মেজর সিনহা হত্যা মামলার কিছু স্মরণীয় বিষয়

মেজর সিনহা হত্যা মামলার কিছু স্মরণীয় বিষয়
মেজর (অব) সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত আসামী প্রদীপ ও লিয়াকত আলীর রেফারেন্স ও আপিল শুনানী হাইকোর্ট বিভাগে শুরু হয়েছে। বাদীপক্ষের নিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে বিচারিক আদালতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী কিছু বিষয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যা সম্মানিত পাঠকদের সামনে পেশ করার ইচ্ছা হচ্ছে।  ১৯৮৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কার্যক্রম শুরু হওয়ার দিন থেকে ১৯৮৮ মার্চ পর্যন্ত সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর ও ১৯৮৮ সালের মার্চ থেকে ১৯৯১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আমি কক্সবাজার জেলার পাবলিক প্রসিকিউট ও দেশের সর্বকনিষ্ঠ পিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এরপর থেকে ৩০বছর আসামীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর মেজর সিনহা হত্যা মামলার বাদীর পক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমার দেখা কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের ইতিহাসে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টিকারী কিছু ঘটনা এই মামলায় হয়েছে। কোন হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ ২৬ পৃষ্টার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে কেবলমাত্র  এই মামলায়। অভিযোগপত্রের মোট ১৫জন আসামীর মধ্যে ১২জন আসামী বিজ্ঞ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন একমাত্র এই মামলায়। কক্সবাজারের দায়রা জজ আদালতের ইতিহাসে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সর্বাধিক ৬৫জন সাক্ষীর সাক্ষ্যজেরা গ্রহন করা হয়েছে।  ৬৫জন সাক্ষীর সাক্ষ্যজেরা  তথ্য প্রযুক্তির অন্যতম দান কম্পিউটারের মাধ্যমে রেকর্ড করা হয়েছে এবং সাথে সাথে আসামীপক্ষের আইনজীবীদেরকে জেরা করতে সহায়তা করার জন্য গৃহীত সাক্ষ্যের প্রিন্টটেড কপি সরবরাহ করা হয়েছে যা এই মামলায়ই প্রথম।  বাদী শরমিন শাহরিয়া ফেরদৌস দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য দিয়াছেন ১ঘন্টা ২০ মিনিট, কিন্তু তাকে দুই দিন ব্যাপী দীর্ঘ ৯ ঘন্টা জেরা করা হয়েছে যা একজন মহিলা বাদীকে দীর্ঘতম জেরা। আসামী লিয়াকতের পক্ষে জেরা করতে গিয়ে জেরারত অবস্থায় গত ২৪/৮/২০২১খ্রিঃ তারিখ ৪.১৫ ঘটিকার সময় চট্টগ্রাম থেকে আগত সিনিয়র এডভোকেট বাবু চন্দন দাস হঠাৎ করে দাড়াঁনো অবস্থা হতে বিকট শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে যান। ৩০ মিনিট জেরা গ্রহন বন্ধ থাকলেও তিনি সুস্থ হওয়ার পর ৪.৪৫ ঘটিকার সময় পুনরায় জেরা শুরু করা হয়। এটাও কক্সবাজারের ইতিহাসে প্রথম। এই মামলায় স্বীকৃতমতে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তারকৃত নিহত মেজর(অব) সিনহার সহযোগী ও ভিকটিম রাষ্ট্রপক্ষের ২নং সাক্ষী সাহেদুল ইসলাম সিফাত আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন ২ঘন্টা ২০মিনিট, তাকে আসামীপক্ষে জেরা করা হয়েছে ২দিনে ৬ঘন্টা ৩২ মিনিট। আসামীদের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি ও কতিপয় সাক্ষীর জবানবন্দি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধকারী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট তামান্না ফারাহ দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য দিয়াছেন ৫৬ মিনিট, তাকে জেরা করা হইয়াছে ৪ ঘন্টা ৪০ মিনিট। তিনি ১০.১৫ ঘটিকা থেকে ৫টা পর্যন্ত সাক্ষীর ডকে ছিলেন। অবশ্য ১ঘন্টা (২টা থেকে ৩টা) বিরতি ছিল। একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের এত লম্বা সাক্ষ্যজেরা এটাই কক্সবাজারের ইতিহাসে প্রথম।  অভিযোগপত্র দাখিলকারী তদন্তকারী কর্মকর্তা রাষ্ট্রপক্ষের ৬৫নং সাক্ষী সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলাম  সাক্ষ্য প্রদান করেন ২ঘন্টা, কিন্তু তাকে আসামীর পক্ষে ৫দিন ধরে জেরা করা হয়েছে যা কোন তদন্তকারী কর্মকর্তার দীর্ঘতম জেরা। দায়রা জজ আদালত ২দিন ব্যাপী আসামীদের বিরুদ্ধে আদালতে হলফপূর্বক গৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণ পড়ে আসামীদের শুনিয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা করেন, তাদেরকে সাফাই সাক্ষী দেবেন কিনা, কাগজপত্র দেবেন কিনা, সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রেক্ষিতে কিছু বলার আছে কিনা এক এক করে সকল আসামীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। ডকের আসামীরা লিখিত জবানবন্দি দেবেন বলে আদালতকে জানান। কক্সবাজারের ইতিহাসে কোন মামলায় প্রথম ২দিন ব্যাপী আসামীদের ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় জবানবন্দি গ্রহন করা হয়েছে । কক্সবাজারের দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ৪জন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন। এম,এম,রুহুল আমিন বাংলাদেশের