# মাঠে তদারকি নেই ফায়দা লুটছে অসাধু ব্যবসায়ীরা
তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৪৪ টাকা কমিয়ে ১ হাজার ১৭৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে নতুন এ দাম কার্যকর হওয়ার কথা জানায় কমিশন। এর আগে দাম ছিল ১ হাজার ৪২২ টাকা। কিন্তু বিইআরসির বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত মূল্যে মিলছেনা এলপি গ্যাস। ১২ কেজি প্রতিটি সিলিন্ডারের দাম নেওয়া হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা। এলাকাভেদে সে-ই দাম আরও বাড়তি। যা নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। এই চিত্র এখন শহরের সব জায়গায়। বিইআরসি আদেশ দিয়ে নিরব থাকার কারণে ডিলাররা দাম আদায় করছেন নিজের খেয়াল-খুশি মতো। প্রতিটি এলপিজি বিক্রি করা দোকানে নির্ধারিত মূল্যতালিকা প্রদর্শনেরও নির্দেশনা আছে। কিন্তু দুটোই মানা হচ্ছে না। অভিযানের চোখকে ফাঁকি দিতে কিছু দোকানে তালিকা টাঙানো হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
ভোক্তারা বলছেন, দাম কমিয়ে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। তবে এ নিয়ে মাঠে কোনো সংস্থার তদারকি নেই। ফলে ফায়দা লুটছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
শহরের এলপিজি ব্যবসা নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগ ভোক্তাদের। কে দাম বাড়াচ্ছে, কার হাতে এলপিজি ব্যবসা? এই তথ্য খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো ৭ জন মুল হোতাদের নাম। তারা হলেন, 'শহরের খুরুশকুল রাস্তার মাথায় মাম্মি এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ আলী'। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে ৪টি গ্যাসের এজেন্ট নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাঁর হয়ে কক্সবাজারে ব্যবসার দেখভাল করছেন শামীম চৌধুরী। তিনি যমুনা, জেএমআই, ওমেরা, বেক্সিমকো জেলার ডিলার। জেলখানা সড়কের মেসার্স ওসানিক ট্রেডিং । তিনি আই গ্যাস, বসুন্ধরা, জেএমআই, পেট্রো ম্যাক্স,র ডিলার, ৬ নং ঘাটের ফ্রেশ, বিন হাবীব, বিএম, ডেলটার ডিলার ও শাহাদাত এন্টারপ্রাইজের মোহাম্মদ শাহাদাত। তাঁর সাথে সহযোগি হিসেবে কাজ করেন মামুন। জেলখানা সড়কের মেসার্স কক্স ট্রেডিং'র মালিক ও লাফস গ্যাসের ডিলার মোহাম্মদ উল্লাহ, পেট্রোল পাম্প এলাকার হাবিব এন্ড ব্রাদার্স ( জনতা ব্যাংকের নিচে) মালিক ও টোটাল (সরকারি) ডেলটা গ্যাসের ডিলার মোহাম্মদ হাবিব এবং খুরুশকুল রাস্তার মাথায় জননী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও জেএমআই'র ডিলার বাপ্পি এবং খুরুলিয়া দরগাহ পাড়া এলাকার এম এস নেক্সাস ট্রেডিং'র মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। তাঁর সাথে ব্যবসায়ী পার্টনার হিসেবে আছেন কায়েস ও দেলোয়ার। তাঁরা বসুন্ধরা গ্যাসের ডিলার। এছাড়া ভাসমান গ্যাসের দালাল হিসেবে পরিচিত জেএমআইয়ের জেলার ডিলার মোহাম্মদ মনির। মূলত এদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ হয় জেলার এলপিজি ব্যবসা। খুচরা ব্যবসায়ী তাদের থেকে কিনে মাত্র ৫০ টাকা বাড়তি দিয়ে গ্যাস বিক্রি করে। তাদের এই দাম নিয়ে খুচরা ব্যাবসায়ীরা প্রতিবাদ করলে তাঁদের আর গ্যাস দেওয়া হয়না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী। তাদের অত্যাচারে অনেকে দোকান গুটিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই গ্যাস না নিয়ে সিন্ডিকেট করে গ্যাস দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সীমাহীন নৈরাজ্যের মধ্যে কক্সবাজারে এলপিজি ব্যবসা।
