প্রথম জাতীয় দলের খেলোয়াড় দীপু চৌধুরীর ক্রিকেট অভিষেকের গল্প

প্রথম জাতীয় দলের খেলোয়াড় দীপু চৌধুরীর ক্রিকেট অভিষেকের গল্প
বিশেষ সাক্ষাৎকার

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নতুনের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন দীপু রায় চৌধুরী। তার হাতে গড়া আবাহনী লিমিটেড স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াশক্তি। সবাই তাকে চেনেন, জানেন আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল যে একজন ক্রিকেটার, মিডিয়াম পেস বোলার এবং দক্ষ সাংগঠনিক ক্ষমতার পাশাপাশি যে খেলোয়াড় চেনাতেও ছিলেন পাকা ‘জহুরি’, সে গল্প জানা আছে ক'জনার?
স্বাধীনতার পর ঢাকার ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনের অনেক মেধাবি ফুটবলার, ক্রিকেটার ও হকি খেলোয়াড় আবাহনীতে যোগ দিয়েছিলেন প্রয়াত শেখ কামালের মাধ্যমে। তাদেরই একজন ক্রিকেটার দিপু রায় চৌধুরী। যিনি ছিলেন ওয়ান্ডার্স ক্লাবে। ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমের শেষ দিকে শেখ কামালের হাত ধরেই শহীদ স্মৃতি টুর্নামেন্টের মাধ্যমে নাম লেখান আবাহনীতে।
বর্তমানে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট কোচিংয়ের অন্যতম সফল সিনিয়র কোচ ও নারী অনূর্ধ্ব ১৯ দলের প্রধান কোচ দিপু রায় চৌধুরী, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সব সময়ের অন্যতম সেরা পেস বোলার। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনার ক্রিকেট জীবনে পা দেওয়ার গল্পটা কীভাবে শুরু, কীভাবে সৃষ্টি  আজকের দীপু রায় এর? দৈনিক কক্সবাজার এর সঙ্গে কক্সবাজারের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আলাপকালে সে গল্পই শোনালেন দিপু রায় চৌধুরী।

