লাশ

লাশ
খালেদা বেগম জ্যোৎস্না :

সিঁড়িতে পা দেওয়ার সাথে সাথে বাসার খালাটা একগাল পান মুখে দিয়ে গচর গচর করতে বলতে থাকলো ম্যাইয়াগো এতোদিন যদি লাশ বাসার সামনে গাড়ীতে থাকে, ক্যামনে ঘুমাই, ডর লাগে। ম্যাইয়াগো কিছু করো নাইলে দ্যাশে যামু। কর্তা জানালো বেস্টন সাহেব মারা গেছেন, মেয়ে বিদেশ থেকে আসবে তাই ফ্রিজার ভ্যানে ওনার লাশ। বুঝতে পারলাম খালাজানের ভয়ের কারণ। ভদ্রলোক খুব ভালো ছিলেন, চমৎকার ব্যবহার করতেন সবার সাথে, দেশ বিদেশী গাছে বাগান সাজিয়েছেন। আমেরিকায় থাকতেন, সে স্টাইলে বাড়ী করেছেন। আজ লাশ হয়ে পড়ে আছেন, মেয়ে আসবে, তারপর সৎকার হবে। আজকাল লাশ বেশ কিছুদিন রাখা যায়, গন্ধ বের না হওয়ার হরেক রকম ঔষুধ বের হয়েছে ।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভাগ্যিস জীবন্ত লাশ থেকে  গন্ধ বেরোয়না, যদি গন্ধ বের হতো তাহলে আমাদের চলাফেরা কষ্ঠকর হতো। আমরা যারা টিকে আছি, বেঁচে আছি বল্লে নিজেকে ঠকানো হবে, কারণ বেঁচে থাকার যে সব আনুসাংগিকতার প্রয়োজন, তার কতটুকু কতজনে পান। যারা পাচ্ছেন তারা সৌভগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছেন। বেশীর ভাগ আমার মতো সাধারন যারা, তারা বেঁচে থাকার সব কিছু সময়মতো পায় না। কিন্তু কোন না কোন ভাবে বেঁচে থাকে। এই বেঁচে থাকা জীবন লাশের মতো নয় কি! 
লাশ নিয়ে অনেক কবিতা, গল্প আছে, যা অনেকেই পড়েছেন, তবে মন ছুঁয়ে যায় রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহরগুলো। জীবন্ত মানুষের তো বিবেক থাকে, বিবেকের সাড়া থাকে, যা থেকে প্রনোদিত হয়। জানি না আমাদের বিবেক আছে কি না, যা আছে লোক দেখানো, নিজের স্ট্যাটাস বাড়ানো। আমরা বিবেক শুণ্য, কারণ বিবেক যাত্রা পালায় থাকতো , যাত্রাপালা তো নেই , সাথে বিবেক।  আর যারা বিবেক শুন্য  তারা  নিজেকেই প্রশ্ন করুন!

আমরাইতো ভেজাল খাবার, ঔষুধ ,ভুল চিকিৎসা, পীঠস্তানে মান সম্মত শিক্ষা না দিয়ে আরো কত কিছু করি। অনেকক্ষেত্রে পরিদর্শন করেন, যদি সঠিক হতো এসবের মাত্রা কমতো কি? এখানটায় প্রশ্ন যারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে, পরিদর্শনের নামে তামশা করে, তাঁদের কি বিবেক আছে! আর যদি না থাকে, তারা কি মানুষ, আর বিবেক শুন্য মানুষ কি জীবন্ত লাশ না! ভিন্ন মত থাকতেই পারে, জাতির কাছে না নিজের কাছে জবাব চান।
আমাদের আশেপাশে এখন দেখা যায় হটাৎ বড় লোক হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, প্রচুর বড় বড় অট্টালিকা। সৎ পথে সারা জীবন উপার্জন করে অনেকে যেখানে একটা জমি বা বাড়ী করতে পারে না। প্রশ্ন জাগে কি ভাবে এনারা করছেন? কথায় বলে পুকুরে ছোট মাছ না খেলে বড় মাছ বাচঁতে পারে না। তার মানে জলে না স্থলেও ছোটকে মাছের মতো না খেয়ে অন্য ভাবে বড়লোক হয়েছে, হয়ত সবাই না। যার মাপকাটি দৌলত। মানবিকতা যদি নাইই থাকে, হয়ত উনারা মানুষ কিন্তু অমানবিক আচরণ করেন, যা এ ধরনের অসুস্থতা, আর এ সব অসুস্থ মানুষদের নিয়ে সুস্থ সমাজ কি হয়! মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষদের সংজ্ঞা সমাজ বিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন, সাধারন চোখে যাদের ভিতরে মানবিকতা মরে গেছে, এদের কি বলবেন!
