# ২০২৪ সালে পাচারকালে ৬৫৭ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নিখোঁজ
কক্সবাজার তার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত এবং বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের কারণে মানবপাচার ও মানবপাচারের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম সংবেদনশীল অঞ্চল। গত ২০২৪ সালে মানবপাচারের সময় ১৫০টিরও বেশি বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় ৬৫৭ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নিখোঁজ বা মারা গেছে। এমন বাস্তবতায় চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার আদালতসমূহে ৪৬০টি মানবপাচার মামলা ৩ টি ট্রাইবুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
গতকাল সোমবার দুপুরে কক্সবাজারের একটি অভিজাত হোটেলে 'কক্সবাজার জেলায় মানব পাচার রোধ ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা' বিষয়ে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি এ কর্মশালার আয়োজন করে। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সাইফউদ্দিন শাহীন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার বলেন, 'গত ১৫ বছরে কারা কক্সবাজার অঞ্চলে মানবপাচারের সাথে জড়িত ছিল তাদের একটি ডাটাবেজ করা হবে। এর ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে।'
বর্তমানে 'জেলার ২১ পয়েন্টে মানবপাচার হয়' মন্তব্য করে পুলিশ সুপার সাইফউদ্দিন শাহীন বলেন, 'প্রয়োজনে এসব স্থানে ড্রোন নজরদারি করা যেতে পারে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানবপাচার বন্ধ করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের সার পাচার হচ্ছে। আনা হচ্ছে ইয়াবা। এ অপরাধ বন্ধে পুলিশ তৎপর রয়েছে।'
কর্মশালায় তথ্য উপস্থাপন করে বলা হয়, সমুদ্রপথে মানবপাচার এখনো প্রাণঘাতি হুমকি হয়ে রয়েছে। ২০২৩ সালে, সারাদেশে ১৩৭টি মানবপাচারের মামলা নথিভুক্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় ৪৪% ভুক্তভোগী কক্সবাজার জেলা থেকে ছিল। এই ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৬৬% ছিল পুরুষ, যা মানবপাচারের ক্ষেত্রে লিঙ্গগত বৈচিত্র্য এবং নতুন ধরণের কৌশল ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। অনেক পুরুষ ভুক্তভোগীকে বিদেশে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয় এবং পরে তাদেরকে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে মানবপাচার ও মানবপাচার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে, ৮৬টি মানবপাচারের ঘটনা রিপোর্ট করেছে অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং ওয়ার্কিং গ্রুপ। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এইসব ঘটনার মধ্যে অনেকে জড়িত ছিল প্রলোভন দেখিয়ে কর্মসংস্থান ও সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে শোষণের সাথে।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে চলমান সহায়তা হ্রাস ও খাদ্যসংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, ফলে বসবাসকারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক দুর্বলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পাচারকারীরা রোহিঙ্গা ও স্থানীয় ভুক্তভোগীদের নানা রকম মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলোভিত করছে-যেমন বিদেশে চাকরি, বিয়ের প্রস্তাব কিংবা নিরাপদ অভিবাসনের আশ্বাস, যার পরিণতি হচ্ছে জবরদস্তিমূলক শ্রম ও যৌন শোষণ।
এই বহুমাত্রিক সংকটের কার্যকর মোকাবেলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনজীবী, সাংবাদিক ও সুরক্ষা অংশীদারদের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন অত্যন্ত জরুরি বলে অভিমত প্রকাশ করেন বক্তারা।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মোঃ ইউনুচ । সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সীমা জহুর। শুরুতে বিএনডাব্লিওএলএ এর সভাপতি স্বাগত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে কর্মশালার শুভ উদ্বোধন ঘোষনা করেন। প্রকল্প ম্যানেজার নাজমুল করিম প্রকল্প ও সংস্থার কাজ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টশন উপস্থাপন করেন। সংস্থার ডিরেক্টর প্রোাগ্রাম এন্ড অপারেশনস্ নাফিজ ইমতিয়াজ হাসান কর্মশালাটির সার্বিক পরিচালনা এবং কী-নোট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন।
২০১৮ সাল থেকে আইওএম -এর সহযোগিতায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ (২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ) ও মহেশখালি উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মানব পাচার প্রতিরোধে সংস্থাটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। প্রকল্পের কর্ম এলাকায় বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে সংস্থাটি, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে মানব পাচার প্রতিরোধে সক্রিয় ও কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। এছাড়াও কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাচারের শিকার ভুক্তভোগীদের মনোসামাজিক সেবা, আইনি সহায়তা, প্রত্যাবাসন সহায়তা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও জীবিকা উন্নয়নে সহায়তা প্রদান করছে। গত সেপ্টেম্বর ২০১৮- এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ক্যাম্প পর্যায়ে ৫৭৪ টি এবং টেকনাফ, মহেশখালী, সদর, উখিয়া ৮৩০ জন সহ মোট ১৪০৪ জন ভিকটিম চিহ্নিত ও সেবা প্রদান করেছে।
কর্মশালায় অংশগ্রহনকারী বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনী- (ডিবি, ডিএসবি, এপিবিএন, বিজিবি, কোষ্টগার্ড), প্রটেকশন এ্যাকটরস, আইনজীবী, সাংবাদিক এনজিও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাচার ও পাচারে ঝুঁকি ম্যাপিং, আন্ত-সংস্থা সমন্বয় ও জোরদার করা, আইন বিষয়ে গণমাধ্যম এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক প্রতিরোধ কৌশল বিষয়ে ৩টি গ্রুপ ওয়ার্ক করা হয়।