গত ১৪ মে ”বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা- প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব” শীর্ষক এক আলোচনা সভা কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট সৈয়দ আলমের সভাপতিত্বে জেলা ও দায়রা জজের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মুন্্সী আব্দুল মজিদ প্রধান অতিথি ছিলেন। কক্সবাজারে কর্মরত প্রায় সকল বিচারক, সিনিয়র আইনজীবী, সরকারী আইন কর্মকর্তা, সাংবাদিক নেতা, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির আইন বিভাগের শিক্ষক, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, বিএনডবিউএলএ সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরী মর্মে সভায় বক্তরা অভিমত ব্যক্ত করেন। স্বাধীন বিচার বিভাগ ও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্তে প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ অনুযায়ী সভায় আলোচনার ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নিশাত সুলতানা। নতুন বিষয়বস্তুর ওপর প্রাণবন্ত আলোচনা সভায় প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে, অনেক স্পর্শকাতর প্রশ্ন সামনে এসেছে।
বহুল আলোচিত বাংলাদেশের ১৯৭২ এর সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন বলে উল্লেখ আছে। এত বছর পরেও স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই কেন? প্রতিষ্ঠার পথে কোথায় বাধা ছিল বা এখনও আছে? সচেতন নাগরিকদের অভিমত শাসকশ্রেণীর সদিচ্ছার অভাব। যারা লংকায় গিয়েছেন তারাই রাবণের মত আচরণ করেছেন। যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসেছেন তারাই ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য, বিরোধী মত দমন করার জন্য, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উপেক্ষা করার জন্য ব্যক্তি স্বার্থে বা দলীয় স্বার্থে আদালতকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট ছিলেন। পাকিস্তান আমল থেকে বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ওয়ারেন্ট ব্যতীত যে কোন নাগরিককে যখন তখন যত্রতত্র গ্রেপ্তার করার ক্ষমতাধারী ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা বাতিল করার দাবী করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই নেতারা ক্ষমতাসীন হয়ে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার নয়, বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে যে কোন নাগরিককে আটক করে রাখার জন্য বা ডিটেনশনে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা তৈরী করেছিলেন যা এখনও কার্যকর আছে। তবে ব্যাপক সমালোচনার মূখে প্রয়োগ কমেছে।
তাঁর অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে কিছু সংস্কার আনতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে তা দ্রুত দুর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার প্রথম পদক্ষেপ হবে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। তিনি আরো বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ সুপ্রীমকোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরী ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মজ্ঞুরীসহ শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধন আইনে বাকশাল করার সময় উল্লেখিত ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৮ সালের সামরিক শাসনের আমলে ২য় ঘোষণাপত্র মূলে সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, মর্মে সংযুক্ত করা হয়। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাচ্ছে বলে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও অধস্তন আদালত সমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার ক্ষমতা সম্পর্ণ ১১৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে মূল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতেই রেখে দেওয়া হয়, সামরিক শাসনের আমলে সংযুক্ত সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামশক্রমে বিধান বহাল রেখে।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, হাইকোর্ট বিভাগের অধঃস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে। এই অনুচ্ছেদটি ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল, এখনও বহাল আছে। কোন সময় কোন শাসক শ্রেণী এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করেছিলেন মর্মে প্রতীয়মান হয় না।
অদ্যাবধি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পনের বার সংশোধিত হয়েছে। তার মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধন আইন সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বেআইনী ও অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে। সংবিধানের অষ্টম সংশোধন আইন, ১৯৮৮ এর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাজধানীর বাইরে হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী গণ্যে উহাও আদালত কর্তৃক বেআইনী ঘোষিত হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীটিও সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের মূল নীতির পরিপন্থী, চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে একদলীয় বাকশাল গঠনের মত পঞ্চদশ সংশোধনীও সব কিছু আওয়ামী লীগকরণ করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকার ষড়যন্ত্রের দলিল উল্লেখ করে বাতিল করতে পারেন। বর্তমানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ, কর্মস্থল নির্ধারণ,পদোন্নতি দান ও ছুটি মজ্ঞুরীসহ শৃঙ্খলা বিধান করার কাজগুলো প্রভাবমুক্ত ও সুন্দরভাবে পালন করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি পৃথক সচিবালয় একান্ত প্রয়োজন মর্মে রাষ্ট্রপতি বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দিতে পারেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি সাহাবউদ্দিন চুপ্পু একজন সাবেক বিচারক ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নেতা ছিলেন বিধায় তাকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝানো হলে তিনি সহজেই কাজটি করবেন বলে আইনজীবী সমাজ তথা আমজনতা মনে করেন। আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা উচিত। অতীত অভিজ্ঞতা পরামর্শ দেয় রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতাসীন হওয়ার আগেই তা করা নিরাপদ ও উত্তম হবে। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে রাজনৈতিক নেতারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে উচ্চকন্ঠে বক্তৃতা বিবৃতি দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে কেউ কথা রাখেন নাই, ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয়।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।