প্রসঙ্গ: নির্বাচনী প্রচারণার ‘সর্বস্তরের জনগণ’

প্রসঙ্গ: নির্বাচনী প্রচারণার ‘সর্বস্তরের জনগণ’
আসিফ নূর :

প্রথা বা রেওয়াজ একটি ঐতিহ্যিক ও ঐতিহাসিক বিষয়। একেক দেশে একেক প্রথা। এই রঙ্গভরা বঙ্গদেশেও নানানরকম প্রথা প্রচলিত। আমাদের তেমনি একটি নির্বাচনী প্রথা নিয়েই আমি আজ দুকথা বলবো। সংসদীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ সব গণনির্বাচনের প্রচারণাকর্মেই এই প্রথাটি অনিবার্যভাবে প্রচলিত। সেটি হলো, সবকটি গণনির্বাচনের পোস্টার, ব্যানার, প্রচারপত্র, তোরণ ইত্যাদিতে একজন প্রার্থীকে বিভিন্ন যোগ্যতার বিশেষণ দিয়ে সেই প্রার্থীর পক্ষে সংশ্লিষ্ট পদে একটি নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট চাওয়া হয়। নিচে নিবেদক বা প্রচারক হিসেবে লেখা থাকে অত্র নির্বাচনী এলাকার সর্বস্তরের জনগণ বা জনসাধারণ। আমার বিস্মিত ভাবনা নির্বাচনী প্রচারণার রীতিসিদ্ধ ও কথিত এই ‘সর্বস্তরের জনগণ’ বা ‘সর্বস্তরের জনসাধারণ’ কথাটি নিয়েই।
প্রথমত বলতেই হয়, কোনো গণনির্বাচনে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ‘সর্বস্তরের জনগণ’ যদি সত্যিকার অর্থেই কোনো প্রার্থীকে এককভাবে চায়, তাহলে তো সেখানে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রতিযোগিতায় সচল থাকার কথা না অর্থাৎ তখন নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সব নির্বাচনেই কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ভোটযুদ্ধে ক্রিয়াশীল থাকেন, নির্বাচনও হয় এবং প্রচারণায় সব প্রার্থীর পক্ষেই নিবেদক বা প্রচারক হিসেবে লেখা হয় ‘সর্বস্তরের জনগণ’ বা ‘সর্বস্তরের জনসাধারণ’। দ্বিতীয়ত, ধরেন একটি নির্বাচনে তিনজন প্রার্থী। তিনজনের পক্ষেই যখন সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন আছে বলে দাবি করা হয় এবং আমরা যদি তিনপক্ষের কথাকেই সত্য বলে গণ্য করি, তখন কিন্তু জনগণ বা ভোটার সংখ্যাও তিনগুণ বেড়ে যায়। কাজেই আমাদের নির্বাচনী প্রচারণায় ঢালাওভাবে চিরব্যবহৃত এই ‘সর্বস্তরের জনগণ’ বা ‘সর্বস্তরের জনসাধারণ’ কথাটি বাস্তবসম্মত নয়, সম্ভবপরও নয় এটি প্রচলিত রীতি মাত্র।
একটি রোমান প্রবাদ আছে ‘ভক্স পপুলি ভক্স ডি’, অর্থাৎ ‘জনগণের কণ্ঠস্বরই বিধাতার কণ্ঠস্বর’। এই প্রবাদটিতে সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যকে পবিত্র মহাশক্তি মান্য করে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, সর্বস্তরের জনগণ যখন কোনো ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন দেন, তখন সেটির পক্ষে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই তাঁর সমর্থন বা রায় দেন অর্থাৎ সেটি সফলতা লাভ করে। সর্বস্তরের জনগণের সেরকম ঐক্যশক্তি আমরা দেখেছি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, ছেষট্টির ছয়দফায়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং নব্বই’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। প্রকৃতপক্ষে সর্বস্তরের জনসাধারণের এ ধরনের নিরঙ্কুশ ঐক্যের জন্য কোনো জাতীয় ইস্যু দরকার। একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত যে কোনো স্থানীয় বা অ লভিত্তিক নির্বাচনে একজন প্রার্থীর পক্ষে সংশ্লিষ্ট এলাকার সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন দাবি করা অযৌক্তিক। তাই সত্যের খাতিরে প্রচারণায় সেরকম কিছু লেখা উচিত নয়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, তবে কী লেখা যেতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের জনগণ, প্রগতিশীল জনসাধারণ, সচেতন জনগণ, ধর্মপ্রাণ জনসাধারণ, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, গরিব—দুঃখী জনসাধারণ, মেহনতি জনগণ, তরুণ ভোটারবৃন্দ যা—ই লেখা হোকনা কেন; এতে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা খণ্ডিত হয়ে যায়, তার পক্ষে সমর্থন পরিপূর্ণতা পায় না। এরকম যে কোনো একপক্ষের নাম লিখলে অন্যান্য পক্ষের সমর্থন হারানোর আশঙ্কাই বেশি। তাহলে সার্বিক বিবেচনায় কী লেখা উচিত? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং তাঁদের চিন্তার খোরাক জোগানোর ইচ্ছে থেকেই আমার এই রচনার প্রয়াসÑ কোনো নির্বাচনী প্রার্থী, প্রচলিত নির্বাচনী আচরণবিধি, রাজনৈতিক দলমত বা শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দকে হেয় প্রতিপন্ন কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করার চতুর ও অসৎ উদ্দেশ্যে নয়। কেননা যোগ্য নেতৃবৃন্দের প্রতি আমি সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল। যেহেতু যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই আমার পেয়েছি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, পেয়েছি এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যোগ্য নেতৃত্বের গুণেই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কথিত ‘তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি’র অপবাদ ঘুচিয়ে আমরা উঠে এসেছি উন্নয়নের রোল মডেলে। যোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরেই আমাদেরকে বিনির্মাণ করতে হবে স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক: কবি ও গীতিকার।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.