রাজনীতি থেকে দুর্নীতি পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে

রাজনীতি থেকে দুর্নীতি পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে
দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় ২১ অক্টোবর ২০০৮ প্রথম পৃষ্টায় অতিথি কলামে ’রাজনীতি থেকে দুর্নীতি পৃথকীকরণ নিশ্চিত করুন’ শিরোনামে লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল। অমর একুশে বইমেলা ২০০৯ উপলক্ষে ঢাকার লেখাপ্রকাশ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থাকর্তৃক প্রকাশিত ’খোন্দকার মোস্তাকদের তালিকা চাই’ নামের বই এর ১১৩ পৃষ্টায় লেখাটি স্থান পেয়েছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে ১৩৭৯ বংগাব্দের ১৮ই কার্তিক মোতাবেক ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর তারিখে গৃহীত হয়ে একই বৎসর ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বলবৎ হয়। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন। অনেক বক্তৃতা বিবৃতি, অনেক গলাবাজী, অনেক ওয়াদা, অনেক ভন্ডামী, অনেক মামলা মোকদ্দমার পর রাজনীতিবিদদের বার বার ক্ষমতায় যাওয়ার পরও লজ্জাজনক ব্যর্থতার প্রেক্ষিত একটি অনির্বাচিত সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পহেলা নভেম্বর ২০০৭ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নব অধ্যায় রচিত হয়েছে। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ বাস্তবায়ন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকরী হয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে পথ চলা শুরু করেছে। তার প্রকৃত সুফল দেশের সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারবেন কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে। পরাধীন বৃটিশ আমল থেকে ক্ষমতাসীনরা কৌশলে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ ব্যবহার করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নিজেদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করতেন বলে অভিযোগ সব সময় ছিল। তাই শত বছরের দাবীর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সংবিধানে বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ থেকে পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার বিধান করা হয়েছিল। তখন রাজনীতি দুর্নীতির উর্ধ্বে ছিল। বর্তমানে রাজনীতির সাথে দুর্নীতি এমনভাবে মিশে গেছে যে যারা ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করেছেন তারাও অনেক সময় স্বাভাবিক রাজনৈতিক কাজের মত দুর্নীতি করেছেন যাতে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ ৫বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছে। অবশ্য দেশের ক্ষমতাসীনরা সব সময় তা অস্বীকার করেছেন। ক্ষমতাসীনরা তা স্বীকার করলে দেশবাসী আশাবাদী হত যে হয়তঃ ভবিষ্যতে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু তা অস্বীকার করার অর্থ হল যারা প্রকাশ্যে দুর্নীতি করেছেন তারা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে দুর্নীতিকে রাজনীতিই মনে করছেন। এতে আশংকা ভবিষ্যতে দুর্নীতির মাত্রা আরো বাড়বে। যারা দুর্নীতি করছেন তারা দুর্নীতিকে দুর্নীতিই মনে করেন না, এটা ক্যানসারের চেয়ে মারাত্মক রোগ। ওয়ান ইলেভেনের পরে দেশের মানুষ খুবই আশাবাদী হয়েছিল,হয়ত এবার দুর্নীতি কমবে। কিন্তু না দুর্নীতি এখনও আছে, ভবিষ্যতে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার আসলে তা আরো বাড়তে পারে। এখন অনেকে আশংকা করছেন যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাদেরকেই ভবিষ্যতে দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে দুর্নীতির মামলায় হাজতে যেতে হতে পারে। সম্প্রতি জেলা উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান লে, জেনারেল (অবঃ) হাসান মাশহুদ চৌধুরী বলেছেন, হুকুম দিয়ে দুর্নীতি কমবে না, তাবিজ করে বা অন্য কোন ঔষধ খাওয়ালে দুর্নীতি কমবে না। মাঠে নামতে হবে, বার বার মানুষের সাথে কথা বলতে হবে। কিছু দিন আগে তিনি বলেছেন, দেশ এখনও দুর্নীতির অভয়ারণ্য। কোটি কোটি মানুষের দুর্দশা আর দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে এই দুর্নীতি। মানুষসৃষ্ট এই দুর্যোগ দিনে দিনে দানবের রূপ ধারন করছে। কি কারণে এই ভয়াবহ দুরবস্থা তার কারণ অজানা নয়। একজন শিশুর পক্ষেও বোঝা সম্ভব দুর্নীতিতে দেশ ৫বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হওয়া কত লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু তা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের লজ্জিত করেছে বলে তাদের কথাবার্তায় মনে হয় না। আমাদের আমলে দুর্নীতি হয়েছে,আমাদের নেতা-কর্মীরা, আমলারা, মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেছে তা কোন নেতাই স্বীকার করেন না। তাহলে কি দেশকে দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান করতে জীনপরীরা এসে বাংলাদেশে দুর্নীতি করেছে? রাজনীতি থেকে দুর্নীতিকে পৃথকীকরণ স্পষ্ট না করলে দুর্নীতি কমানো কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়, বরং দেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি দিন দিন বেড়ে যাবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সরকারী দলের নেতা-কর্মী, এমপি, মন্ত্রীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করার সময় হলফনামায় তাদের সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছেন তা প্রতি দিন জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনসহ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়ও তা প্রচার হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে হলফনামায় প্রকাশিত সম্পত্তির চেয়ে তাদের প্রকৃত সম্পত্তির পরিমাণ আরো অনেক বেশী বলে দাবী করা হচ্ছে। সম্মানজনক কয়েকজন ব্যতীত সকল প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদর্শিত সম্পত্তির পরিমাণ আগের তুলনায় কয়েকগুণ থেকে কয়েক শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় সকল প্রার্থীর স্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ আরো বেশী বেড়েছে। সাবেক ও বর্তমান এমপি সাহেবরা, মন্ত্রী সাহেবরা রাজনীতি ছাড়া দুর্নীতি করেছেন মর্মে কেউ দাবী করেন নাই। তা হলে সম্পদের পরিমাণ এত বেশী বৃদ্ধি হল কিভাবে? এমপি হতে পারলে, মন্ত্রী হতে পারলে, ক্ষমতায় যেতে পারলে আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মত কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া যায়। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা ক্ষমতায় থাকার জন্য এত রক্তারক্তি, এত প্রাণহানি, দেশের এত সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। রাজনীতি থেকে দুর্নীতিকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট পৃথকীকরণ করা হলে রাজনীতিতে এসে ক্ষমতায় গিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার সুযোগ না থাকলে নির্বাচনের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করবেন না কেউ। পনের বছর আগে ২০০৮ সালে যে দাবী করা হয়েছিল এখন দেশের স্বার্থে ও প্রায় ১৮ কোটি জনগণের স্বার্থে রাজনীতি থেকে দুর্নীতিকে পৃথকীকরণ করার একই দাবী করা হচ্ছে। প্রায় ১৮ কোটি জনগণের মধ্যে যারা দুর্নীতি করেন তাদের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশী হবে না অর্থাৎ এক শতাংশ মানুষ সরাসরি দুর্নীতিতে লিপ্ত। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নিরানব্বই শতাংশ মানুষ। বিগত ১৫ বছরে দেশের অবকাঠামোগত দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশী হয়েছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণের কারণে মারাত্মক অবনতি হয়েছে সততা, নৈতিকতা, সত্যবাদিতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, প্রকৃত আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে। রাজনীতির মোড়কে অবাধ দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনীতি থেকে দুর্নীতির পৃথকীকরণ নিশ্চিত করতে হবে, এটা সময়ের দাবী।

আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.