কারাগারে ৬১ জন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী

কারাগারে ৬১ জন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী
গত ৬ এপ্রিল সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এবং ৭ এপ্রিল দেশের প্রায় সকল সংবাদপত্রে বিভিন্ন শিরোনাম দিয়ে এক সাথে ৬১ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করা আইনজীবীর জামিনাবেদন নামজ্ঞুর করে কারাগারে প্রেরণ করার সচিত্র সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ সংবাদে সাধারণ বিবেকবান আইনজীবীরা মর্মাহত হয়েছেন এবং মানসম্মান নিয়ে ভবিষ্যতে আইন পেশায় নিরাপদে থাকতে পারবেন কিনা সন্দেহ প্রকাশ করছেন।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে হামলা, ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগপন্থী ৬১ আইনজীবীর জামিনের দরখাস্ত নামজ্ঞুর করে তাদের কারাগারে প্রেরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন গত ৬ এপ্রিল ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। একই সাথে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে ১জন আসামী-আইনজীবীকে বয়স বিবেচনায় ও ১০জন আসামী-আইনজীবীকে মহিলা বিবেচনায় জামিন মজ্ঞুর করেছেন বিজ্ঞ আদালত। আওয়ামী লীগপন্থী এই সব আইনজীবীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ওপর হামলা করেছিলেন, চেম্বার ভাঙচুর করেছিলেন। আদালতের আদেশে সংশ্লিষ্ট পিপি ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সন্তুষ্ট হয়েছেন মর্মে জানিয়েছেন। কারাগারে যাওয়ার আদেশপ্রাপ্ত আইনজীবীদের মধ্যে ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিভিন্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনেলের সাবেক পিপিসহ গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী নেতারা আছেন। জানা গেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট ২০২৪ আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীদের ওপর হামলা, চেম্বার ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আওয়ামী লীগপন্থী ১৪৪ জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে ৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা করেন আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী বাবু। এ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ৮ সপ্তাহের জন্য  অর্ন্তবর্তীকালীন গ্রেপ্তারপূর্ব জামিন নিয়েছিলেন ১১৫জন আইনজীবী। হাইকোর্টের প্রদত্ত জামিনের মেয়াদ ৭ এপ্রিল তারিখ শেষ হতো বিধায় আগের দিন হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী মেট্রোপলিটন দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে আবার জামিনের আবেদন করলে উল্লেখিত আদেশ হয়।
দেশের আইনজীবী সমাজের জন্য আরো একটি লজ্জাজনক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গত ১১ এপ্রিলের একাধিক সংবাদপত্রে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আগামী ১৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন উপলক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও দাখিলের নির্ধারিত তারিখে আওয়ামী লীগপন্থী ও তাদের সমমনা সহযোগী আইনজীবীদের মনোয়নপত্র সংগ্রহে বহিরাগতদের সহায়তায় বাধা দেওয়া হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই সংবাদে দেশের হাজার হাজার দল নিরপেক্ষ, বিবেকবান, মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী আইনজীবীরা চরম হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
 কতিপয় রাজনৈতিক দল-অন্ধ, বেপরোয়া ও সুযোগ সন্ধানী আইনজীবীদের ব্যক্তিস্বার্থে ও দলীয়স্বার্থে বৃহত্তর আইনজীবী সমাজের  ঐক্যের বুকে ছুরিকাঘাতকের শুরু কিভাবে, কখন হয়েছে এবং তার প্রতিকার কি আছে তা নিয়ে দলনিরপেক্ষ বিবেকবান স্বাধীন আইনজীবীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন। আমি গত ৪৬ বছর ধরে আইন পেশায় নিয়োজিত আছি। ১৯৮৮ সালে কক্সবাজার জেলার দ্বিতীয় পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। সব ঘটনা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সততার সাথে বিচার বিশ্লেষন করার চেষ্টা করি এবং ১৯৯১ সাল থেকে দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় অতিথি কলামে লিখে আসছি। আমি কলামে মিথ্যা লিখেছি মর্মে আজ পর্যন্ত কেউ সম্পাদকের কাছে প্রতিবাদলিপি দেন নাই। লেখার কারণে অসন্তোষ্ট হয়ে কতিপয় অতি অহংকারী আওয়ামী লীগপন্থী অযোগ্য দুর্নীতিবান্ধব আইন কর্মকর্তা আমার ফাঁসি দাবী করে মিছিল মিটিং করলেও কেউ আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন নাই। আমি ১৯৯১ সালে কক্সবাজার জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর থাকা কালে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হই। এই উপমহাদেশে আইনজীবীরাই অধিক রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে রাজনীতি করেছেন, দলের নেতা  হয়েছেন, দেশের মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু আইনজীবী সমিতিতে বা আদালতে কোন সময় রাজনীতি আনেন নাই। রাজনীতির কারণে আইনজীবীরা নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেন নাই। বরং এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সুপ্রীমকোর্ট বারের সভাপতি এডভোকেট শামশুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতের আইনজীবী নেতারা একতাবদ্ধ হয়ে লাগাতার সাত বছর (১৯৮৩-১৯৮৯ তিনি সুপ্রীমকোর্ট বারের সভাপতি ছিলেন) আন্দোলন করেছেন। আইনজীবীদের মধ্যে প্রথম রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯১ সাল থেকে। প্রথম শুরু হয়েছিল জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম দিয়ে। আমি লিখিতভাবে কলাম লেখে দলীয়করণের বিরোধিতা করেছিলাম। ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলাম। পরে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরাও আওয়ামী লীগ আইনজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ইত্যাদি নামে দিয়ে রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ শুরু করেছিলেন। পরে জামাতপন্থীরাও এ প্রতিযোগিতায় শরীক হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আমলে রাজনীতিকরণের ষোলকলা পূর্ণ করেছিল। আইনজীবী সমিতি থেকে শুরু করে সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত দলীয়করণ করা হয়েছিল। তার কারণে ফ্যাসিষ্ট সরকার পতনের পর সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের প্রায় সকল বিচারপতি পদত্যাগ করেন, যা এ দেশের ইতিহাসে ও বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে দলীয়করণ শুরু হয়েছিল বিএনপির আমলে। আইনাংগন দলীয়করণের কারণে বেগম খালেদা জিয়া, তাঁর পুত্র তারেক জিয়া ও অন্যান্য বিএনপি নেতাদের মত আইনী নির্যাতন ভোগ করে ন্যায় বিচার বঞ্চিত এ দেশের ইতিহাসে কেউ হন নাই।
সমালোচকরা বলেন যে আইনজীবীরা আইনাংগনে রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণে শরীক  হয়েছেন তারা তাদের বিবেক, মস্তক দলের কাছে, দলীয় প্রধানের কাছে বন্ধক দিয়েছেন। দলীয় প্রধান বা দলীয় নেতারা যা বলবেন তা দলীয়করণকৃত আইনজীবীরা সমর্থন করেন, বলবেন বা বলতে বাধ্য। তারা স্বাধীনভাবে বিবেক, মস্তক ব্যবহার করতে পারেন না। তাই সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির নিয়ন্ত্রিত, পাতানো নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় বিএনপিপন্থী সিনিয়র আইনজীবীদের জামিন না দিয়ে হাজতে প্রেরণ করলে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা খুশী হয়েছিলেন, সন্তোষ্ট হয়েছিলেন। এখন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের জামিন নামজ্ঞুর করে কারাগারে প্রেরণ করার আদেশ দিলে বিএনপিপন্থীরা খুশী হন, সন্তোষ্ট হন। উভয়ক্ষেত্রে দেশের বিবেকবান সাধারণ দলনিরপেক্ষ আইনজীবীরা হতাশ হন, মর্মাহত হন, অসন্তোষ্ট হন। ফ্যাসিস্টমুক্ত স্বাধীন দেশে নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আইনাংগনকে সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত ও সকল ধরনের প্রভাবমুক্ত করা উচিত।  
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার আছে। তবে শর্ত আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে এমন সমিতি করা যাবে না। আইনজীবীদের মধ্যে রাজনীতিকরণ হওয়ার পর থেকে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ হয় বলে প্রচার আছে, যা দলীয়করণ, রাজনীতিকরণ হওয়ার আগে কখনও শুনা যায় নাই। রাজনীতিকরণ হওয়ার আগে অযোগ্য ব্যক্তি বিচারপতি, আইন উপদেষ্টা, আইন কর্মকর্তা, জিপি, পিপি, আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কথা শুনা যায় নাই। অপরাজনীতি ও আইনাংগনকে রাজনীতিকরণের কারণেই সব কিছু অধিক দুর্নীতিগ্রস্থ হচ্ছে, অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে, তা মৃত্যুর মত সত্য। অবিলম্বে রাজনীতিকরণকৃত অর্থাৎ আইনজীবী সমিতি ছাড়া রাজনৈতিক দলের লেজুর হিসাবে কোন সমিতি বা সংঘ বা ফোরাম আইনাংগনে গঠন করা সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী ঘোষণা করে অধ্যাদেশ জারী করা হউক ।

আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.