॥ খালেদা বেগম জ্যোৎস্না ॥
চাটুকারিতা একটা শিল্প বা কৌশল যা সাধারণত নির্দোষ প্রশংসা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। যারা ইতিবাচক চিন্তা করে তারা এই বিষয়টাকে উপভোগ করেন। বিচক্ষণ ব্যক্তিরা চাটুকারিতাকে সাজানো এবং মিথ্যা প্রশংসা মনে করেন। চাটুকারিতা/তৈল মর্দন/চামচাগিরি/তোষামোদী যে নামেই বলেনা কেন, জিনিস কিন্তু একই। কিছু লোকের কাছে সেটা এক ধরনের নেশা যা তারা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। সেটা পরিবার, সমাজ, ব্যবসা, কর্মক্ষেত্র সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমন কোন পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র প্ওায়া যাবে না যেখানে চাটুকার/তৈল মর্দনকারী নেই। সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাইই হোক না কেন?
নিজের স্বার্থসিদ্বির জন্য সত্য মিথ্যা এবং কপটতার মিশেলে অন্যকে তুষ্ট করার অনৈতিক প্রয়াসকে এককথায় চাটুকারিতা বলে। এর সমার্থক শব্দ তোষামোদি, মোসাহেবি, তৈলমর্দন ইত্যাদি।
মানুষ কথা বলতে শেখার অনেক আগে, তোষামোদ করা এবং বোকা বানানোর দুই কলা-ই আয়ত্ত করেছে। ইঙ্গিত, চমকপ্রদ অঙ্গভঙ্গি, প্রাক-ভাষিক সমাজেও এটা সাধারণ ছিল। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে শিল্পটি নেশাগত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগের দিনে বেশিরভাগ উন্নত সংস্কৃতির সভাকবি, গায়েন, লেখক ইত্যাদি শতাব্দী ধরে এটিকে রাজা, জমিদার, নবাব, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে তাদের মিষ্টি জিভের মাধ্যমে প্রভুর অনুগ্রহ ও অর্থ লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন। চাটুকারিতা হল এমন একটি খেলা যেখানে আমরা সূক্ষভাবে নিজেদের কলার মাধ্যমে অন্যদের বোকা বানাই। বর্তমানে সময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায় বা হাসিলে জন্য চাটুকারিতার/তৈল মর্দনের আশ্রয় নেয়।
চাটুকারিতা একটি সূক্ষ শিল্প যা উচ্চ বুদ্ধিভিত্তিক শক্তি, কল্পনা এবং চিন্তাভাবনা ও আবেগের উপর নিয়ন্ত্রন করার মতো দক্ষতার প্রয়োজন হয়। গাছে যেমন জীয়ন্ত গাছে পাতা আসাটা স্বাভাবিক কিন্তু তেমনি চাটুকারিতাও আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবে আসে না; এটি একটি দুর্দান্ত পরিকল্পনা, প্রচুর দক্ষতার এবং অনুশীলনের প্রয়োজন। এখন আমরা যে বিশ্বে বাস করি তা একটি চাটুকারদের স্বর্গ, একটি অসার মেলা, যেখানে প্রতিটি পুরুষ এবং প্রতিটি নারী তাদের অসারতার কারণে এই চাটুকারদের চাদরের ভিতরে চলে আসতে পারে বা আসছে। অতএব, যখন একজন চাটুকার অনুশীলনের চালিয়ে যান তখন তাদের মক্কেলের অভাব হয় না।
চাটুকার/তৈল মর্দন আবার কি ভাবে ইতিবাচক নেতিবাচক কি ভাবে হয়?
কেউ কারো প্রতি বন্ধুত্ব করার জন্য চমৎকার কিছু কথা বলা। এতে লোকেরা তাদের প্রতি আরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে যারা তাদের প্রশংসা করে এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে ভাল বোধ করে। এক্ষেত্রে তারা সাধারনত পরিবারের প্রধান, প্রভাবশালী ব্যক্তি, উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বা অহং-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিদের বেছে নেয়। সাধারনত সব মানুষ প্রশংসা পেতে পছন্দ করে।
তবে সে প্রসংশা যখন যে ব্যক্তি যা প্ওায়ার যোগ্যতা রাখেন না তাকে সে বিষয়ে প্রশংসা করা হয় তখন তা তার জন্য বিপদজনক। যখন কারো দূর্বলতা জেনে তা নিয়ে তাকে কাটিয়ে উঠার সহযোগিতা না করে বরং তা নিয়ে সবার কাছে প্রশংসা করাটার অর্থ হচ্ছে ঐ লোকটার সর্বনাশ করা, যা চাটুকাররা করেন। এটা নেতিবাচক।
কেন চাটুকারিতা:
ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য বা সেই ব্যক্তিকে ইমোশনালী/আবেগেগত ভাবে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে নিযে আসা। যখন একজন ব্যক্তি প্রশংসার দাবী রাখে না কিন্তু প্রিয়পাত্র হ্ওয়ার জন্য যখন অসত্যকে সত্য বলে তাঁর কাছে তুলে ধরে শুধুমাত্র স্বীয় স্বার্থের খাতিরে।
চাটুকারিতা সোজা কথায় এটা এক ধরনের নিরেট মিথ্যা কে অলংকারভূষিত করে তার মক্কেলকে বোকা বানানো, কিন্তু তাতে সমস্যা হবে কেন? সমস্যা হয় যখন ঐ মক্কেল চাটুকারের মিথ্যা স্Íতিকে সরলভাবে বিশ^াস করেন এবং ভুল পদক্ষেপ নেন। প্রত্যেকেই নিজের সম্পর্কে ভাল জিনিস শুনতে পছন্দ করে। কিন্তু মিথ্যা প্রশংসা একটি চিন্তাশীল, সৎ প্রশংসার মত নয়, যা চাটুকাররা করে থাকেন। চাটুকারিতা করতে করতে এটা এক পর্যায়ে নেশার পর্যায়ে চলে যায়। তখন ঐ ব্যক্তি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না,এটা চালিয়ে যেতেই থাকেন।
সত্যিকথা বলতে কি আজকাল ব্র্যান্ড চাটুকার তৈরী হয়েছে, যাদের এটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং এর থেকে তাদের ফিরতে পারাটা অসম্ভব। কিন্তু কথা হলো যাঁরা এই গ্যাঁড়াকলে পড়তে ভালোবাসেন তাদের জন্য এটা এক সময় বির্পযয় ডেকে নিয়ে আসবে অবধারিত। Shakespeare এর ভাষ্য: Everyone that’s flatters the, is not friend in misery .Words are easy like the wind, faithful friends are hard to find.
মানুষের শরীরে পিটুইটারি গ্রন্থিটিকে "মাস্টার গ্রন্থি" হিসাবে উল্লেখ করা হয় কারণ এটি উৎপাদিত হরমোনের মাধ্যমে অনেক শারীরিক ক্রিয়াকলাপ নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যেমন পিটুইটারি গ্রন্থি ছাঁড়া বাঁচতে পারি না, কারণ এটি শরীরের অন্যান্য অনেক গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রন করে যাতে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ সঠিক ভাবে চলমান থাকে।তেমনি চাটুকাররা এই কলা ছাড়া চলতে পারে না, কারন এটা তাঁদের অস্তি মজ্জায় সিন্দাবাদের বুড়ো মতো ঢুকে আছে।
শরীফ নবাব হোসেনের কবিতা:
চাটুকার:
চা- চাটে পা মনিবের রাতদিন
লোভ -লালসার তার অন্তহীন
গড়ে অর্থ সম্পদের পাহাড়
মনুষ্যত্বের নাই দরকার
টু- টুই টুম্বর কুবুদ্ধিতে
চলে না সুবুদ্ধিতে
লেগে থাকে লাছার মতো প্রভুর বৃত্তে
সময় কাটায় শেয়ালের ন্যায় নৃত্যে
কা- কাটে জীবন চামচানিতে
স্বকীয়তা বলতে থাকে না কিছু
চলে উনার পিছু পিছু
করে স্বার্থসিদ্ধি সবকিছু
র- রংগে রসে জীবন কাটায়
হয় সে বসের হাতের নাটায়
একদিন ঐ সুতা কেটে যায়
আকাশ থেকে মাটীতে লুটায়
সামান্য কিছু উদাহারণ:
# আপনি অনেকের কাজ করেন এবং কখনও অভিযোগ করেন না। কি আজিব মানুষ আপনি? আপনি নিজেকে ঠকাচ্ছেন।
# এটি আপনার কাজের বাইরে এবং অনেকটা মরুভুমিতে বেঁচে থাকার মতো, আরে আপনি কি উট? কি হবে এতো কষ্ট করে? আপনার তো প্রমোশন হবে না, ওনারা যাঁদের পছন্দ করে, তাঁকেই সব সুবিধা, প্রমোশন দেবে।
# স্যার আজ আমি ছুটি নিবো, স্যার জানতে চাইলো, কেন? উত্তর: স্যার আমি জানি আজ আপনার আম্মা আসতেছেন, আমি উনাকে দেখবো আর পায়ে ধরে সালাম করবো, কি ভাবে আপনার মতো সন্তান জস্ম দিয়েছেন। (বুঝেন ঠেলা)
# এইবারের ঈদটা স্যার আপনাদের সাথে করতে চাই, প্রতিবার তো মা বাবা সাথে করি, স্যার আপনি তো আমার অভিভাবক আর ভাবীর হাতের রান্না , সে তো অমৃত। স্যার বোনাস পেয়েছি তাই সব খরচ আমার, না হলে খুব কষ্ঠ পাবো, না করবেন না স্যার। ( কি বুঝলেন?)
