মিয়ানমার ফেরত ৩ নারীসহ ১৭৩ : ‘দেশে ফেরাটাই নতুন জীবন’

মিয়ানমার ফেরত ৩ নারীসহ ১৭৩ : ‘দেশে ফেরাটাই নতুন জীবন’
# ফেরত আসাদের অধিকাংশই সাগরপথে মালয়েশিয়াগামি, রয়েছে জেলে ও অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমকারি
# ১৭২ জন ঘরে ফিরলেও একজনকে যেতে হচ্ছে কারাগারে
# বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয়রত মিয়ানমারের সেনা-বিজিপির ২৮৮ সদস্য ফিরছেন আজ

মিয়ানমারের কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ শেষে দেশে ফেরা ৩ নারীসহ ১৭৩ বাংলাদেশীর কাছেই এটা একটা নতুন জীবন। কারও দেড় বছর আবার কারও ৫ বছরের বেশি সময় কেটেছে মিয়ানমারের কারাগারে। যাদের বেশিভাগই দালালের প্রলোভনে উচ্চ জীবন বা চাকুরির প্রত্যাশায় অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই দালালরা ট্রলার যোগে তাদের নিয়ে গিয়ে ছিল মিয়ানমারে। আবার অনেকই মালয়েশিয়াকালে সাগর থেকে আটক হয়েছিলেন মিয়ানমার বাহিনীর হাতে। যাদের প্রতিজনের কাছেই রয়েছে দুর্বিসহ জীবন বাস্তবতার গল্প। ফেরত আসাদের মধ্যে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে রয়েছেন অনেকেই। যাদের সাগর থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর ৩ নারীসহ কয়েকজন রয়েছেন যারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেই আটক হন।
যে যেভাবে আটক হয়ে মিয়ানমারে কারাভোগ করেছে তাদের অধিকাংশই বলেছেন, দেশে ফেরাটাই নতুন জীবন। দেশে ফিরতে পারবে কি পারবে না এমন অনিশ্চিত জীবন কেটেছে তাদের।
মিয়ানমার থেকে ফেরত আসা এই ১৭৩ বাংলাদেশীকে নিয়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ছোট একটি জাহাজ (ডক জাহাজ) কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বাঁকখালী নদীর ঘাটে এসে পৌঁছেন বুধবার দুপুর ১ টা ২০ মিনিটে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিয়ানমার প্রতিরক্ষা বাহিনীর ‘নেভাল শিপ চিন ডুইন’ জাহাজ যোগে ১৭৩ বাংলাদেশীকে নিয়ে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপির কর্ণেল মিও থুরা নউংয়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার জলসীমায় অবস্থান নেন। যেখান থেকে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর একটি ছোট জাহাজ মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটিকে নিয়ে নুনিয়ারছড়া ঘাটটিতে পৌঁছেন বুধবার বেলা ১১ টার দিকে।
মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজার পৌঁছার পর পরই ঘাট থেকে গাড়ি যোগে রওয়ানা হয়েছেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়। যেখানে বিজিবির অধিনে রয়েছেন বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয়রত মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২৮৮ সদস্য। যে সদস্যদের গ্রহণ করে আজ বৃহস্পতিবার সকালে মিয়ানমার ফেরত যাবেন প্রতিনিধি দলটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, ১৭৩ জনের মধ্যে ১২৯ জন কক্সবাজার জেলার, ৩০ জন বান্দরবান জেলার, সাতজন রাঙ্গামাটি জেলার, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, নরসিংদী ও নীলফামারী জেলার একজন করে।
ঘরে ফিরেছেন ১৭২ জন,  কারাগারে একজন
ফেরত আনাদের ঘাটে পৌঁছার পর ঘাটে উপস্থিত স্বজনদের কাছে ফেরত আসাদের হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিজিবি, পুলিশ, প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া করতে দেখা গেছে। ১৭৩ জনের মধ্যে ১৭২ জনকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও মামলা থাকায় একজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে বিষয়টি নিয়ে উপস্থিত কোন কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেননি।
তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ফেরত আসাদের বিজিবি গ্রহণ করে পুলিশকে হস্তান্তর করেছে। তারপর যাচাই-বাছাই শেষে অনেককেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আবার আইনগত জটিলতার কারণে অনেককে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।
আইনগত জটিলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ফেরত আসাদের কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তাদের আদালতে মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। এখন বিষয়টি যাচাই-বাছাই চলছে। পরে বিস্তারিত জানা যাবে।
জাতীয় সংসদের হুইপ ও কক্সবাজার ৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, মিয়ানমারের কারাভোগ শেষে ১৭৩ বাংলাদেশী ফিরেছেন। সরকারের প্রচেষ্টায় এদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
