গত কিছু দিন ধরে ইউটিউবে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা শিল্পীদের দেশাত্মবোধক গান বেশী বেশী শুনা যাচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিরাজমান পরিস্থিতিতে আরাকানে নিজের বাড়ীভিটিতে ফিরে গিয়ে মাতৃভুমি উদ্ধার ও রক্ষা করার সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কে দেশীবিদেশী মিডিয়ায় ও সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত ১৪ মার্চ ২০২৫ জাতিসংঘের প্রধান ব্যক্তি, মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস কক্সবাজার জেলার উখিয়ায় কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাখের অধিক রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়ে ইফতার করেছেন। লক্ষাধিক রোজাদার নিয়ে এত বড় ইফতারের ইতিহাস এই দেশে নাই। ইফতার পূর্ব রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে টানা ৫ মিনিটের অধিক ড.মুহাম্মদ ইউনুস চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বা চাটগাঁইয়া ভাষায় ভাষণ দিয়েছেন। কক্সবাজারের ভাষাও চাইগাঁইয়া ভাষার মত। আবার চাটগাঁইয়া ভাষার সাথে রোহিঙ্গাদের ভাষার অনেক মিল আছে। রোহিঙ্গারা শুদ্ধ বাংলাভাষা বুঝতে না পারলেও সহজেই চাটগাঁইয়া ভাষা বুঝেন। তাই তিনি রোহিঙ্গাদের তার ভাষণের অর্থ বুঝতে যাতে সহজ হয় সেজন্য আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত দরদ দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন,রোহিঙ্গারাও তাদের একজন পরম আপনজনের কথা মন দিয়ে শুনেছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা ও ঘনিষ্টতা দেখানোর জন্য রোহিঙ্গারা সাধারণত যে ধরনের টুপি মাথায় দেন সে ধরনের একটি টুপিও মাথায় দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসও বাংলাদেশী মুসলমানদের মত পাঞ্জাবী পরিধান করেছিলেন বাংলাদেশীদের সাথে একতা ও মমত্ব দেখানোর জন্য। ড.ইউনুস ভাষণে বলেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুরব্বী সংস্থা জাতিসংঘের প্রধান নেতা মহাসচিব গুতারেসের বিশ্বের শত শত দেশের নানান সমস্যা,যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যাপক ব্যস্থতা সত্ত্বেও ড.ইউনুসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাদের ও আশ্রয়দাতা কক্সবাজারবাসীর দুঃখকষ্টের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করার ও একাত্বতা ঘোষণার জন্য পবিত্র রমজান মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের সাথে ইফতারে অংশগ্রহন করেছেন। মহান অতিথিকে সকলে হাততালি দিয়ে ধন্যবাদ,শুকরিয়া জানিয়েছেন। ড. ইউনুস আশা প্রকাশ করেছেন যে এই ঈদে না হলেও আগামী বছর ঈদে রোহিঙ্গারা নিজেদের মাতৃভূমি আরাকানে নিজেদের বসতবাড়ীতে ফিরে গিয়ে দাদা-দাদী,নানা-নানীর কবর জিয়ারত করে কবরের পাশে গুতেরেসকে সাথে নিয়ে ইফতার করার জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন। এখন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা বিশ্ববাসীর মাথার উপর বিরাট বোঝা। তারা নিজ দেশে,নিজ বাড়ীতে ফিরে গিয়ে ফেলে আসা উর্বর জমিতে প্রচুর খাদ্যশস্য উৎপাদন করে বিশ্ববাসীর বোঝা হালকা করবেন। বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গারাই সাহায্য করবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের বক্তৃতার প্রভাবে রোহিঙ্গারাও এখন সত্যিই বাড়ী ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে,প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই বক্তব্যের পরে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়েছে আরশার প্রধান জুনুনীকে নারায়নগঞ্জ থেকে কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে একাধিক মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জুনুনীর নাম ঠিকানা অবস্থান সঠিকভাবে তদন্তে পাওয়া না যাওয়ায় তাকে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি এখন অন্যান্য অভিযোগপত্রভুক্ত আসামীদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার অতিরিক্ত দায়রা জজ ১ম আদালতে বিচারাধীন,সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহন করা হচ্ছে। জুনুনী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকায় তাকে আইনানুগভাবে মহিবুল্লাহ হত্যা মামলায় আবার