন সেই বাজার, যেখানে পসরা সাজালে কেনার মানুষের অভাব নেই। আমি জেনেছি, ভোট নিয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশকে আরও বোয়িং বিমান বিক্রি করা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন।
প্রখ্যাত দুই অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং জেআর পারকিনসন তাদের ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ : দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ে বলেছিলেন, ‘উন্নয়নের একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র হলো বাংলাদেশ। দেশটি যদি উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।’
বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি ভঙ্গুর এবং অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ছিল অশান্ত।
জাতীয় বাজেটের ৯০ ভাগই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা। সেই বাংলাদেশের অগ্রগতিকে মেনে নিয়ে ২০০৭-এ তাঁরা ফের লেখেন, ‘তিন দশক পর বলাই যায় বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।’ দুর্ভাগ্যের হলো, তারপরও বেশ কিছু বছর বাংলাদেশের ভাবমূর্তির গায়ে লেপ্টে ছিল চরম দারিদ্র্য, জঙ্গিবাদ, অনুপ্রবেশ শব্দগুলো। করোনা মহামারির সময়ও আমি বহু ভারতীয়কেও বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা ব্যক্ত করতে শুনেছি, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাংলাদেশ ঠিক কোন অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকায় সে দেশে পদার্থবিদ্যার নামি অধ্যাপক পারভেজ হুদভয় তাঁর ‘হোয়াই বাংলাদেশ ওভারটুক পাকিস্তান’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জন্মকালে দেশটির এমন অবস্থা যে একজনও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলা পর্যন্ত ছিলেন না।’
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্যাবিনেট সচিব প্রয়াত এইচ টি ইমাম গোড়ার দিনগুলো স্মরণ করতে গিয়ে দক্ষ অফিসারের অভাবের কথা বারবার বলতেন। বাঙালিদের দাবিয়ে রাখা যাবে না বুঝতে পেরে বাংলাদেশের বিজয় ঘোষণার দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল প্রসব হতে যাওয়া দেশটির মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার অপচেষ্টা। পথঘাট-সেতু-স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-রেলস্টেশন ধ্বংসের পাশাপাশি মানবসম্পদকেও নির্মূল করে দিতে চেয়েছিল তারা।
বাংলাদেশের এই অগ্রগতির একটি কারণ অবশ্যই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা। মাথাপিছু গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বাংলাদেশের ভারতকেও ছাপিয়ে যাওয়ার পিছনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বড় ভূমিকা নিয়েছে। তবে ১৯৮০ থেকে ২০০৭, এই সময়কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ছবিটা কিন্তু এমনটা ছিল না। বরং পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় মাথাপিছু আয় কম ছিল। গত দেড় দশকে চমকপ্রদ উন্নয়নের রহস্যটা তাহলে কী?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রাকে দুটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া দরকার। প্রথম পর্বটি মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরবর্তী হিংসা দীর্ণ পরিস্থিতি। দীর্ঘ সেনাশাসন পরবর্তী আরও বেশ কিছু বছর পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সেই সাফল্য ধরা পড়ে ২০১১-তে প্রকাশিত রাষ্ট্রসংঘের মানবোন্নয়ন রিপোর্টে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং অসাম্য দূরীকরণে আগের কুড়ি বছরের অগ্রগতির নিরিখে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭৮টি দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করে।
ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-কে কোথায় দাঁড়িয়ে সে বিষয়ে বিগত কয়েক বছর ধরেই চর্চা অব্যাহত আছে। দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মাথাপিছু আয়, আয়ুষ্কাল, সদ্যোজাতের মৃত্যুহার, সাক্ষরতা, বিদ্যুতের সুবিধার মতো ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও ভারত-বাংলাদেশের থেকে অনেক পিছিয়ে। বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকেও ছাপিয়ে গেছে।
অগ্রগতির এ ধারা বজায় রাখতে, টেকসই করতে জরুরি ছিল বড় মাপের পরিকাঠামোর বিকাশ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে ২০২৩-কে মাইলস্টোন বলা চলে। পদ্মা সেতু, সেই সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগ, এক্সপ্রেসওয়ে, রাজধানীতে মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে রাস্তার মতো আধুনিক পরিকাঠামো তো আছেই, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রেল যোগাযোগের বিস্তারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণাংশের ২২ জেলায় পদ্মা সেতুর ভূমিকা পুরনো বাড়ি রং করা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ভিত।
সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি পরিকাঠামোগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অনেক অর্থেই পৃথক। বিশ্বব্যাংকের অসহযোগিতাসহ অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশি ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এই প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা এককথায় অতুলনীয়। পৃথিবীতে এমন গুণসম্পন্ন প্রশাসকদের সাফল্যের নজির হাতেগোনা। এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত হিসেবে এমন একজনের কথা বলব, বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যার অবদান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে।
তিনি আমার চোখে ‘দাইমা’ ইন্দিরা গান্ধী, যিনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির লড়াইয়ে ভারতীয় সেনা পাঠিয়ে বিশ্বে বাঙালির একমাত্র রাষ্ট্রটির প্রসব ত্বরান্বিত করেছিলেন। সেই সিদ্ধান্তটি ছিল শ্রীমতী গান্ধীর অসংখ্য সাহসী সিদ্ধান্তের একটি, শুরুতে যে প্রস্তাবে ভারতের সেনাকর্তারা পর্যন্ত সায় দিতে পারছিলেন না।
মৃত্যুর ১০৬ বছর পরও ভারতের যাবতীয় অর্জনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর অবদান জড়িয়ে আছে দেশ ও জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে কিছু সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য।
গত শতকের ছয়ের দশকে দলীয় সতীর্থদের যাবতীয় আপত্তি অগ্রাহ্য করে তিনি ব্যাংক, কয়লা খনি জাতীয়করণের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের অগ্রগতির ভিত মজবুত করে দিয়ে গেছেন। পদ্মা সেতু নিয়ে শেখ হাসিনার পদক্ষেপ আমাকে বারবার শ্রীমতী গান্ধীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিকাঠামোর উন্নতি নিছকই একটি সরকারের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা নয়, একজন প্রশাসকের দূরদর্শিতা ও সাহসিকতার নজির। আর এভাবেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে উন্নয়নকে জুড়তে পেরেছেন মুজিবকন্যা। মুক্তিযুদ্ধের পুঁজি ছিল ইচ্ছাশক্তি ও সাহস। যা বাঙালির রক্তে সঞ্চালিত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে শত কোটি প্রণাম।
লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক, দ্য ওয়ালের এক্সিকিউটিভ এডিটর এবং বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.