আল কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক

আল কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক
॥ অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন ॥

  আমাদের দেশে প্রচলিত আছে যে, ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেন। এ কথার পক্ষে যথেষ্ট কারনও রয়েছে।ইংরেজ আমলে আমাদের দেশে ব্রাহ্মধর্মের জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। ব্রহ্মধর্ম আপামর জনসাধারনের কাছে প্রচারের জন্য ভাই গিরীশ চন্দ্র নিজেই উদ্যোগী হলেন। এই সময় ভাই গিরীশ চন্দ্রসেন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রহ্মধর্মমত গ্রহন করেন। শুধু তাই নয় তিনি  ব্রহ্মসমাজের সহযোগতিায় ১৯৮৬ খ্রী: ৪২ বছর বয়সে লখনৌতিতে গিয়ে ৭৫ বয়েসী মৌলানা এহসান আলী সাহেবের কাছে এক বছর যাবত পারস্যের দেওয়ান ই হাফেজ ও আরবী ব্যকরন নিয়ে পড়াশোনা করেন। এব্যাপারে ব্রহ্মসমাজ এমনকি ইংরেজরাও পয়সা কড়ি দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিল।
ভাই গিরিশ চন্দ্রর জন্ম ১৮৩৫ খ্রী: মৃত্যু ১৯১০ খ্রি:। অথচ আমরা দেখতে পাই ভাই গিরিশ চন্দ্রের আগে অর্থাৎ ১৮০৮ খ্রি:পবিত্র কোরআন বাংলায় অনুবাদের কাজ করেন মৌলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। এর পর ১৮৩৬ খ্রি: পবিত্র কোরআনের পুন্র্ঙ্গা অনুবাদ করেন মৌলবী নৈইমুদ্দীন। এর পর গিরিশ চন্দ্র সেনের জন্মের এক বছর পর ১৮৩৬ খ্রি: মৌলভী নঈমুদ্দীন পুর্ণাঙ্গ কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেন। মৌলভী নঈমুদ্দীন সম্পর্কে তাঁর ছেলে মৌলভী রোকনুদ্দীন আহমদ তাঁদের কুরসীনামা থেকে যেসব তথ্য দিয়েছেন তাতে জানা যায়, তাঁদের পুর্ব পুরুষ শাহ মুহাম্মদ খালেদ বাগদাদ থেকে মুঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের আমন্ত্রনে বাগদাদ থেকে দিল্লী আসেন। তাঁর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ সৈয়দ মুহাম্মদ আহের দিল্লী থেকে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। এরপর মানিকগঞ্জের গালা গ্রামে বিবাহ করে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা ‘সৈয়দ’ উপাধী ত্যাগ করেন এবং গালা গ্রাম থেকে টাঙ্গাইলের করটিয়ার কাছে সুরুজ গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানে মৌলভী মুহাম্মদ নঈমুদ্দীন সুরুজ গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম সলিম উদ্দীন এবং মাতার নাম তাহেরা বানু। পিতার কাছ থেকে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা শিক্ষা করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য নঈমুদ্দীন ঢাকা চলে আসেন।আট বছরকাল এক বিশিষ্ট আলেমের তত্বাবধানে থেকে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি কাফসির, ফিকাহ, মান্তেক প্রভুতি শাস্ত্রে অনেক জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি বিহার, এলাহাবাদ, মুর্শিদাবাদ, জৌনপুর, আগ্রা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে অনেক আলেমের নিকট অনেক দীন ই ইলম আয়ত্ব করেন। তাঁর সর্ব শেষ ওস্তাদ এর কাছ থেকে তিনি “আলিম  - উদ - দহর” অর্থাৎ‘ জ্ঞান সমুদ্র ’উপাধি লাভ করে ৪১ বছর বয়সে টাঙ্গাইলে ফিরে আসেন। প্রকৃত অর্থে তিনি জ্ঞান সমুদ্র ছিলেন যেমন ছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মুসলিম সমাজে তিনিই ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র মৌলবী মুহম্মদ নৈইঈমুদ্দীন। অবিভক্ত বাংলার জ্ঞানরসহীন বিশাল মরুভুমিতে কী অপরিসীম প্রাণাবেগ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঝড়ের মতো দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন এই সমাজ সংস্কারক।করটিয়া থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বার্মা, সিলেট সিলেট থেকে রংপুর, কলকাতা, কলকাতা থেকে আসাম, বিহার আর দার্জিলিং এ এই মানব প্রেমিকের  অবাধ যাওয়া আসা ছিল।