দীপু রায় চৌধুরী বলেন, ‘আমি আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শেখ কামাল ভাইয়ের হাত ধরেই ধানমন্ডির আকাশী হলুদ শিবিরে প্রথম পা রাখি। তারও এক মজার কাহিনী আছে। তখন মৌসুম শুরু হতো নভেম্বর-ডিসেম্বরে। লিগের মাঝামাঝি ২১ ফেরব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ ও ভাষা দিবস উপলক্ষে একটি শহীদ স্মৃতি টুর্নামেন্ট হতো। সেই টুর্নামেন্টের নিয়ম ছিল, যে দল প্রথম পর্বে বাদ পড়ে যেত, সেই দলের ক্রিকেটারররা কোয়ার্টাার ফাইনাল পর্বে অন্য দলে খেলতে পারতেন। এর মধ্যে আমি গেলাম সিলেটে একটি ‘খ্যাপ’ (পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লিগ বা টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়া) খেলতে। ফেরার পর দেখি আমার দল ওয়ান্ডারার্স আউট অব দ্য টুর্নামেন্ট। তখন আমার অফার এলো ‘ইয়াং পেগাসাস’ থেকে। অফারটি করলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব ও কোচ জালাল ভাই (সাবেক জাতীয় প্রশিক্ষক, সাংবাদিক ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ)। তিনি বললেন, দিপু তুমি কি ইয়াং পেগাসাসের হয়ে খেলবে কোয়ার্টার ফাইনালে? বলে রাখা ভালো, ইয়াং পেগাসাস তখন চার-পাঁচ নম্বর দল ঢাকার ক্রিকেটে। ভালই দল ছিল। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। বললাম হ্যাঁ, আপনি বললে খেলব। না খেলার তো কোন কারণ নেই- এই বলে জালাল ভাইয়ের সাথে কথাবার্তা পাকা করে ফেললাম। কিন্তু জালাল ভাইকে কথা দেয়ার পর ঘটল অন্য এক ঘটনা। আমি তখন থাকি ধানমন্ডি ২১ নম্বরে। জালাল ভাইকে যেদিন ইয়াং পেগাসাসের হয়ে শহীদ স্মৃতি টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার কথা দিয়েছিলাম, ঠিক সেদিন বিকেলে হঠাৎ দেখি কামাল ভাই (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে প্রয়াত শেখ কামাল) ও সাথে আবাহনীর পেসার জিয়া, প্রয়াত তানভীর হায়দারের (সাবেক ক্রিকেটার, বোর্ডকর্তা, দেশবরেন্য ক্রীড়া সংগঠক) ছোট ভাই নাভেদ হায়দার আমার বাসায়।সত্যি বলতে কি, তার আগে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার কখনও সামনাসামনি কথা হয়নি। একদম কাছ থেকে দেখিওনি। তিনি এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, দিপু তুমি কি আবাহনীর হয়ে কাল শহীদ স্মৃতি ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটি খেলে দিতে পারবে? কারণ আমরা আছি পেসার সংকটে। জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহর (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার, তুখোড় ফুটবলার, আবাহনীর মূল দলের লেফট ব্যাক) কালকে ফুটবল ম্যাচ। তাই সে খেলতে পারবে না। আরেক পেসার জিয়ার বি এ পরীক্ষা। তাকেও পাওয়া যাবে না। আমাদের এখন পেসার সংকট। তুমি কি আামাদের টিমে খেলবে? 
সেই স্মৃতি রোমন্থন করে দীপু রায় চৌধুরী বলেন, 'বিশ্বাস করুন, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ছেলে, আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কামাল ভাইয়ের মতো ব্যক্তিত্ব আমাকে খেলার জন্য অনুরোধ করছেন। আমি কী করে না করি বলুন? আমি বললাম, খেলতে তো আপত্তি নেই কামাল ভাই। তবে আমি জালাল ভাইকে আগে কথা দিয়ে ফেলেছি। এখন আমি অন্য দলে খেললে তো কথার বরখেলাপ হয়ে যায়। তাই ভাবছি বিষয়টা কেমন দেখাবে, জালাল ভাই কী ভাববেন? তাকে কথা দিয়ে আবার অন্য দলে চলে গেলাম। কামাল ভাই ঠিক আগের মতই বিনয় নিয়ে খুব কোমল সুরে বললেন, আচ্ছা! কোন অসুবিধা নেই। তুমি কাল সকালে তৈরি থেকো। আমি তোমাকে বাসা থেকে মাঠে নিয়ে যাব। যদি জালাল তোমাকে আবাহনীতে খেলার অনুমতি দেয়, তাহলে খেলবে তো আবাহনীতে? আমি বললাম, ঠিক আছে। যথারীতি পরদিন সকাল বেলা কামাল ভাই তার নীল টয়োটাতে করে আমাকে ঠিক বাসা থেকে নিয়ে গেলেন মাঠে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বাইরে আউটার স্টেডিয়ামের তিন নম্বর মাঠে (বর্তমানে হকি স্টেডিয়াম) গিয়ে থামল কামাল ভাইয়ের গাড়ি। মাঠে গিয়ে দেখি জালাল ভাইয়ের ইয়াং পেগাসাসের সঙ্গেই আবাহনীর কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। কী বিড়ম্বনা বলুন? আরও মজার ব্যাপার হলো, কামাল ভাইয়ের গাড়িটি যেখানে গিয়ে থামল, ঠিক সেখানেই ইয়াং পেগাসাসের ক্রিকেটার, কোচ ও কর্মকর্তারা বসা ছিলেন। কামাল ভাই গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি গেলেন জালাল ভাইয়ের কাছে। গিয়ে বললেন, জালাল, দিপু চৌধুরী যদি আমার দলে খেলে, তাহলে কি তোমার কোন আপত্তি আছে? জালাল ভাই হেসে জানিয়ে দিলেন, না, না কোন আপত্তি নেই। সেই ম্যাচটিই আবাহনীর হয়ে আমার অভিষেক। ম্যাটিং উইকেটে খেলা হয়েছিল। আমি ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বোলিং করে ৮ উইকেট (২২ রান দিয়ে) শিকার করেছিলাম।’
দিপু চৌধুরীর মূল্যায়ন শেখ কামাল শুধু দেশবরেণ্য ক্রীড়া সংগঠক বা আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিই ছিলেন না, দক্ষ ক্রিকেটারও ছিলেন। তার ভাষায়, ‘কামাল ভাইয়ের সঙ্গে খেলারও সুযোগ হয়েছে আমার। আবাহনীর পুরো দল নিয়ে চট্টগ্রাম লিগ ফাইনাল খেলতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের আবেদিন কলোনী ক্লাবের হয়ে। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর পূর্বসুরিরা খেলতেন তখন ওই দলে। প্রতিপক্ষ ছিল চট্টগ্রামের ফেমাস স্টার ক্লাব। ওই ম্যাচে আমরা সবাই খেলেছিলাম। কামাল ভাই আর আমি বোলিং পার্টনার হিসেবে দুই প্রান্তে বলও করেছি। ম্যাচে কামাল ভাই আমাদের ছাপিয়ে দারুণ বল করে ৫ উইকেটের পতন ঘটিয়েছিলেন। তিনি দারুণ পেসার ছিলেন। ফাইনালে কামাল ভাইয়ের ম্যাচ উইনিং বোলিংয়ের প্রশংসা করে পরদিন চট্টগ্রামের নামি দৈনিক আজাদীতে খেলার পাতায় শিরোনাম এসেছিল, ‘শেখ কামালের সেরা বোলিং’। নান্নুর চাচারা সবাই খেলতেন তখন। সেলিম আবেদিন, সুলতান আবেদিন- প্রমুখ। তারাও জানেন। তারপর ৭৫’র ১৫ আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনা। ঘাতকদের ঘৃণ্য, বর্বরোচিত পৈশাচিকতার শিকার হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার। আমি এবং আবাহনী ক্লাব হারালাম আমাদের সবার প্রিয় কামাল ভাইকে। অতি অল্পসময়ে আমার খুব প্রিয় হয়ে ওঠা কামাল ভাইয়ের অমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়ানের পরও আমি আবাহনী ছাড়িনি।’
শেখ কামালের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আবাহনীতে থেকে যান বলে জানান দীপু রায় চৌধুরী। 
তিনি বলেন, একটানা ১০ বছর খেলেছি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। চার বছর অধিনায়কত্ব করেছি। সম্ভবত ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আমি অধিনায়ক ছিলাম। ঐ বছর আমরা লিগ শিরোপাও জিতি। আমি ক্রিকেটার অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হই। সর্বাধিক উইকেট শিকারি ছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে, আমি খুব সম্ভবত ৫০ উইকেট পেয়েছিলাম সেবার।’
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

খেলা

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.