১৭ রমযান: ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রেরণাদীপ্ত চেতনার স্মারক

১৭ রমযান: ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রেরণাদীপ্ত চেতনার স্মারক
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর :

আজ ঐতিহাসিক ১৭ রমযান। ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম রক্তস্নাত মহাসংগ্রাম ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধের প্রেরণাদীপ্ত চেতনার স্মারক এই ১৭ রমযান। এটি ছিলো মুসলিম ও কুফরী শক্তির মধ্যে সংঘটিত সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী প্রথম বড় যুদ্ধ। তাই ইসলামের ইতিহাসে মাহে রমযানের এই দিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ও চেতনায় দীপ্তিমান।
দ্বিতীয় হিজরী সনে মাহে রমযানের রোযা ফরয হয়। আর সে বছরই ১৭ রমযান সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। ইতিহাসে দিনটি বদর দিবসও হিসেবেও অবিস্মরণীয়।
হযরত রাসুলে কারীম স. নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর দীর্ঘ ১৩ বছর মক্কাতুল মোকাররমায় অতিবাহিত করেন। এরপর তিনি আল্লাহ তা'আলার হুকুমে মদীনায় হিজরত করেন। সেখানে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান মদীনা সনদ প্রণয়ন করে নবভী আদর্শে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক মদীনা রাষ্ট্র।

হিজরতের দ্বিতীয় বছরেই নবীজী স. এর নেতৃত্বে গঠিত সে মদীনা রাষ্ট্র মক্কার কাফের শক্তির হুমকির সম্মুখিন হয়। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের মাধ্যমে রাসুলে কারীম স. এর নেতৃত্বে সাহাবায়েকেরামের ঈমানদীপ্ত কাফেলা কুফরী শক্তির সে হুমকিকে নস্যাৎ করে দেন।
ইতিহাস বলছে, মক্কার কাফেরদের একটি বাণিজ্য কাফেলা মদীনা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মুসলিম শক্তির প্রতিরোধের মুখে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন মক্কার এক হাজার কাফের সেনার একটি সশস্ত্র দল মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত বদর প্রান্তরে এসে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে। এ অবস্থায় হকের পক্ষে মাত্র ৩১৩ জন নিরস্ত্র সাহাবী যোদ্ধা বদর ময়দানের আরেক প্রান্তে উপস্থিত হন। যাঁদের মধ্যে মক্কা থেকে আসা মুহাজির ও মদীনায় বসবাসরত আনসারী সাহাবীগণ ছিলেন। সঙ্গে দু’টি ঘোড়া, ৭০টি উট আর যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অল্প কয়েকটি ঢাল-তরবারি। অপরদিকে কুফরী শক্তির পক্ষে সশস্ত্র ১ হাজার যোদ্ধা। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো ৩০০ ঘোড়া আর ৭০০ উট।
বিপুলভাবে অসম এ যুদ্ধ ছিলো বিকাশমান মুসলিম শক্তির অস্তিত্ব রক্ষার এক মহাসংগ্রাম। ফলে আল্লাহ তা’আলার প্রিয় হাবিব, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ স. আল্লাহর দরবারে নিবিষ্ট চিত্তে মুনাজাত করে সাহায্যের আবেদন করতে থাকেন। মহান রবের দরবারে হৃদয় উজাড় করা আবেগ, আকুতি দিয়ে মুনাজাতে তিনি বলেন, এ যুদ্ধে মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি পরাজিত হলে আল্লাহকে স্মরণ করার লোক দুনিয়ায় থাকবে না। প্রিয়তম হাবিবের ফরিয়াদ কবুল করে আসমানী নুসরতের মাধ্যমে রাব্বে কারীম অসম এ যুদ্ধে মুসলমানদের অভূতপূর্ব বিজয় দান করেন। এ মর্মে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। -(সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৩)।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়েকেরামের মধ্যে শহীদ হন ১৪ জন আর কাফেরদের মধ্যে উৎবা, শাইবা, আবু জেহেলের মতো শীর্ষ কাফেরসহ প্রায় ৭০ জন নিহত হয়। বন্দি হয় আরও ৭০ জন।
বদর যুদ্ধের এমন অভূতপূর্ব বিজয়ে মুসলমানদের ভিত অধিকতর দৃঢ় হয়। সঞ্জীবিত হয় অফুরন্ত ঈমানী শক্তি ও ভুবনজয়ী প্রেরণা।
ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমযান সংঘটিত বদর যুদ্ধের এ তাৎপর্য অনন্যতায় চিরভাস্বর হয়ে আছে। ইসলামে বদর যুদ্ধের মুজাহিদ সাহাবায়েকেরামকে গণ্য করা হয় সবচেয়ে মর্যাদাবান শ্রেণি হিসেবে। সে যুদ্ধে বদরের প্রান্তরে সাহাবায়েকেরাম আত্মনিবেদনের যে উজ্জ্বল অনুশীলন করেছেন, তার সঙ্গে রমাযানের আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম, আল্লাহর হুকুম পালনে আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের অপূর্ব এক সাদৃশ্য বিদ্যমান।
আত্মশুদ্ধি, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা, আল্লাহর দরবারে আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের সব অধ্যায় যে একই সূত্রে গাথা তার এক মহান স্মারক বদর যুদ্ধের চেতনাদীপ্ত ১৭ রমযান। বদর যুদ্ধের সামগ্রিক শিক্ষা ও চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বাতিলের মোকাবিলায় অগ্রণী হওয়া এবং নবভী আদর্শে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোকে ঢেলে সাজানোই হোক মু'মিন-মুসলামনদের ঈমানদীপ্ত অঙ্গীকার।
লেখক : খতীব, শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.