# ঢাকা চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে ৫০ কিলোমিটার
# নভেম্বরে খুলছে টানেলের প্রথম টিউব, দ্বিতীয় টিউব ডিসেম্বরে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নির্মাণের কাজ শেষ হচ্ছে এ বছরই। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এই টানেল হবে দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম রোড টানেল। আর এই টানেলের মধ্যে দিয়ে পদ্মা সেতুর পর আরেকটি স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দূরত্ব কমবে অন্তত ৫০ কিলোমিটার।
বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ হলে ঢাকার যানবাহনগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট হয়ে বন্দর টোল রোড-নির্মাণাধীন আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা ছুঁয়ে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহার করলে চট্টগ্রামের দিকে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তাছাড়া কর্ণফুলী টানেল হয়ে আনোয়ারা উপজেলার সিইউএফএল ঘাট-চাতরি চৌমুহনী-বাঁশখালী-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হলে কক্সবাজারের দিকে সড়ক কমবে আরো প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এর ফলে দুই দিক মিলে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে কক্সবাজারের সাথে।
মূল টানেল এবং অ্যাপ্রোচ সড়কসহ সবমিলিয়ে কাজের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ এগিয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, আমরা শিডিউল অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবে। এই টানেল চালু হলে দৈনিক ১৭ হাজার যানবাহন পার হতে পারবে।
তিনি বলেন, ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলে প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম ও প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এ ছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।
নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, কক্সবাজার এবং টেকনাফকে ঘিরে যে ধরনের বিশ্বমানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য এ প্রকল্প বিশাল ভূমিকা রাখবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস্ বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর মাসে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীতে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। এ কারণে আমরা ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছি।
তিনি বলেন, যানবাহন উঠা-নামার জন্য বাড়ানো হচ্ছে ইউলুপ এবং আন্ডারপাস। যা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। টানেল চালু হওয়ার পর শহরের যানজটের চাপ সামাল দিতে আপাতত এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটারের কাজ দ্রুত শেষ করে ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারির মধ্যে খুলে দেওয়ার চিন্তা চলছে।
প্রকৌশলী শামস বলেন, টানেল নির্মাণকাজ শেষ হলে ঢাকার যানবাহনগুলোকে আর নগর হয়ে যেতে হবে না। আউটার রিং রোড দিয়ে টানেলের ভেতর দিয়ে আনোয়ারা ও বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজার যেতে পারবে। এতে করে ঢাকার সাথে ৩৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রামের ১৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। ঢাকা থেকে ৭ ঘন্টা এবং চট্টগ্রাম থেকে ৩ ঘন্টায় কক্সবাজার যাওয়া যাবে।
তবে এই টানেল নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম নগরীর তেমন কোনও উপকার হবে বলে মনে হচ্ছে না। দিনে কতটা বাস যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার যায় এবং কক্সবাজার থেকে ঢাকা যায়। নদীর অপরপ্রান্তে এমন কোনও শিল্প কারখানাও নেই, যেগুলোর যানবাহন টানেল দিয়ে পার হবে। ফৌজদারহাট মোড়ে এখন প্রতিদিনই যানজট। টানেলের গাড়ি বের হলে এ যানজট আরও বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করছে। এ গাড়িগুলো কীভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির পাশ ঘেঁষে শুরু হয়ে কর্ণফুলী নদীর মাঝ দিয়ে দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে উঠেছে এ টানেল। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে টানেলটি।
কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে টানেল অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে। টানেলের নির্মাণ কাজ করছে চায়নার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে ২১০ চীনা নাগরিক এবং ৮০০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক দিন রাত কাজ করছেন।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এ টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে চীনের সহায়তা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ২ শতাংশ হারে এ ঋণ দিয়েছে। চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
দুটি টিউব সম্বলিত নদীর তলদেশে এই মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এরমধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টানেলটি দুটি টিউবে চার লেনবিশিষ্ট। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ রয়েছে।
টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি। গত ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে (সিসিসিসি) নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এদিকে গত ২৯ জুলাই শুক্রবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, অক্টোবরের শেষ দিকে বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টানেলের একটি টিউব এবং ডিসেম্বরে দ্বিতীয় টিউবটিও খুলে দেওয়া হবে। বলেন, টানেলের কাজ খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা গেছে। এত বড় একটা প্রজেক্ট, নির্ধারিত সময়ে যে বাস্তবায়ন হচ্ছে তা দেশের জন্য বড় সাফল্য। টানেলটা বাংলাদেশের জন্য মডেল হিসেবে চিহ্নিত হবে।