জানা মতে, কক্সবাজারে ফুলের দোকান ছিল না, কিন্তু বাজারে ফুল বিক্রি হতো, তেমনি ফলের দোকান ছিল একটি, কমলা সওদাগরের দোকান বলে খ্যাত ছিল। এখন তো মোড়ে মোড়ে ফলের দোকান, আর যে কমলাটার পাতা পর্যন্ত সবুজ থেকে যায় অনেক দিন, তা কি খাওয়ার যোগ্য, আমরা কিন্তু কিনি এবং খাই। আমার চারপাশে অনেক ফলের দোকান, কিন্তু ফলগুলো পঁচে না, লোভ লাগে। উপায় নাই সেলুকাস!! এসব দোকানের মালিকদের কি নামে ডাকবেন!! কোন একটা শো তে দেখেছিলাম, নিজেদের জন্য এবং বিক্রির জন্য আলাদা ফলের বাগান। আহা কি সৌভাগ্য।
জীবনে যে কোন বয়সে প্রেম করেননি, এরকম বাঙালি হাতে গোনা দু চার টা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যে প্রেম শুধু ভোগ, লালসা, টাকা, সম্পদের জন্য কি তা কি প্রেম, না জেনে বুঝে ঠকানো। যে ঠকাচ্ছেন তার কি বোধ আছে, আর বোধহীন মানুষ কি ঠকবাজ, লোভী, নীতিহীন নন! এই সব মানুষকে এড়িয়ে যেতে পারা যায় না, তার ছলচাতুরির জন্য। সেই ঠকবাজ মানুষটা কি শান্তি পান! আর এ সব ঠকবাজদের আমরা শয়তান, অমানুষ বলি, যার ভিন্ন নাম জীবন-এদের জন্যই পয়েটিক জাস্টিস ।
কোন সময় কি মনে হয় বড় কোন অনুষ্ঠানর গেছেন, হঠাৎ নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হয়, মনে হয় আশেপাশে কেউ নেই। ভেবেছেন কেন মনে হয়, কারণ আপনি যাকে খুঁজছেন সে মানসিকতার কেউ নেই! অর্থাথ আপনার জীবনে এমন কেউ নেই যাকে আপনি একান্তে নিয়ে গিয়ে মনের কথা বলতে পারেন। আমরা কিন্তু অনুষ্ঠানে থাকি, হাসি, ঠাট্টা করি জোকারের মতো, পরে মনে হয় একটা চলন্ত লাশ, কিছুক্ষণ অভিনয় করে আসলাম।
সময়, পরিবেশ, পরিস্তিতি মানুষকে অনেক শিক্ষা দেয় যা মানুষকে কোমল, কঠিন ব্যবহার করতে বাধ্য করে। ধরেন বাড়ীতে অল্প বয়স্কা বিধবা আছে, কেউ বলে ভাগ্যহীনা, তার মুখ দেখা অকল্যান, ভাত কাপড় ঠিক মতো পাচ্ছে। আজকাল আধুনিক মনস্কদের মাঝে এসব নেই, প্রত্যস্ত গ্রামে এ ছবি দেখবেন। আর ঐ বিধবার যদি ছোট সন্তান থাকে বড়ই বিপদ, দ্বিতীয় বিয়ের কথা তোলা মহাপাপ। বেচারি ঘরের এক কোনায় ঠাঁই হয়তো পেয়েছে। এ ভাবে বেঁচে থাকাটা সতীদাহের চেয়ে কষ্ঠকর। এ যেন একটা অবয়ব নিয়ে চলাফেরা করা ছায়াহীন মানব। কথা বলে দেখেন, সে এ জীবন চায় না, বলবে এর চেয়ে মরে গেলে ভাল হতো। আমার আপনার চারপাশে আছে, শুধু অর্ন্তদৃস্টি দিয়ে দেখি না, অনুভব করি না। সে কি আসলেই মানুষ না !!!!
