কষ্ট মিষ্ট

কষ্ট মিষ্ট
খালেদা বেগম জ্যোৎস্না :

সুজন ভাই কি তোর হাই লাগে? তোরে গম বেশী দেয় আমারে কম। সুজন তো লজ্জায় এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। লিজা এসে মিটমাট করে দিল। জানতাম না হাই মানে স্বামী বা প্রেমিক। এক এক জায়গার ভাষা ভিন্ন ভিন্ন। কথায় বলে কোনো দেশের বুলি, কোন দেশের গালি। সিলেটে গিয়ে যদি বলেন আমাকে একটা পুরি দেন, আপনার রেহাই নাই। মেয়েদের ওরা পুরি বলে। আর চাঁটগার ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে ভাষার ভিন্নতা যা চাঁটগাইয়ারা জানে। আর সমস্যাটা হচ্ছে ডব্লিউএফপির ভিজিডির গম নিয়ে। কিন্তু এ গমের ভাগীদার নারীরা হতে পারতো না, স্বামী বা শাশুড়ি (ঐ প্রোগ্রামের সব বেনিফিসিয়ারি ছিল নারী আর তাদের আট বছর বয়সী সন্তানরা) অফিসের বাইরে দাড়িয়ে থাকতো সে গম নেওয়ার জন্য। নারীর ক্ষমতায়নের প্রোগ্রামে বরং নারীদের ক্ষমতাহীন আর কেউ যদি না বলতো নির্যাতনের শিকার হতো।কি অদ্ভুত পরিহাস!
একদিন সকালে অফিসে দেখি ফিরোজা (বেনিফিসিয়ারি) কেঁদে কেঁটে অস্থির। কারণ তার স্বামী ঘুমের মধ্যে বাম হাতের বুড়ো আংগুলের টিপ নিয়েছে, দ্বিতীয় বিয়ে করবে আর করলে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি আছে তা দেখানোর জন্য। সে যখন ঘুম থেকে উঠে দেখে জানতে চায় তখন রিক্সার শিকল দিয়ে মেরে শরীরের অবস্থা দেখার মতো না। হাসপাতালে পাঠিয়ে, স্বামীকে কি ভাবে মোটিভেশন দেওয়া যায় তার আলোচনায় বসলাম। যাই হউক তাকে দ্বিতীয় বিয়েতে বিরত রাখা গেল। স্বামী ভদ্রলোক এ বিষয়টি জানতে পেরেছেন, ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে। সার্ভে করে জানা গেল শুধু নারীদের শিক্ষা দিলে হবে না, স্বামীদেরও প্রোগ্রাম সর্ম্পকে সচেতন করতে বেনিফিসিয়ারিদের বলা হলো তাদের স্বামীদের অফিস আসার জন্য। দেখি কেউ আসেন না, বস্তিতে ছড়িয়ে গেছে অফিসে গেলে বড় আপা সবাইকে লাইগেশন করাই দিবে। এ ভয়ে কেউ আসবে না। এখন বড় আপাকে ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝাতে হলো, এবং কথা দিতে হলো বিষয়টি আসলে কি, কেন, সাথে পরিবারের কি সুফল হবে। শেষ পর্যন্ত দশ বার জনের গ্রুপ করে ওরিয়েন্টেশন শুরু করা গেল। শিডিউল অনুযায়ী সেশন চলছে। ভেজাল এখানে শেষ না, পারিবার পরিকল্পনা সেশনে ছোট পরিবার সুখী পরিবার, যা এখন অনেকেই জানে।তখন এতো প্রচার ছিল না, ফলে আবার সুজন ভাইয়ের সমস্যা, কারণ এর মধ্যে বেশ কয়েকজন তালাক দিয়ে ফেলেছে। সেশনে বলা হয়েছে ছোট পরিবার মানে সুখী পরিবার, আর কিছু কিছু জায়গায় ছোট পরিবার মানে ছোট স্ত্রী, সুতরাং সুখী হতে হলে ছোট স্ত্রীর প্রয়োজন। কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে দাড়াল! যাদের সাথে কাজ করবেন, যাদের জন্য কাজ করবেন, তাদের মন মানসিকতা, ভাষা না বুঝে কাজ করলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। তবে আজকাল এসব লাগে না। আত্মীয়, টুস টাস ইংলিশ আর যা লাগে বা করে, তা না বলা উত্তম। প্রচন্ড রোদে, ভাসিয়ে নেওয়া বৃস্টিতে কয়জনা যায়? ঘরে বসে, গাছের তলায়, মিটিং এ সব সারিয়ে নেওয়া যায়, তবে গণহারে না।
