মোহাম্মদ আলী, আমার বাবা আমার গর্ব

মোহাম্মদ আলী, আমার বাবা আমার গর্ব
॥ মোরশেদ মোহাম্মদ আলী ॥

একজন সন্তানের জীবনে বাবা হলেন বটবৃক্ষ স্বরূপ। যে বৃক্ষের শীতল ছায়ায় সন্তান কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই পরম মমতার পরশে বেড়ে উঠতে থাকে। বাবার শক্ত হাত যেমন সন্তানের সকল বাধা বিপত্তি কে দূরে ঠেলে দেয়, ঠিক তেমনি বাবা বুঁক পেতে সন্তানের জীবন আজীবন আগলে রাখে। ঠিক এমনটিই ছিলো আমাদের বাবা (আব্বা)। আজ আমাদের বাবার ১ম মৃত্যুবার্ষিকী। আব্বা ছিল একাধারে আমার গর্ব, আদর্শ, গাইড, শিক্ষক সর্বোপরি প্রেরণা ও সাহসের উৎস। পঁয়ত্রিশ বছর আগে মা আমার চলে গেছে চিরদিনের জন্যে আমাদের রেখে। মা'র সেই মমতার স্বাদও নেয়ার চেষ্টা করেছি আমাদের এই মধ্য বয়সে আব্বার কাছ থেকে।
১৯৩২ সালের ৩রা এপ্রিল কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আমার বাবা মোহাম্মদ আলী। বাঁকখালি নদীর পাড়ে নানাবাড়ী গোদার পাড়াতেই বাবার শৈশবের সূচনা। আমার পিতামহ বৃটিশ আমলে তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমার প্রখ্যাত আলেম মৌলানা মোহাব্বত আলী ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসা হতে কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ঐতিহ্যবাহী কক্সবাজার হাশেমিয়া আলিয়া মাদ্রাসা সহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিখ্যাত মাদ্রাসা গুলোতে দীর্ঘদিন শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। পিতামহী ফাতেমা খাতুন ছিলেন প্রখর ধর্মীয় জ্ঞান সম্পন্ন মহিয়সী নারী যিনি এ জনপদের কিংবদন্তি ইসলামিক স্কলার, তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা শহরের শিক্ষায় দীক্ষায় সমৃদ্ধ গোদার পাড়ার কৃতি সন্তান, গোল্ড মেডেলিস্ট মৌলানা মকবুল আহমেদের কন্যা।
কক্সবাজার পৌর শহরের টেকপাড়া প্রাইমারী স্কুল থেকে আমার বাবা প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ভর্তি হন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কক্সবাজার হাই স্কুলে এবং ১৯৫০ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে উনি ক্রীড়াঙ্গনেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে দুর্দান্ত ফুটবলার হিসেবে পুরো মহকুমা জুড়ে নামডাক ছিল তাঁর। ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের বছরেই মাধ্যমিক শেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম কমার্স কলেজ চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৫৬ সালে কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন (বি কম) সম্পন্ন করেন।

