রাখাইনে ‘আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট’

রাখাইনে ‘আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট’
# বিদেশী বিনিয়োগের আহবান
# ভারতের প্রকল্প ও বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণের দাবি
# নাফনদীর ওপারে যুদ্ধ জাহাজ, বিস্ফোরণের শব্দও ভেসে আসছে
# রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশংকায় সর্তক বিজিবি

মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধে রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এ পরিস্থিতিতে সার্বিক বিবেচনায় রাখাইন রাজ্য (আরাকান রাজ্য) পরিচালনায় ‘আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট’ গঠন করেছে বলে দাবি করেছে আরাকান আর্মি।
আরাকান আর্মির দাবি, আরাকান রাজ্যে ভারতের মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং ওই প্রকল্পের কাজ এখন স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া রাখাইন-বাংলাদেশ সীমান্তের বাণিজ্যও তাদের নিয়ন্ত্রণে এখন। ফলে বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত বাণিজ্য পরিচালনায় আর কোন বাঁধা নেই।
পরিস্থিতির উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগকারিদের প্রতি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রন জানিয়েছে আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট। গত ২৬ মার্চ প্রেরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে বিদেশি বিনিয়োগকারিদের প্রতি আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রন জানিয়ে আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট জানিয়েছে, ‘তারা বিদেশি বিনিয়োগকে স্বীকৃতি ও স্বাগত জানায় যাতে এই অঞ্চলকে উপকৃত ও উন্নয়নে সহায়তা করে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন এটা ইতিবাচক একটা পদক্ষেপ যা ইউএলএ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। আরাকানে জনগণের জন্য তারা সত্যিকার অর্থে কাজ করছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। সেখানে বিদেশিদের বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে এবং আমরা এই ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানরত আরাকান আর্মির একটি সূত্র এই বিজ্ঞপ্তিটি প্রতিবেদকের কাছে প্রেরণ করেছে। প্রেরণকারি বলেছেন, বিজ্ঞপ্তিটি তাদের অফিশিয়াল এবং তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও পাঠানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মির নেতৃত্বে থ্রি ব্রাদার’স এলায়েন্স জোট অপারেশন-১০২৭ এর অংশ হিসেবে গত বছর ১৩ নভেম্বর আরাকানে মংডু-অংগু মাও সড়কের মিয়ানমার জান্তার ডন পাইক বর্ডার গার্ড স্টেশন দখল করে নেয়। তখন থেকে মিয়ানমার জান্তা পুরো আরাকানে স্থল ও জলপথ অবরোধ করে রেখেছে। মিয়ানমার জান্তা এসব অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য ধারাবাহিকভাবে বোমা বর্ষণ করে চলেছে। তবুও আরাকান আর্মি একের পর এক শহর দখল করে যাচ্ছে। আরাকান আর্মি ইতিমধ্যে পালাহ্ওয়া, পাউতোহ, ম্রাংবা, ম্রাউক-উ, চাউতোহ্, ম্রানিবোন, পুন্নাহ্ক্যইং, রামব্রি ও রাথিডং শহর দখল করে নিয়েছে।
আরাকান আর্মির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মংডু, বুথিডং, চাউফব্রু এবং অ্যান এসব অঞ্চলে যারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা ও কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য তারা সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করবে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
চলমান যুদ্ধের আরাকান আর্মি ভারতের মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রাখাইন-বাংলাদেশ সীমান্তের বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
আরাকান সরকার বর্তমান রাখাইন-ভারত ও রাখাইন-বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য শুরু করেছে এবং রাখাইনে জনগণ বিশ্বাস করে ভবিষ্যতে এটি আনুষ্ঠানিক রূপ নেবে।’
বিজ্ঞপ্তিতে ‘আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট’ গঠন করার কথা বলা হলেও তার রূপরেখা, কারা কোন দায়িত্বে তা পরিষ্কার করা হয়নি। বিজ্ঞপ্তি প্রেরণকারি সূত্রের সাথে যোগাযোগ করা হলে সূত্রটি শুক্রবার এক ক্ষুদে বার্তায় জানিয়েছে, ‘আরাকান পিপলস্ রেভ্যুলুশনারি গর্ভমেন্ট’ দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। মূলত আরাকান রাজ্য পরিচালনায় এই গর্ভমেন্ট চলছে বলেও জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরাকান রাজ্যে ভারতের মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প এবং রাখাইন-বাংলাদেশ সীমান্তের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। ভারতের প্রকল্পের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে মিয়ানমারের থেকে পণ্যবাহি ট্রলার আসা বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত বাণিজ্যের স্বাভাবিকতার সত্যতা কিছুটা মিলেছে।
মিয়ানমারে সংঘাতে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে এবারেও। এর মধ্যে টেকনাফ স্থল বন্দরে মিয়ানমারের পণ্যবাহি ট্রলার এসেছে।