# স্যার আজকের অনুষ্ঠানটা আমরা ভাবীকে উদে¦াধন,করাতে চাই, কিন্তু সে বেচারী যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বামীর সাথে গেছেন, বক্তব্য বা উদে¦াধন জাতীয় কিছু করেননি বা পাবলিক প্লেসে কিছু বলার অভিক্ষতা নাই। ( এটা কিন্তু জেন্ডারের কথা ভেবে না, স্যার কে তৈল দ্ওেয়ার জন্য)।
# ম্যাডাম আজ আপনাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে, আপনি বাসায় চলে যান,আমরা চালিয়ে নিবো। ধরে নিতে হবে “দিল মে কুছ তো হ্যায়“
# ম্যাডাম শাড়ীটা আপনি পড়েছেন বলে শাড়ীটা যর্থাথতা পেয়েছে, সুন্দর লাগছে, অন্য কেউ পড়লে এতো সুন্দর লাগতো না(জেন্ডার নিয়ে আসেন না)। (বুঝেন ঠেলা) ধরে নেন আজ ছুটি বা একটু আগে য্ওায়ার বায়না ধরবে।
# কেউ কেউ উধ্র্¦তন কতৃপক্ষের নেক নজরে আসার জন্য অতি চতুরতার সাথে অবোধ শিশু সুলভ আচরন করেন, যাতে উধ্র্¦তন কতৃপক্ষের দৃষ্টি তাঁর প্রতি থাকে। উধ্র্¦তন কতৃপক্ষের স্বামী বা স্ত্রী বা সন্তানের জন্য অধিক ব্যাকুল হয়ে পড়েন । অথচ যাঁর হওয়া দরকার তাঁর অত মাথা ব্যাথা নাই। বুঝেন চ্ওায়া আর পাওয়ার গাঁটছড়াটা কোথায়!!!!!
# ম্যাডাম আমরা সব রির্পোট তৈরী করে দিবো আপনার কিছু করতে হবে না। তখন ম্যাডাম খাবেন আসল ঠেলা।
# কারো কাছে কোন কাজে যেতে হলে বলবে আওে ভাই উনি আমার কাছের লোক কোন চিন্তা করতে হবে না, গিয়ে দেখলেন শুধু মৌখিক পরিচয়, আপন তো দুরের কথা, যদি আপনি না যেতেন সিই কাজ কোন দিন ঠিক মতো হতো না।
# সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হচ্ছে আর একটা অন্যতম মাধ্যম কে কাকে কি ভাবে তৈল দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে।
যোগ্যতা না থাকলে তৈল দিয়ে সাময়িকভাবে চালিয়ে যেতে পারেন, তবে টিকে থাকতে হলে যোগ্যতার প্রয়োজন। তবে আজকাল তৈল দিয়ে টিকে থাকতে দেখা যায়, যা অনেকটা অবক্ষয়ের পর্যায়ে পড়ে। জ্ঞান দ্ওেয়া আমার কাজ না, শুধু জাগানোর ঘন্টা বাজানো, যাতে আমরা ঐ ফাঁদে না পড়ি।
দিনশেষে নিজের বিবেকের কাছে একটু প্রশ্ন করেন :
উস্তাদ সাজাত খানের গজলের সূত্র ধরে বলি আয়না যদি সোনার ফ্রেম্ওে থাকে কিন্তু কখন্ও মিথ্যা বলবে না। তাই আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখুন! না নিজেকে কি জোকারের মতো লাগছে না স্বীয় প্রতিফলন দেখছেন। যদি স্বীয় প্রতিফলন দেখেন আপনি সফল!!!