সুপ্রীমেকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। অতীতে কক্সবাজারের কোন দায়রা জজ দুই দিন ব্যাপী আসামীদের কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা করেন নাই। এটাও প্রথম রেকর্ড। আসামী প্রদীপ কুমার দাশ ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় ৭ পৃষ্টার দীর্ঘ লিখিত জবানবন্দি ও তৎসাথে ৩৬৫পৃষ্টা কাগজপত্র দাখিল করেছেন যা কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বিচার চলাকালে এত অল্প সময়ের মধ্যে আসামীগণ বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৬৫টি দরখাস্ত আদালতে দাখিল করেছেন যা পাঠ করলে প্রতীয়মান হবে যে দরখাস্তগুলি বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করার জন্য করা হয়েছে। এটাও কক্সবাজারের ইতিহাসে প্রথম। কোন হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান ও পুলিশ বাহিনীর প্রধান এক সাথে কক্সবাজার সফর করার নজিরও প্রথম।
বিগত ৩১/৭/২০২০খ্রিঃ তারিখের ঘটনার জন্য গত ৫/৮/২০২০ খ্রিঃ তারিখ বাদী নালিশী দরখাস্ত দাখিল করেন সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে এবং বাদীর প্রার্থনামতে মামলাটি এজাহার হিসাবে গণ্য করে র‌্যাব-১৫ কে তদন্তভার দেওয়ার নির্দেশ দিলে ৬/৮/২০২০খ্রিঃ তারিখ মামলাটি টেকনাফ থানায় এজাহার হিসাবে রেকর্ড করা হয়। তদন্ত শেষে এজাহারনামীয় ৭জন ও তদন্তে সাক্ষ্যপ্রমাণে পাওয়া ৮জন সহ মোট ১৫ জন আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। দায়রা জজ আদালতে মামলার কগনিজেন্স নেওয়া হয় ১/৪/২০২১খ্রিঃ তারিখ। আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ২৭/৬/২০২১ খ্রিঃ তারিখ। বিগত ২৩/৮/২০২১ তারিখ বাদীর সাক্ষ্য গ্রহন করার মাধ্যমে শুরু হয়ে ৮ পর্বে ২৪ কর্মদিবসে  ১/১২/২০২১ তারিখ বেলা ১টার সময় পর্যন্ত মোট ৬৫জন সাক্ষীর সাক্ষ্যজেরা গ্রহন করে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহন সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। মাত্র ৩মাস ৮দিনের মধ্যে এত অল্প সময়ে এত বেশী সাক্ষীর সাক্ষ্যজেরা গ্রহন করা এটাই প্রথম। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭১(২) ধারায় উল্লেখ আছে (১) উপধারায় যাই থাকুক না কেন ফরিয়াদী বা সাক্ষী মামলা শুনানী কালে যাতে আদালতে হাজির হয় তা নিশ্চিত করা পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব হবে। এই মামলার আসামী পুলিশ অফিসার হওয়ায় তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব সেই দায়িত্ব সফলভাবে ও সুন্দরভাবে পালন করেছেন বিধায় এত দ্রুত রাষ্ট্রপক্ষের ৬৫জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন করা সম্ভব হয়েছে। এটাও কক্সবাজার দায়রা  জজ আদালতের ইতিহাসে প্রথম। এই মামলায় ৪ দিন ধরে রাষ্ট্রপক্ষ,বাদীপক্ষ ও আসামীর পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানী হয়েছে। আসামীর পক্ষে ১০৩ পৃষ্টা লিখিত যুক্তিতর্ক,রাষ্ট্রপক্ষে ৯৪পৃষ্টা লিখিত যুক্তিতর্ক ও বাদীর পক্ষে ১৯৫পৃষ্টা লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করা হয়েছে। কোন হত্যামামলায় দীর্ঘ ৩০০ পৃষ্টার রায় ঘোষণার মাধ্যমে ২জন প্রধান আসামীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ,৬জন সহযোগী আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ ও অপর ৭জন সহযোগী আসামীকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন,যা কক্সবাজারের হত্যা মামলার রায়ের ইতিহাসেও নতুন নজির স্থাপিত হল। 
এই মামলা সংক্রান্তে ২জন মহিলার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একজন হলেন নিহত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস যিনি বাদী হয়ে ৯জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে মামলা করেছিলেন। তিনি মামলা না করলে হত্যাকারীদের দ্বারা ঘটনার পর দিন টেকনাফ থানায় পরিকল্পিতভাবে দায়েরকৃত ২টি মামলা ও রামু থানায় দায়েরকৃত ১টি মামলায় সিনহা হত্যার প্রকৃত সত্য ধামাচাপা পড়ে যেত,হত্যার প্রকৃত বিচার হত না। অন্য মহিলা হলেন সৎ সাহসী ম্যাজিষ্ট্রেট তামান্না ফারাহ। তিনি শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের  পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত নালিশী দরখাস্তটি গ্রহনকরতঃ তা এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দেওয়ার ও র‌্যাব-১৫ কে তদন্তভার দেওয়ার পর থেকে টেকনাফ এলাকায় পুলিশের ক্রসফায়ারে  আর কোন নাগরিক নিহত হন নাই। এর আগে প্রশাসনিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩জন নাগরিককে ক্রসফায়ারের অজুহাতে হত্যা করা হয়েছিল, হত্যাকারীদের বিচার হয় নাই। সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে সিনহা হত্যা মামলা দায়ের ও যথাযথভাবে বিচার করে দন্ডিত করা না হলে এতদিনে আরো শত শত মানুষ তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে নিহত হতেন বলে আমজনতা মনে করেন।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।

আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.