জানতে চাইলে কস্তুরাঘাট এলাকার মেসার্স চম্পা এন্টারপ্রাইজ স্বত্বাধিকারী ও কক্সবাজার এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব সিরাজুল হক দৈনিক কক্সবাজারকে জানান, 'মাম্মি এন্টারপ্রাইজ দাম দিয়েছে (গত মঙ্গলবার) যমুনা ১২৩০ টাকা, জেএমআই ১২২০ টাকা, বেক্সিমকো ১২৫০ টাকা, পদ্ধা ১২২০ এবং পেট্রোম্যাক্স ১২২০ টাকা। গত ২ এপ্রিল শনিবার মাম্মি এন্টারপ্রাইজ থেকে জেএমআই ১২৫০ এবং বেক্সিমকো ১২৫০ টাকা দামে কিনেছিলাম। তিনি বলেন, 'যদি এই দামে আমাদের কিনতে হয় আমরা বিক্রি করবো কত দিয়ে? এক যুগ থেকে ব্যবসা করছি কিন্তু এমন পরিস্থিতির শিকার কখনো হয়নি। উপরোক্ত ব্যক্তিদের কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরা মরতে বসেছে।
এখন কত দামে গ্যাস বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'পরিবহন, দোকান ভাড়া ইত্যাদি মিলিয়ে ৫০ টাকা বাড়তি নিচ্ছি।' এতেও পোষাতে পারছিনা।
পূর্ব কলাতলী চন্দ্রীমা সড়কের তাজফিয়া ষ্টোরে ১৪০০ টাকার নিচে কোনো গ্যাস নেই। কথা হলে প্রোপ্রাইটর নুরুল হাকিম বলেন, আগের ১৩৫০ টাকা করে গ্যাস কেনা আছে। এজন্য ১৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো: আবু সুফিয়ান দৈনিক কক্সবাজারকে বলেন, 'যে দামটি বিইআরসি দিয়েছেন তাঁর কোনো নোটিশ আমরা পায়নি। তাঁরা (বিইআরসি) পত্রিকায় দিয়েই দায় সারে। আমাদের কাছে এইরকম কোনো আদেশ হাতে পেলেই আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। অনিয়মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি জরুরি কাজে এখন ঢাকায় আছি। আপনি বিষয়টি জানিয়েছেন আমি খবর নিচ্ছি এবং এসেই অভিযান পরিচালনা করবো। দাম বেশি নিয়ে ভোক্তাদের হয়রানি করবে এটা কাউকে করতে দেওয়া হবেনা, বলেন এডিএম।
বাহারছড়া বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কাজল এন্টারপ্রাইজ কাজল বলেন, 'এক প্রকার আমরা জিন্মি হয়ে আছি। ও-ই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছে না তিনি। বলেন, ১২০০ টাকার উপরে সকল গ্যাসের দাম। এখন আমাদের যাবতীয় খরচ যোগ করলে ১৩০০ টাকার উপরে পড়ে। এতেই গ্রাহকরা নানা রকম উক্তি ছোড়ে। অনেকের সাথে দাম নিয়ে ঝগড়া পর্যন্ত হয়। কিন্তু কি করবো ব্যাবসা করে সংসার চালায়। তিনি অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, 'যারা সিন্ডিকেট করে জনগনের পকেট কাটছে তাদের বিরুদ্ধে লিখেন? শুধু শুধু আমাদের কেন বিরক্ত করছেন। বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাসের ডিলার এম এস নেক্সাস ট্রেডিং ১৩৫০ টাকা প্রতিটি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম দিয়েছেন ১৩৫০ বলে তিনি জানান। এখন আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা কত দামে বিক্রি করবো আপনি বলেন?
