আয়াছুর রহমান, কিশোরগঞ্জ থেকে ॥
দেশের হাওর বাওর এর একটি অন্চল কিশোরগঞ্জ জেলা। আমরা ছোট বেলায় পড়েছিলাম ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল। হাওর বাওর এর সাথে পরিচয় ছিল না তেমন।
বৃহত্তম ময়মনসিংহ আর সিলেটের সুনামগঞ্জ অন্যদিকে ভারতের মেঘালয়, এই তিন মিলেই বিস্তৃন্ন হাওর অন্চল। এই অন্চলই একেবারে অবহেলিত। জেলার বাইরের মানুষের আনাগোনা নাই বললেই চলত এক সময়ে। মানুষের জীবন যাপনের মাত্রা নিচের দিকে। তবে সহজ সরল মানুষ তারা।
আমরা সাগরপাড়ের মানুষ। পাহাড় আর সাগর নিয়ে আমাদের বসবাস। আমাদের যোগাযোগ মাধ্যম এস আলম,সৌদিয়া,গ্রীন লাইন সোহাগ মারসা,আর তাদের লাল মতি, ফুল মিয়া, জলতরঙ্গ, আরো অনেক। আমাদের গাড়ি, তাদের নৌযান। নৌযান তাদের একমাত্র বাহন। হাওরের মাঝে মাঝে কিল্লা, টিনের বেড়া ও চাল দিয়ে ঘর। বর্তমান সময়ে হাওরের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেনানিবাস।
বন্ধু ফরিদুল হক সাবু ছিল অসুস্থ। মাঝখানে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নাই। বন্ধু আয়কর আইনজীবি সিরিজ, ব্যবসায়ী তরুণ আর আমি তাকে দেখতে ঢাকা আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাবুকে জানাতেই সব হা হয়ে গেল। তাকে জানালাম ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে তার সাথে দেখা করতে যাব। আমরা পৌঁছেই দেখলাম গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। গাড়িতে তোলে রওয়ানা দিয়ে বলতে শুরু করল সাগর পাড়ের মানুষ তোরা, ইট কংক্রিটের শহরে তোদের রাখব না, তিন দিনের লম্বা ছুটি হাওরাঞ্চলে নিয়ে যাব।ড্রাইভার হেলাল গাড়ির গতি বাড়িয়ে ছুটতে লাগল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নরসিংদী হয়ে পৌঁছে গেলাম কিশোরগঞ্জ শহর। নর সন্ধ্যা নদীর দু'পাড়ে গড়ে উঠা শহরটি। বন্ধুর প্রতিষ্ঠানের দুই কর্তা মিন্টু আর ফিরোজ আমাদের স্বাগত জানাতে দাড়িয়ে ছিল রিভার ভিউ হোটেলের সামনে। হোটেলে পৌছার আগেই দেখা হল প্রসিদ্ধ পাগলা মসজিদ। মফস্বল শহর দোকানপাট প্রায় বন্ধ। আগে থেকে বলাতে গাংচিল রেষ্টুরেন্টটি খোলা ছিল। গাড়ি থেকে নেমেই আগে রাতপ্রাশ সেরেই হোটেলে উঠলাম। একটি কথা না বললে নয়, নর সন্ধ্যা নদী আর নদী নাই, এখন কচুরিপানায় ভর্তি একটি ড্রেন। অবৈধ দখলে দুপাশ।
সকাল হতে না-হতেই ডাকাডাকি শুরু। সাবেক রাষ্ট্রপতি এড আবদুল হামিদ এর দেশ কিশোরগঞ্জের মিঠামইন অষ্টগ্রাম ইটনা। গাংচিলে সকালের নাশতা শেষে প্রসিদ্ধ শোলাকিয়া ময়দান পার হয়ে করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখোলা ঘাট পৌঁছে গেলাম।এটি বিখ্যাত মাছের বাজার আর নৌকার ঘাট। গাড়ি রেখেই ফুলমিয়াতে উঠে পড়লাম। হাওর মাড়িয়ে একঘন্টায় পৌঁছে গেলাম আবুল হামিদ এর জন্মভুমি মিঠামইন এ। প্রচন্ড গরম, আখের রস দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। সুদক্ষ গাইড এরি মধ্যে অটো ঠিক করে নিলেন অষ্টগ্রাম যেতে। শুরুতেই রাষ্ট্রপতি'র বাড়ি দর্শন। হাজি মোহাম্মদ তায়েব উদ্দিন, কামালপুর লিখা গেইট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। একের ভিতর অনেক বাড়ি। পাশে মসজিদ। সবকটি বাড়িই পরিপাটি। ভ্রমণ পিপাসুদের আনাগোনা বেশি। সবাইর দেখা আর ছবি তোলা।আমরাও মিস করিনি। ক্লিক আর ক্লিক।
যাত্রা শুরু অষ্টগ্রামের দিকে। হাওরের বুক চিরে ২১ কি মি দুরত্বে অটো চলতে লাগল। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপর। বিশাল হাওর। দেখতে ঢেউ বিহীন শীতল পানির সাগর। চোখ যতদূর যায় পানি আর পানি। হাওর জুড়ে বিদ্যুত লাইন। হাওরের মাঝে লাল ছাওনি'র "প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট "। ভি ভি আইপি দের আনাগোনা বেশি। মাসের আগে থেকে বুক না করলে রুম পাওয়া দায়। নামের সাথে মিল থাকায় মনে করেছিলাম এটি মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এর। কিন্তু না স্হানীয়দের কাছে জানলাম একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার। অনন্য সুন্দর রাস্তাটি। একটি রাস্তাই অচেনা হাওরকে গড়ে তোলেছে চিরচেনা হাওরে। স্থান করেছে ভ্রমণ পিপাসুদের তীর্থ ভূমিতে । মাঝপথে ভাতশালা ব্রিজ। সবাই গতি থামিয়ে ছবি তোলছে আর তোলছে। আমরাও মিস করিনি। অষ্টগ্রামের জিরো পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। গরমের চাপে সবাই বরফের লেবু শরবত একাধিক গ্লাস গিলতে মিস করেনি। জিরো পয়েন্টএ দেখা মিলল চট্টগ্রাম থেকে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের। মিঠামইন - অষ্টগ্রাম রাস্তা ও হাওর দেখতে শতশত নারী পুরুষের ভীড়। জিরো পয়েন্ট এর গা ঘেঁষে মেঘনার অববাহিকা।অপরপ্রান্তে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলা আর উজানে সুনামগঞ্জ। ফিরে এসে দুপুরের ভোজন সারলাম পূর্ব থেকেই ফরমায়েশ দেয়া মিঠামইন ডাক বাংলোতে। হাওরের রকমারি তাজা মাছ,হাসের মাংস, মাছের ভর্তা খেতে কেউ ভুল করেনি। বর্ষায় হাওরের মাছ আর শীত মৌসুমে শাক সবজি ধান চাষে সাবলম্বী হয়ে উঠে এ জনপদের প্রান্তিক মানুষ।
দীর্ঘ রাস্তার দুপাশে হাওরের জলধার ঘিরে হাস চাষ দেখার মত। বিদায়ের শেষ মুহূর্তে গুরুদয়াল কলেজ মাঠের সুমন টি ষ্টল এর ক্ষির চা অনেক দিন মনে থাকার মত। দীর্ঘ ১৯ ঘন্টার কিশোরগঞ্জ দেখা শেষ করে অন্যদিগন্তে যাত্রা। আমাদের সুদক্ষ চালক হেলালাকে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। কাল কথা হবে নতুন দিগন্তের।