আমার এক ম্যানেজার নতুন কিছু একটা করে হেড অফিসের সবাইকে চমক দিবে, তাই প্রায় দেখি লেখালেখি করছে মনোযোগ সহকারে, কেউ কোন কাজে গেলে বিরক্ত হন। যাই হোক ঢাকায় যথা সময়ে মিটিং এর তারিখ সময় মতো, ম্যানেজার আর আমি উপস্থিত। মিটিং শুরু হলো। বিভিন্ন কর্ম এলাকার অগ্রগতি, সমস্যা তার সমাধান, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আলোচনার পর, আমাদের পালা। যথারীতি ম্যানেজার সাহেব শুরু করলেন। জানালেন উনি একটা নতুন প্রস্তাব করবেন, সবাই শুনতে আগ্রহী। শুরু করলেন পরিবার পরিকল্পনার বিষয় এবং বিভিন্ন মেথডের কথা যেমন কনডম, পিল, নরপ্লান্ট, লাইগেসন, ভ্যাসেকটমি পরে  যা বললেন তা হলো উনি সেন্টারে প্র্যাকটিক্যাল ডেমোনেস্ট্রসন করে দেখাবেন, আর যায় কোথায়! সবাইর হাসাহাসি, চোখ টেপাটেপি দোষে পড়লাম আমি কেন পড়ে দেখিনি? সবাই আমাকে ঘিরে জানতে চাইছে, আপা কি ভাবে প্রজেক্টটা করবেন? আর করার সময় আমাদের ইনভাইট করবেন, আমরা দেখতে ও বুঝতে চায়! আমার অবস্থা একটু বুঝার চেষ্টা করেন!

দশটা এগারোটার দিকে আমরা হালকা টিফিন করতাম, যেমন ছমুছা, সিংগারা, কেক সাথে চা, কফির প্রচলন ছিল না, দেখি সীমা দৌড়ে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে প্রি স্কুলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলো, আপা জানেন, ছোট ছেলে মেয়ে দু জন কি করছে, জানতে চাইলে জানালো রাতে যা দেখেছে তা তারা করছে, গিয়ে দেখি সারি সারি বাচ্ছাদের মাঝে ওরাও বসে আছে, কি নিষ্পাপ চেহারা কিছু বুঝার উপায় নাই। সীমাকে বললাম, ওদের মা বাবাকে ডেকে সাবধান করার জন্য। বস্তিতে থাকে যেখানে এক রুমে মা বাবা, ছেলে মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, চৌকির উপরে, নীচে, কাপড়ের পার্টিসন দিয়ে থাকে, সেখনে প্রাইভেসি বা লজ্জা কোথায়! যা পুরানো সিনেমায় দেখতাম, বস্তির মেয়েরা কলসী নিয়ে নাচতে, গণ টয়লেটের পিছনে প্রেম করছে, বাস্তবে দেখার পর বুঝলাম এসব ঘটে। এদের আবার মজার বিষয় কোন একটা উপলক্ষ্য নিয়ে রং ছুড়াছুড়ি, ঝলমলে কাপড়ের সাজ, কোন বাচ্চাকে মা বাবা শাস্তি স্বরূপ বাসায় জায়গা, খাবার না দিলে পাশের বাড়ির লোকজন থাকতে এবং খাবার দেয়, কোন বাচ্চার মা বাবা মারা গেলে অনেকেই এগিয়ে আসে তাদের দায়িত্ব নিতে, যা ঝুপড়ি বাসিরা করে তা দালানবাসিরা করে না। মানবিকতা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ!
সে অফিসের সময় ছিল সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা। অফিসের পর সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তো, কিন্তু ম্যানেজার ঐ সময় মিটিং ডাকতো। বিরক্ত হয়ে আমরা এর কারণ বের করার চেস্টা করে যা পেলাম তা না বলাটা বেহতর!
