এটা মর্যাদার লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই, অধিকার আদায়ের লড়াই
"অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন—নারী ও কন্যার উন্নয়ন" এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আমরা ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করছি। এটি শুধুমাত্র একটি উদযাপনের দিন নয়, বরং নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে নতুনভাবে ভাবার এবং সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আনার শপথ নেওয়ার দিন।
বাংলাদেশে নারীদের উন্নয়ন, সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এখনও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া একটি সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। যদিও বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রশাসনসহ নানান ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন, তবুও এখনো নারীরা প্রতিনিয়ত সহিংসতা, বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন।
নারী দিবসের ঠিক আগের দিনই মাগুরায় আট বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। নারী দিবসের দিনেই চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাওয়া এক কলেজছাত্রী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার খবর দেখতে পাই।
দলবদ্ধ ধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি—এ সবকিছুই যেন নারীদের জীবনের নিত্যদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি শিশুরাও এই ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অন্তত ১১,৭৫৮ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৬,৩০৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে ৫৫ শতাংশেরও বেশি, অর্থাৎ ৩,৪৭১ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে।
এছাড়া, এই সময়কালে ১,০৮৯ জন নারী ও শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ২০৭ জনকে যৌন সহিংসতার পর হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। শুধু ধর্ষণই নয়, নারীদের প্রতি সহিংসতার মাত্রা আরও ব্যাপক। যৌন হয়রানি, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা ও অ্যাসিড হামলার ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে।
২০২৫ সালেও এই পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। বছরের প্রথম দুই মাসেই ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১০৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এবং তাদের মধ্যে ৬৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৭ জন নারী ও শিশু। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী এবং পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮ জন, যাদের মধ্যে ২০ জন আত্মহত্যা করেছেন।
এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যা নয়, এটি আমাদের সমাজের এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচিত্র। নারীরা এখনো নিজেদের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। মানব সভ্যতার এত অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীরা এখনও টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত। তারা লড়ছেন, মর্যাদার লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই, অধিকার আদায়ের লড়াই।
তবে আমরা আশাবাদী। আমরা জানি, একজন শিক্ষিত ও সচেতন নারী কেবল নিজের জীবন নয়, বরং পুরো পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেন। নারীর ক্ষমতায়ন মানে শুধু নারী উন্নয়ন নয়, এটি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের অন্যতম ভিত্তি। তাই নারীর উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি, সহিংসতা প্রতিরোধ, স্বাবলম্বী করে তোলা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা—এসব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন কেবল কোনো একক সংগঠনের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। এই উন্নয়ন কার্যক্রমকে সফল করতে হলে দাতা সংস্থাসহ সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) দীর্ঘদিন ধরে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং আগামীতেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, যখন একজন নারী এগিয়ে যায়, তখন পুরো সমাজ এগিয়ে যায়। নারীর প্রতি সকল বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে নারীর সমতা ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য শপথ নিই। নারীদের উন্নয়ন মানেই একটি শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই নারী দিবসে, আমরা একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করি—নারী ও কন্যার ক্ষমতায়ন এবং সমতার জন্য কাজ চালিয়ে যাবো।
লেখক-
চেয়ারপারসন
সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)।