শিক্ষা জীবনের পাঠ চুকিয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা শেষে ১৯৫৮ সালে জয়েন করেন তৎকালীন বিখ্যাত বৃটিশ বার্মা অয়েল কোম্পানির (BOC) চট্টগ্রাম প্রধান কার্যালয়ে। কবছর পরেই নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে তৎসময়ে বহুজাতিক কোম্পানির লোভনীয় চাকুরী ছেড়ে আমদানী রপ্তানী ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যেই সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্সের পরিচালক হিসেবেও যথেষ্ট ভুমিকা রাখেন।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামীলীগের সভাপতি আবছার কামাল চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে চট্টগ্রাম নগর কেন্দ্রিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের সিনিয়র নেতাদের সাথে কক্সবাজার অঞ্চলে গণসংযোগে অংশ নেন এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রামের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর তত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভুমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর শেষের দিকে পাক বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে উনার পরিবারবর্গ সহ ভাগ্যক্রমে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের পরামর্শে উনি রাজনীতি থেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়ে প্রাকৃতিক প্রাচুর্য্যে ভরপুর অপার সম্ভাবনাময় কক্সবাজারের ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করবার কাজে মেধা মনন দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে গঠন করেন কক্সবাজার শিল্প ও বণিক সমিতি। কক্সবাজারের প্রথম বাণিজ্য সংগঠনটির কার্যালয় ছিল শহরের বাজারঘাটায়। ঐ সময়ে কক্সবাজারের ব্যবসায়ী করদাতাদের সুবিধার্থে কক্সবাজারে আঞ্চলিক কর অফিস স্থাপন, লবণ, চিংড়ী সহ ব্যবসায়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখেন। ১৯৮৪ সালে কক্সবাজার জেলা ঘোষিত হবার পর ১৯৮৫ সালে কক্সবাজার চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রী'র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ। চেম্বার সভাপতি হিসেবে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতাল, মেরিন ড্রাইভ রোড, গভীর সমুদ্র বন্দর, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে চেম্বারের দাবী নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ধারাবাহিক ভাবে জোরালো বার্তা প্রেরণ করেন যেগুলো এখন দৃশ্যমান। চেম্বারের সভাপতির দায়িত্বকালে তিনি সীমান্তে চোরাচালান রোধে অবৈধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হুমকি এবং বিভিন্ন বাঁধার মুখেও জোরালো ভূমিকা রাখেন। ২০০০ সালে চোরাচালান রোধ করে প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সাথে বৈধ ভাবে সম্ভাবনাময় সীমান্ত বাণিজ্যে ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করার জন্যে চেম্বার টিম নিয়ে বিপদ সংকুল নাফ নদী পাড়ি দিয়ে একাধিকবার মায়ানমারের রাখাইন ষ্টেট সফরে যান। পরবর্তীতে রাখাইন ষ্টেট চেম্বার অফ কমার্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিঃ উব্যু থিন এর আমন্ত্রণে ৬ সদস্যের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দল নিয়ে রাখাইন ষ্টেটের রাজধানী সিট্টুয়ে(আদি আকিয়াব) সফর করেন। দুই চেম্বারের যৌথ সভায় বাংলাদেশ-মায়ানমারের দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে সফল আলোচনা ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলশ্রুতিতে ২০০৩ সালে টেকনাফে কাষ্টম হাউজ সহ নৌবন্দর স্থাপন এবং সীমান্ত বাণিজ্য পুরোদমে চালু হয় যা এখনো চলমান। সভাপতির দায়িত্ব কালে কক্সবাজার চেম্বারের পক্ষ থেকে অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন,লবণ, চিংড়ি, শুঁটকি সহ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের বিকাশে ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বার্তা প্রেরণ করেন এবং সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কর্মকর্তাগণ কক্সবাজার সফর করে চেম্বারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মিলিত হন।
শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে একাধারে দুদশক সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ঈদগাহ ময়দান নিয়ে উনার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার কথা না বললেই নয়। ১৯৯২ সালে বৃটিশ আমলে নির্মিত এ জনপদের আরেক প্রাচীন স্থাপনা কক্সবাজার সদর হাসপাতাল পুনঃনির্মাণ ও বর্ধিত করণে লাগোয়া ঈদগাহ ময়দানের জমি বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য ১০০ শয্যা বিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতাল উন্নীতকরণে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রী'র তরফ থেকে জোরালো প্রস্তাবনা ছিল সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও ঈদগাহ কমিটির মধ্যে আলাপ আলোচনার পর জনস্বাস্থ্যের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ঈদগাহ কমিটি বিশেষ শর্তে ঐতিহ্যবাহী ময়দানের জমি সদর হাসপাতালের সাথে একিভূত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঈদগাহ কমিটির জোরালো শর্ত ছিল পুরাতন জেলখানার পরিত্যক্ত জমিতে ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ ময়দান পুনঃস্থাপন করার। অবশেষে ১৯৯৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ১০০ শয্যা বিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।১৯৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সদর হাসপাতালের পুনঃনির্মাণ কাজ শুরু হলে বেশ কবছর দুই ঈদের নামাজ পার্শ্ববর্তী সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সম্পন্ন করা হতো। এরি মধ্যে কিছু মহলের বাঁধার মুখেও উনার একাগ্র ভুমিকা, সবার সহযোগিতা ও উঁচু মহলে দেন দরবারের কারণে পরিত্যক্ত জেলখানার জমিতেই শর্ত মোতাবেক ঈদগাহ ময়দান পুনঃস্থাপন করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সেক্রেটারির দায়িত্বেও ছিলেন। কক্সবাজার কেন্দ্রীয় খানেকাহ্ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি, খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কক্সবাজার পোলট্রি এন্ড ডেইরী এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও অনেক সামাজিক-ব্যবসায়িক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আজীবন প্রিয় কক্সবাজারের উন্নয়নে নিজের মেধা দিয়ে নীরবে কাজ করে গেছেন নির্মোহ ও প্রচার বিমুখ মানুষটি।
১৯৬০ সালে আমার মা রাজিয়া বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উখিয়ার প্রখ্যাত জমিদার এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম শহরের নামজাদা ব্যবসায়ী শাকের আলী চৌধুরীর একমাত্র কন্যা ছিলেন আমার মা। ৭ জানুয়ারি, ১৯৮৯ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ  করেন মা আমার। কর্মজীবন এবং সংসারের হাল একা কাঁধে নিয়ে আমরা পাঁচ ভাই বোনদের উচ্চ শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন আমাদের গর্বিত প্রিয় বাবা। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভোগার পর ২০২৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ৯১ বছর বয়সে কক্সবাজারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আমার বাবা হাসপাতাল সড়কের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহান আল্লাহ্ যেন আমাদের বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নিশ্চিত করেন। বাবার জন্যে সবার কাছে দোয়া প্রার্থী।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.