অর্ন্তভুক্ত করার জন্য অধিকতর তদন্ত করে,সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের জন্য রাষ্ট্রপক্ষে দরখাস্ত করা হচ্ছে বলেও শুনা যাচ্ছে। কক্সবাজারস্থ ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যারা স্বদেশ আরাকানে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে ইচ্ছা প্রকাশ করতো বা কাজ করতো তাদেরকে আরশা হত্যা করতো। আরশা মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর এজেন্ট হিসেবে তখনও কাজ করতো এখনও কাজ করে যাচ্ছে জান্তা বাহিনীর নির্দেশে,জান্তা বাহিনীর স্বার্থে। তাই বর্তমানে জুনুনী কারাগারে থাকায় ও তারা আরশা বাহিনীকে আর হুমকী মনে না করায় সাধারণ রোহিঙ্গারা আরাকানে ফেরত যেতে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালাতে,নিজেদের বাসতবাড়ী,জমিজিরাত উদ্ধার করে মাতৃভুমি রক্ষা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত গত শুক্রবার ব্যাংঙ্ককে বিমসটেকের ষষ্ঠ সম্মেলনের ফাঁকে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানকে জানান যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য চিহিৃত করেছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ। আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে চুড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলমান। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবসনের জন্য ২০১৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ছয়টি ধাপে আট লাখ রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্ত বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। প্রত্যাবাসনে দীর্ঘ নীরবতার কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে বাকী রোহিঙ্গাদের তালিকা হস্তান্তর করে নাই। যখন জান্তা সরকারের হাতে আরাকান রাজ্যের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও সুযোগ ছিল তখন প্রায় আট বছরের মধ্যে বিভিন্ন তালবাহানায় প্রতারণামূলক আচরণের মাধ্যমে নিয়ানমার সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করে নাই। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অপ্রত্যাশিত ঘোষণার পর কক্সবাজারে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা প্রশ্ন করছেন তাদেরকে কোথায় প্রত্যাবাসন করা হবে? বর্তমানে আরাকান রাজ্যে জান্তা সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও দখল নাই। সশস্ত্র বিদ্রোহী আরাকান আর্মি প্রায় ৯০ শতাংশ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। জান্তার সৈনিকরা আরাকান আর্মির সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছে,আত্মপমর্পণ করেছে বা পালিয়ে গেছে। প্রচুর গোলা বোমা নিক্ষেপ করে গণহত্যা চালানোর পরও জান্তা বাহিনী আরাকানে হারানো কোন এলাকা পুনদখল করতে পারে নাই। আরাকানে জান্তা বাহিনী যেখানে নিজেরাই আরাকান আর্মি কর্তৃক বিতাড়িত, নৌ-বাহিনী,বিমান বাহিনী ব্যবহার করেও হারানো অঞ্চল পুনরায় দখল করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেখানে রোহিঙ্গাদের কিভাবে,কোথায় তারা প্রত্যাবাসন করবে?
এখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জান্তা বাহিনী থাকায় তারা সহজেই ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক ঘোষণা করতে পারে। নিয়ত ভাল হলে, সদিচ্ছা থাকলে তা করে নাই কেন? বর্তমান বাংলাদেশ অর্ন্তবর্তী সরকারের কুটনৈতিক চাপে বাধ্য হয়ে ও ভুমিকম্পে লন্ডভন্ড হওয়ার কারণে বর্হিবিশ্বের সহানুভুতি পাওয়ার অপকৌশল হিসেবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রতারণামূলক ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শরণার্থী প্রত্যাবাসন অবশ্যই নিরাপদে,স্বেচ্ছায়,সসম্মানে ও টেকসই হতে হবে। আরাকান রাজ্যে এখনও প্রায় ৪/৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
ব্যাংঙ্ককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যে আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ইউএনডিপির সতর্কবার্তার মধ্যে রাখাইন থেকে আরো বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করার জন্য জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাখাইনে একটি মানবিক চ্যানেল স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।