 ফেরত আসা এবং স্বজনরা যা বলছেন :
ফেরত আসাদের মধ্যে রয়েছেন টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ জালিয়াপাড়া এলাকার মো. সাইফুল ও মো. ইসহাক নামের দুই ভাই। যাদের গ্রহণ করেছেন মা রেদওয়ান বেগম।
২০২২ সালের ১৫ মার্চ নাফনদীতে মাছ শিকারকালে বাংলাদেশি ১৮ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। পরে ১৮ জেলের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ৪ জনকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ৪ মাস পর বিজিবি কাছে হস্তান্তর করে মিয়ানমার। কিন্তু বাকি ১৪ জেলে এখনো মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি ছিলেন। সেই ১৪ জেলের মধ্যে সাইফুল ও ইসহাক সহ ১১ জন ফিরছেন ১৭৩ জনের সাথে। তবে এখনও ফিরতে পারেননি ৩ জন।
সাইফুল ও ইসহাক জানান, ২০২২ সালের ১৫ মার্চ নাফনদীতে ৪টি নৌকায় মাছ শিকারে যাওয়া ১৮  জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মিয়ানমারে বিজিপির একটি বিওপিতে আটকে রাখার পর মিয়ানমারের ১ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। কিন্তু টাকা না দেয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। পরে ৪ জনের বয়স কম হওয়ায় আদালত ছেড়ে দেয়ার জন্য বলে। ৪ জন ফিরলেও এতদিন ধরে কারাগারে ছিলেন ১৪ জন। ১৪ জনের ১১ জন ফিরলেও ৩ জন ফিরতে পারেননি। এই ৩ জন হলেন, সুলতান, মহিউদ্দিন ও রফিক। এই ৪ জন যাচাই-বাছাইকালে বাংলাদেশী নাগরিক বলা হয়নি তাই ফিরতে পারেন নি।
দুই জনের মা রেদওয়ান বেগম বলেন, দুই ছেলে পেয়ে যেন স্বর্গ ফিরে পেলাম।
ফেরত আসাদের মধ্যে ছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুর থানার বাসিন্দা হামজা (৩৫)। বাঁকখালীর জেটিঘাটে হামজাকে নিতে এসেছেন বড় ভাই মানিকুল ইসলাম ও আবু তালহা।
আবু তালহা জানান, পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট হামজা মানসিক ভারসাম্যহীন। পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে সে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। এর পর থেকে সে নিখোঁজ ছিল। কয়েক দিন আগে নীলফামারী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জানতে পারি ভাই হামজা মিয়ানমারে কারাগারে বন্দী ছিল। ফেরত আনা হচ্ছে কক্সবাজারে। ভাইকে ফেরত পাওয়া খুশি দুই ভাই।
যেখানে কথা হয়েছে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়েনের আয়ুব আলীর ছেলে নবী হোসেনের সাথে। তিনি জানান, ফেরত আসাদের মধ্যে তার ভাই জাগির হোসেন সহ এলাকার ৪ জন রয়েছে। পুলিশের পক্ষে জানানোর পর ঘাটে নিতে এসেছেন। গত দেড় বছর আগে পরিবারকে কিছু না বলেই নিখোঁজ হন তার ভাই। ১ মাস পরে জানতে পারেন দালালের প্রলোভনে সাগর পথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়েই মিয়ানমারের আটক হন তারা। দেড় বছর পর ভাই ফিরবেন এটাই খুশি।
মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুরের বদিউল আলম এসেছিলেন তার ছেলে জয়নাল আবেদীনকে নিতে। তার ছেলেও একই ভাবে দেড় বছর আগে মালয়েশিয়ায় যেতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। একই এলাকার ৫ জন রয়েছে বলে জানান তিনি।
ওখানে থাকা স্বজনদের বেশিভাই জানিয়েছেন অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় যাত্রা দিতে গিয়েই এসব মানুষ মিয়ানমারের আটক হয়েছিলেন।
মিয়ানমার সেনা-বিজিপির ২৮৮ জন ফিরছেন আজ:
মুলত এসব বাংলাদেশীদের নিয়ে আসা মিয়ানমারের জাহাজটি আজ বৃহস্পতিবার সকালেই বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয়রত মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২৮৮ সদস্যকে নিয়ে ফেরত যাবেন। মিয়ানমারের ২৮৮ সদস্যকে ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়ার জন্যই মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি নাইক্ষ্যংছড়ি গেছেন।
মিয়ানমারে ফেরত যাওয়াদের মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল একদিনে নতুন ২৪ জন, ১৬ এপ্রিল ৬৪ জন, ১৪ এপ্রিল ১৪ জন, গত ৩০ মার্চ ৩ জন ও ১ মার্চ ১৭৭ জন বিজিপি ও সেনা সদস্য পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এরও আগে ফেব্রæয়ারির শুরুতে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরও ৩৩০ জন। যাদের গত ১৫ ফেব্রæয়ারি ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। প্রথম দফায় ফেরতের সময় ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ এবং সংশ্লিষ্টরা কথা বলতেও এবার তা হচ্ছে না।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.