টেকনাফ স্থল বন্দর সিএন্ডএফ এসোসিয়েশন সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, গত দুই সপ্তাহে টেকনাফ বন্দরে মিয়ারমার থেকে পণ্যবাহি ১২ টি ট্রলার এসেছে। মিয়ানমারের আকিয়াব, বুচিডং এলাকা থেকে মাছ, কাঠ, আদা সহ অন্যান্য পণ্যবাহি এসব ট্রলার আসে। বাংলাদেশের আমাদানীকারক ব্যবসায়ীরা ওই দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করেই আনছেন এসব পন্য। মিয়ানমারের পণ্য নিয়ে আসা ট্রলারের লোকজন জানিয়েছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পন্য আনা সম্ভব হচ্ছে।
তবে ওখানে ‘আরাকান আর্মি’ নিয়ন্ত্রিত কি না তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
টেকনাফ স্থল বন্দর ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন চৌধুরী জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সংঘাতের শুরুতে বন্ধ ছিল। পরে কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এখন পন্যবাহি ট্রলার আসা কিছুটা বেড়েছে। যেসব পণ্যবাহি ট্রলার মিয়ানমার থেকে আসছে তা কাদের নিয়ন্ত্রণে তা পরিষ্কার জানেন না তিনি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমাদানিকারক ব্যবসায়ীদের ২ জনের দাবি, মিয়ানমারের যে সব ঘাট বা স্থানকে ব্যবহার করে পণ্যবাহি ট্রলার আসছে ওই সব এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত। সম্ভবত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণেই মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের তাদের কাছে এসব পণ্য পাঠাচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কোন পণ্য নিয়ে যায়নি মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা। তবে কিছু পণ্যের চাহিদার কথা জানিয়েছে। তা হয়তো দ্রুত রপ্তানি করা হবে।
এর মধ্যে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ সীমান্তে নাফনদীর ওপারে শুক্রবার দেখা মিলেছে মিয়ানমারের ১ টি যুদ্ধ জাহাজ। এটি সকাল থেকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত দেখা গেলেও পরে অন্যত্রে সরে গেছে। একই সঙ্গে থেমে থেমে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেছে।
সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি শব্দ শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বিকাল ৩ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত পর পর ১০ টির বেশি বিকট শব্দ ভেসে এসেছে।
শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দা আব্দুর রহমান জানান, গতকাল থেকে গোলাগুলির ও মর্টার শেলের বিস্ফোরণ কিছুটা কম অনুভূত হচ্ছে। সকাল থেকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত নাফনদীর ওপারে মিয়ানমারের একটি যুদ্ধ জাহাজ দেখা গেছে। এটি চলে যাওয়ার পর থেকে বিস্ফোরণের শব্দ বেড়েছে।
সাবরাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম জানান, গোলাগুলি বা মর্টার শেলের তেমন বিস্ফোরণের শব্দ বৃহস্পতিবার থেকে একটু কমেছে। তবে শুক্রবার ৩ টার দিকে পর পর কয়েকটি শব্দ শোনা গেছে। সকালে নাফনদীর ওপারে যুদ্ধ জাহাজ দেখা গিয়েছিল পরে তা চলে গেছে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. এনামুল হক জানান, বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। জুমার নামাজের পরআবারও গোলাগুলির বিকট শব্দ শোনা গেছে। এখনও থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, গত কয়েকদিন একটানা হ্নীলা ও মিয়ানমারের সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এরপর বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত কিছুটা কমলেও এখন দুপুরের পর আবারও থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে।
সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সংঘাতে গোলার বিকট শব্দ কাঁপছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে থেমে থেমে এই গোলার বিকট শব্দ হচ্ছে।
টেকনাফের বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সকালে শাহপরীরদ্বীপ সীমান্তে নাফনদীর ওপারে মিয়ানমারের জলসীমায় একটি বড় ধরণের জাহাজ দেখা গিয়েছিল। এটি যুদ্ধ জাহাজ না কি দেশটির অন্য কোন জাহাজ তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরে দুপুরের আগেই জাহাজটি সেখান থেকে সরে গেছে। 
এদিকে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতে রাখাইনে বসবাসকারি বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
সীমান্ত বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেখানে অবস্থানরত ব্যবসায়ী, আসা ট্রলারের শ্রমিক সহ অন্যান্যদের যাদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে এসব মানুষরা বলছেন রাখাইন রাজ্য এখন মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন। রাখাইনে বসবাসকারি নাগরিকদের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। উভয় পক্ষের সংঘাত ও হামলা-পাল্টা হামলায় অনিরাপদ হয়ে উঠেছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। এতে রাখাইন নাগরিক, রোহিঙ্গাদের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। আবার অনেক রোহিঙ্গা নাফনদীর ওপারে প্যারাবন, মাছের ঘেরে আশ্রয় নিতেও দেখা গেছে। এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশংকার করা হচ্ছে।
যদিও  সীমান্তের পরিস্থিতির কারণে নতুন করে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। টেকনাফের বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে। সর্বোচ্চ সর্তক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.