জেলা এলপিজি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সরওয়ার আলম বলেন, আমরা মিটিংয়ের মাধ্যমে একটি তালিকা সবার দোকানে পৌঁছে দিয়েছি। সেই দামে তাদের গ্যাস বিক্রি করার জন্য বলা হয়েছে। বেশি দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশি নিলে অভিযান করে জরিমানাসহ শাস্তির কথা বললেন তিনি।
খুরুশকুল এলপিজি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলীম উদ্দিন বলেন, 'তাদের নির্দিষ্ট ১১ দোকানদারকে তারা তালিকা দিয়েছেন। ও-ই দোকানগুলোকে তারা গ্যাস দিচ্ছে। অন্য ব্যবসায়ীরা কি দোষ করেছেন ? তিনি বলেন, 'পাইকারি ব্যবসায়ীরা গোপনে একটি সিন্ডিকেট করে খুচরা ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রেখেছেন। এদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনিভাবে ব্যবস্থা নিলে এই নৈরাজ্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।'
এদিকে শহরের কলাতলী এলাকায়, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, চন্দ্রীমা আবাসিক, টেকপাড়া, ঘোনার পাড়া, বৈদ্যঘোনা, নুনিয়া ছড়া, লারপাড়া, বাস টার্মিনাল, জেল গেইট, বাংলা বাজার, লিংক রোডসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে এলপিজি। তবে ১৩৫০-১৪০০ টাকার নিচে কেউ বিক্রি করছেনা।
এলপিজি'র সাথে সংশ্লিষ্ট ও ডিলারদের দেওয়া তথ্য মতে, জেলায় ছোট-বড় মিলে প্রায় ৭০০ মত গ্যাসের দোকান। তারমধ্য সদরে ও খুরুশকুলে আছে ২৪০ টির মত। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের নিজস্ব নাম ব্যবহার করে গ্যাস সিলিন্ডার বাজারজাত করে আসছে। তারমধ্যে ১৮-২১ টি মোড়কে'র এলপিজি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। সরকারিভাবে টোটাল ছাড়া অন্যসব এলপি দেশের বিভিন্ন কোম্পানির নামে।
যার মধ্যে, বেক্সিমকো, টোটাল ( সরকারি), বিএম এনার্জি, যমুনা, ওমেরা, জেএমআই, পেট্রোম্যাক্স, পদ্মা, ফ্রেশ, ডেলটা, আই গ্যাস, ই উ নি গ্যাস, ইউনিভার্সেল, ইউরো, বিন হাবিবসহ মোট ২১টির মতো এলপি গ্যাস রয়েছে।
শহরের, বাহারছড়া, রুমালিয়াছড়া, নতুন বাহারছড়া, আলির জাহান, কলাতলী এলাকায় খুচরা পর্যায়ের একাধিক দোকান ঘুরে এলপিজি সিলিন্ডারের কোন সংকট দেখা যায়নি। প্রতিটি দোকানে থরে থরে সাজানো আছে গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার। খুচরা ব্যাবসায়ীরা জানালেন, একটি গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার বিক্রি করলে ২০-৫০ টাকার ব্যবসা হয়।
চলতি মাসের ২ এপ্রিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ১২ কেজির সিলিন্ডার ১ হাজার ১৭৮ টাকায় বিক্রির জন্য মূল্য নির্ধারন করে। যা মার্চে ছিল ১ হাজার ৪২০ টাকা। এতে গত দু-মাসের ব্যবধানে এক লাফে কমেছে ৩২০ টাকা। এরমধ্যে এপ্রিলে কমেছে ২৪৪ টাকা। ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। এরপর থেকে সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে প্রতি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির জন্য এলপি গ্যাসের মূল নির্ধারণ করে দিচ্ছে সংস্থাটি।