বাড়ীতে বেকার সন্তান, অণুঢ়া মেয়ে আছে, তার সাথে মানবিক ব্যবহার তো দুরের কথা, দুর দুর ছেই ছেই করি। আরে বাবা চাকরি পাচেছ না যোগ্যতা থাকা সত্বেও এতে তার দোষ কোথায়, বিয়ে হচেছ না, এতে দোষ কোথায়? কিন্তু আমরা যে আচরণ করি এক সময় সে বা তারা নিজেদের মানুষ ভাবে না। তো----।
একবার দেখি আমার বোনের বাসায় যাওয়ার পথে দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ী, নীচে অনেক টাকা পড়ে আছে, কেউ দেখছে কেউ কুড়াচেছ। কাহিনী কি জানতে চাওয়াতে যা জানলাম তা হলো ঐ বাড়ির বৃদ্ধ মালিক তার স্ত্রী সহ থাকেন, তারাঁ নীচে নামতে পারেন না। দারোয়ানকে দান খয়রাতের টাকা দিলে নিজে নিয়ে নেয়, অগত্যা উনারা উপর থেকে টাকা ফেলে দেন যাতে যাদের প্রয়োজন তারা কুড়িয়ে নিতে পারে, তার আগে মিস্ত্রির মাধ্যমে প্রতিদিন কত টাকা দেওয়া হবে এ খবরটা জানিয়ে দেন।মালিকের ছয়জন ছেলেমেয়ে আছেন, কেউ আমেরিকা, কেউ ইয়োরোপ, কেউ অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। ভিডিও কলে প্রায় মা বাবার খবর নেন, মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। কিন্তু মা বাবাকে কেউ নিয়ে যেতে রাজি নন। এমনটা দিনদিন বাড়ছে। আমার এক বান্ধবী কথা বলার লোক পায় না দেখে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার পাঁয়তারা করেছিলো। এদের অনেকে ঘুমের বড়ি খেয়ে নি:সাড় হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে বা কেউ মারা যান। কখনও কখনও দু তিন দিন পর হয় দুধওয়ালা নয় পেপারওয়ালা খবর দেয় মৃত ব্যক্তির। এমন ঘটনা আছে , মরে পড়ে আছে, বডি ডিকম্পোজড হয়ে গেছে, শরীরের গেঞ্জিটাও, খুলতে পারে নি, ঐ অবস্থায় দাফন করতে হয়েছে। আর যারা বেঁচে আছেন তারা মানুষ না প্রাণধারী লাশ!
আমার জীবনের বিশাল একটা অংশ জুড়ে আছে চাকরি (কোন না কোন ভাবেই এ প্রসংগটা আসে)। যা বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সংস্থার কাজ করার অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন চরিত্রের সাথে সে উপকারভোগী ,সহকর্মী বা উর্ধ্বস্তন হউক। কাউকে দেখেছি, ঠিক সময় আসছে, যাচেছ কাজের কাজ কিছুই না। জানা গেল বসের কথা শুনতে শুনতে সে এমন হয়ে পড়েছে। এ যেমন শরীরের কোন একটা অংশে বারংবার আঘাত করলে ঐ অংশটার কোন অণুভুতি থাকে না, মানুষের ইন্দ্রিয় কিন্তু তেমনই। যে এ সময় সবার আগে দৌঁড়াতো সে কোন কাজ হোক না কেন, সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত, সে এখন নির্জীব, প্রাণহীন। একজনের কথা বলি নিপাতন, সে সবাইকে চা দিত, কিন্তু আমার পাশের সহকর্মীর কাছে চা নিয়ে যাওয়ার সময় হয় কাপ পড়ে যেত নয় সে পড়ে যেত। পরে জানলাম ঐ সহকর্মী সব সময় নিপাতনের দোষ খুঁজে বেড়াত, যার ফলে বেচারার এ হাল। অন্যদের সে ভালোবেসে চা পরিবেশন করতো আর উনার বেলায় প্রাণহীন ধড়টা মনে হয় যায়। কথায় বলে কথায় বাচাঁয় আবার কথায় মারে। এ মারা প্রাণে মারা না  আত্বাকে মারা। অনেক সময় দেখেছি পি সির প্রিয়ভাজন কেউ প্রমোশন পেয়েছেন, তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছুই নেই, কিন্তু তার ব্যবহার, আচরণ নিয়ে মন কষাকষি লেগেই থাকতো, দেখেছি মিরাজ ভাই আর শাহেদের মধ্যে, কথায় কথায় কে কাকে ছোট করবে তার প্রতিযোগিতা, যা আমরা দেখতাম চুপচাপ, কারণ চাকরিই তো করি! দেখতাম  পি সি আসার খবর পেলে  পিডিও সাহেব ছুটিতে। এ অসম প্রতিযোগিতায় দুজনই বিপর্যস্ত, কেউ মেকি দাপৎ আর কেউ নীরব। কেউ প্রানবন্থ অবস্থায় থাকতো না। শুধু মাত্র ব্যক্তিগত অহংবোধের কারণে, যদিও এই অহংবোধ সর্বনাশা। তবূও এটা আমাদের মজ্জাগত। তবে আত্বসম্মানবোধ থাকা আবশ্যক। এই যে কিছু চরিত্রে কথা উল্লেখ করলাম, ভাবুন তো, এনারা কি ?? 
শুনেছি জোনাকি না কি হদীসবিহীন লাশ খুঁজতে পথ দেখায়, মাছি পচাঁ, মরা জিনিসের উপর ভনভন করে। কেন প্রসংগ! আমাদের গায়েও মাছি বসে তখন ভাবি আমরা কি???
এযেন ছোট গল্পের মতো কত লিখবেন, কার কার কথা লিখবেন, কিশোর কিশোরীদের, যুবক যুবতিদের, দাম্পত্য জীবনের, মধ্য বয়স্কদের, বৃদ্ধদের, আঁতেলদের, প্রবাসীদের, ফুটপাতবাসীদের যা শেষ করা যাবে না। থাকুক না কিছু প্রশ্ন! কিছু কৌতুহল!
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.