স্মরি তোমায় হে পিতা / রাজনৈতিক মহাকাব্যের মহানায়কের জীবনালেখ্য

স্মরি তোমায় হে পিতা / রাজনৈতিক মহাকাব্যের মহানায়কের জীবনালেখ্য
মোঃ ইব্রাহিম হোসেন :

গোলাপগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়রা বেগমের ঘর আলো করে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম গ্রহণ করে খোকা বাবু। বাবা-মা’র ছয় সন্তানের মধ্যে খোকা বাবু ছিলেন তৃতীয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গোপালগঞ্জে। খোকা বাবু ওরফে শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ অধ্যায়ন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের ঘর আলো করে জন্ম নেন দুই কন্যা ও তিন পুত্র সন্তান।

অনন্য মেধার অধিকারী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে খুব অল্প বয়সেই। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি “নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র ফেডারেশেন”-এ যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে তিনি কট্টরপন্থী এই সংগঠন ত্যাগ করে উদার ও প্রগতিশীল সংগঠন ”বেঙ্গল মুসলিম লীগ”-এ যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।’ ফলে ধীরে ধীরে কট্টরপন্থী, রক্ষণশীল নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্তৃত্ব খর্ব হয়। তাঁর দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধা তাঁকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছাকাছি নিয়ে আসে।
রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রথম তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ভাষা আন্দোলনের সময়। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তাঁর নের্তৃত্বে প্রথম প্রতিবাদ ও ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত রূপ নেয়। প্রত্যেকের জীবনেরই নির্দিষ্ট কিছু অধ্যায় থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান শুরু হয় 1950 দশকে। দূরদর্শিতা এবং কুশলী নেতা শেখ মুজিব মুসলিমলীগ ত্যাগ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাষানীর সাথে যৌথভাবে “আওয়ামী মুসলিমলীগ” গঠন করেন এবং তিনি দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জীবনাসনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। আইয়ুব খান প্রণীত মৌলিক গনতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন শেখ মুজিব ফলে ১৯৬৬ সালে লাহোর সম্মেলনে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী উত্থাপন করেন। এই ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা পরবর্তীতে যা স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ফুঁসে উঠে। ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। বঙ্গপোসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো গর্জে ওঠে বাঙ্গালি জনগণ। জনরোষের মুখে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মুক্ত মুজিবকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা দেয় হয়। উক্ত গণসংবর্ধনায় পূর্বোক্ত ছয় দফার সাথে নূতন আরও পাঁচটি দফা সংযুক্ত করে এগারো দফা দাবী উত্থাপিত হয়। লাখো মানুষের গণসংবর্ধনায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
আমার “সোনার বাংলা” পূর্বপাকিস্তান নামে অভিহিত। রাজনৈতিক মহাকবির হৃদয় ভেঙ্গে খান খান। বদ্বীপ বেষ্টিত ইতিহাস ঐতিহ্যের এই দেশ কোনো ভাবেই পূর্ব পাকিস্তান হতে পারে না। ভারাকান্ত হৃদয়ে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত জনসভাস্থলে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনে বিপরীতে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহানা করতে থাকে। ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন ডাকা থেকে বিরত থাকেন। শেখ মুজিব বুঝতে পারেন পাকিস্তানের এ জাল ছিন্ন করতে হলে আন্দোলনের বিকল্প নেই।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”- আকাশে-বাতাসে, সাগরে-পাহাড়ে স্পন্দিত হতে থাকে তাঁর এ অমর বাণী। স্পন্দিত, ঋদ্ধ, জাগ্রত বাঙ্গালির জন জোয়ারে ভীত, সন্ত্রস্ত ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করেন এবং শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রি। নিরস্ত্র, নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙ্গালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শকুনের দল। শুরু হয় ইতিহাসের জঘণ্যতম হত্যাকান্ড “অপারেশন সার্চলাইট”। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কেউ রক্ষা পায়নি পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। গ্রেফতারের পূর্বেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
২৬ মার্চ ১৯৭১ যুদ্ধ শুরু হলে ১৯ এপ্রিল প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয় এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা হয়। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মনোনীত করা হয় এবং গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। শুরু হয় পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ত্রিশ লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি রাস্ট্র স্থান করে নেয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটে। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বরণ করে নিতে লাখো মানুষের ঢল নামে ঢাকা বিমান বন্দরে। আবেগে আপ্লুত শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলার মাটি কপালে স্পর্শ করেন। পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নেন প্রিয়জন হারানো মানুষদের। শুরু করেন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত স্বাধীন বাংলা পুনর্গঠনের কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা আসা শুরু হয়। নব উদ্যমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপান্তরের কাজে।
ক্ষমতালিপ্সু একদল বিপথগামী সেনা সদস্য কর্তৃক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণ শহিদ হন। বিদেশ থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তাঁর দুই কন্যা। বড় কন্যা শেখ হাসিনার নের্তৃত্বে বাংলাদেশ দূর্বারগতিতে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্ন পূরণে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। তিনি ধ্রুব তারা হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন সমগ্র বিশ্বে।
লেখক : অধ্যক্ষ, কক্সবাজার ডিসি কলেজ।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.