উনবিংশ শতাদ্বীর শেষ কয়েক দশকে এবং বিংশ শতাদ্বীর শুরুতে মৌলানা মুহম্মদ নৈঈমুদ্দীন ছিলেন মুসলিম বাংলার রামমোহন। এ সময়ে তাঁর সাথে আরো কয়েকজন কবি সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক ছিলেন, তারা হলেন মুন্সী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, মুস্মী জমিরুদ্দীন, শেখ আবদুর রহিম, মোজাম্মেল হক, মুন্সী রেয়াজুদ্দীন আহমদ, পন্ডিত রেয়াজুদ্দীন আহমদ মশহাদী, মোহাম্মদ গোলাম হোসেন, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মীর মোশাররফ হোসেন, মুন্সী হেহেরুল্লাহ (সিরাজগঞ্জ) কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ।
মৌলভী নঈমুদ্দীনের পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ এর প্রত্যেকটি আয়াতের অংশ সমুহ আলাদা আলাদা ভাবে আরবী হরফে মুদ্রিত। তার নীচে তিনি সে অংশের বাংলা তরজমা  এর ব্যাখ্যা  তরজমা রয়েছে। তাঁর পবিত্র কোরআন শরীফের অনুবাদের প্রথম খন্ড ১৮৯১ খ্রি: ২৬ সে সেপ্টেম্বার প্রকাশিত হয়।এর দ্বিতীয় খন্ড এবং তৃতীয় খন্ড ১৮৯২ খ্রি: হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী জমিদার সাহেবের করটিয়া মাহমুদীয়া যন্ত্রে ছাপা হয়।এখান থেকে তার সম্পাদনায় “ আখবারে এছলামীয়া” নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদিত হয়।এরপর জলপাইগুড়ির জমিদার খান বাহাদুর রহিম বক্স খানের সাহায্যে পবিত্র কোরআন শরীফের ৭ম, ৮ম, ৯বম পারা পর্যন্ত প্রকাশ করেন। ১০ ম পারা মুদ্রিত হওয়র পুর্বে ১৯০৮ খ্রি: ২৩  নবেম্বর মৌলবী নঈমুদ্দীন ইন্তেকাল করেন। এর বাকী অংশ পুত্র কাছেম উদ্দিন ও ফখরুদ্দীনকে অনুবাদ ও প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়ে যান। মৌলবী নৈঈমুদ্দীন“ ফতওয়ায়ে আলমগিরী” বাংলায় চার খন্ডে অনুবাদ করেন। তিনি বুখারী শরীফেরও অনুবাদ করেন, তবে কতটুকু অনুবাদ করেছিলেন তা জানা যায় না।
“আখবারে এছলামীয়াতে” মৌলানা মোশারলাফ হোসেন “গো জীবন” নামে ৬৬ পৃষ্টার বইটি প্রকাশ হলে মৌলবী নঈমুদ্দীন“আখবারে এছলামিয়াতে” এর তীব্র বিরোধিতা করে ফতওয়া জারী  করেন। মীর মোশাররফ হোসেন গো মাংস ভক্ষন এবং গো কোরবানীর বিরোদ্ধে বইটি প্রকাশ করেন।আখবারে এছলামিয়াতে মৌলবী নঈমুদ্দীনের ফতওয়া প্রকাশের পর মীর মোশাররফ হোসেন মৌলবী নৈমুদ্দীনের বিরোদ্ধে মানহানী মামলা করেন। তখন প্রকাশিত “সুধাকর” পত্রিকা মৌলবী নৈমুদ্দীন সাহেবকে সমর্থন করেছিল। এক পর্যায়ে মীর মোশাররফ হোসেনকে কাফের ফতওয়া দিয়ে “আখবারে এছলামিয়া” তে প্রকাশ করা হয়। অনেক দিন দুপক্ষের বাক যুদ্ধ চলার পর মওলানা রেয়াজুদ্দিন মাশহাদীর চেস্টাতে শেষ মেষ ব্যাপারটি উভয়ে নিস্পত্তি করেন।
মৌলাবী নঈমুদ্দীন এর প্রচুর অর্থকড়ি ছিলনা। এই সব প্রচার, প্রকাশনায় প্রচুর অর্থকড়ির প্রয়োজন তা তার হাতে ছিলো না।তাঁর প্রচারে ভাই গির্শিচন্দ্র সেনের মতো কোন মিশন ছিলনা। তাই ব্যাপকভাবে প্রচারের সুযোগ আসেনি। গিরীশচন্দ্র সেন কোরআনের অনুবাদ বিক্রি করে যে টাকা লাভ করতেন তা ব্যয় করতেন ধর্ম প্রচার কাজে।
মৌলবী নৈঈমুদ্দীন এর অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তার মধ্যে-১.কালেমাতল কোফর ২. এছারাতে আখের জ্জোহর, ৩. এনসাফ ৪. রফা এদায়েন ৫. আদেল্লায় হানিফীয়া ৬. মায়াদানোল ওলুম ৭.সুরা ইউসুফের তফসীর ৮. সেরাতল মস্তাকীম ৯. সেরাতল মস্তাকীম(নব পর্যায়) ১০. ধর্মের লাঠি ১১. বেতের ১২.তারাবিহ এসব ছাড়া তিনি পুঁথির ভাষায় এবং পুথির আদর্শে কয়েকটি বই লিখেছিলেন। ১.ছহী শাহ আলমের কিচ্ছা ২. ছহী শের সাহেবের কিচ্ছা ৩.ছহী আলমগীরের কিচ্ছা ৪.ছহী নুরজাহান বেগমের কিচ্ছা ৫.ছহী আলাউদ্দিনের কিচ্ছা ৬.ছহী হোসেন শাহের কিচ্ছা ৭. গোকান্ড। মৌলবী নৈঈমুদ্দীন তাঁর জীবনে সম্পুর্ন কাজ সমাপ্ত করে যেতে না পারলেও মুসলিম সমাজে আল কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.