বিষাদের ঘটনার বেশ অভিজ্ঞতা আছে, ঐ অফিসে কোন কোন সময় কারণবশত কর্মী ছাঁটাই হতো, এরকম ছাঁটাইয়ের চিঠি নিয়ে জয়তী আমার কাছে এসেই বেহুশ হয়ে পড়ে যায়, সবাই ধরাধরি করে পাশের হাসপাতালে নিয়ে যায়। লেডি ডাক্তার দেখার পর জানালো ওর পেটের পাঁচ মাসের বেবীটা নস্ট হয়ে গেছে, স্বামী স্ত্রী কান্নাকাটি করছে যা দেখে আমাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি।
জাভেদ দারোয়ান এসে জানালো মিলা আপার কাউসিলিং রুমে কি হচ্ছে জানি না, তবে সবাই কান্নাকাটি করছে। হুড়াহুড়ি করে গিয়ে দেখি প্রায় ১০ থেকে ১২ জন বাইশ থেকে পচিশ বছরের মেয়ে কান্নাকাটি করছে। কারণ তাদের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করছে, কারণ জানতে চাইলে মিলা জানালো এদের সবার জরায়ু বের হয়ে গেছে, তাই এ ঘটনা। প্রশ্ন করলম কি ভাবে এ ঘটনা ঘটলো, যা জানতে পারলাম তা অমানবিকতা ছাড়া কিছুই না। ডেলিভারির সময় গ্রাম্য ধাত্রীরা ডেলিভারির ব্যাথা উঠলে পেটের উপর পা দিয়ে জোরে চাপ দেয়, এতে বাচ্চাসহ জরায়ু বের হয়ে আসে। কিন্তু ঐ বিদ্যা তাদের নেই পরবর্তীতে কি ব্যবস্থা নিতে হবে। কি বলবো বুঝতে না পেরে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। পরে এ বিষয় জানানোর পর ধাত্রী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চাকরী মানুষকে অনেক কিছু দেয় আবার যা কেড়ে নেয় তা ফেরত পাওয়া যায় না। যেমন মেয়েরা মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে বহু চিকিৎসার পরেও অনেকে মা হতে পারেননি। অফিসের কারণে বিভিন্ন জায়গায় মেয়ে ছেলে উভয়কে যেতে হতো, এতে অনেককে স্বামী ত্যাগ/তালাক দিয়েছে। শারীরিক অত্যাচার করেছে, অনেককে চাকরী ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। যে রাস্তায় এনজিওর মেয়েরা যায় সে রাস্তায় পুরুষ চলা ফেরা নিষিদ্ধ। একটা সময় ছিল ফ্যামিলি প্লানিংয়ে লুকিয়ে চাকরি করতে হতো, তেমনি এনজিওর চাকরি ছিলো মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ। আত্মীয় স্বজনরা বাঁকা দৃস্টিতে দেখতো, আর এখন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
একবার রিজার্ভ বাসে করে অফিসের সবাই মিলে সুন্দরবন যাচ্ছি। বাসে বাদাম, চানাচুর, ঝালমুড়ি, আমড়া, পিয়াঁজুওয়ালারা  উঠানামা করছে এর মধ্যে এক এক জন পিছনের সারি থেকে জানান দিচ্ছে কে কি খাবেন, নিয়ে নিতে পারেন টাকার চিন্তা করবেন না। এর মধ্যে একজন সিদ্ধডিম বিক্রি করতে উঠেছে, আমাদের টীমের সিনিয়র এক ডাক্তার ডিম কিনে সবাইকে বিলাচেছন আর উনি নিজে ডিমের সাদা অংশটা খাচ্ছে আর ডিমের কুসুমটা বিক্রেতাকে খাওয়াচ্ছে। বেচারা একটার পর একটা খেতে গিয়ে গলায় আটকে গিয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। বেগতিক দেখে অনেকে বেচারাকে পানি, পিঠ মালিশ, মুখে পানির ছিটা দিয়ে সুস্থ্য করে তোলে। ভালই টাকা দিয়ে কয়েকজন মিলে বাস থেকে নামিয়ে দিল, বেচারার দৌঁড় দেখে মনে হলো সে কোন রকমে প্রাণে বাঁচছে, আমাদের কেউ ডাক্তার সাহেবকে খোচা দিচ্ছে, কেউ আফসোস করছে, আবার কেউ বেচারার দৌড় দেখে হাসছে। ঘটনার পরে বাসের অন্যরা যখন পোগ্রামের, বাড়ীর, ছেলেমেয়ের, রাজনীতির আলাপে যখন মগ্ন তখন হোসেন ভাই সংসদের স্পিকারের ভূমিকায় নাজিল হলেন। উনার বাচন, প্রশ্ন, উত্তর সত্যিকারের স্পিকারকে হার মানায়। এ ভাবেই রাত পার করে রূপসা ঘাটে পৌঁছলাম। যেখান থেকে সুন্দরবন যাওয়া হবে মূল গন্তব্য আর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্ট্রেটেজি করা। বাসে ঘাটে বেংগল ট্যুর ট্রাভেলসের মিডিয়াম সাইজের শীপ অপেক্ষা করছে। এক অমায়িক ভদ্রলোক সমাদরে আমন্ত্রণ করতে দাড়িয়ে আছেন। আমরা শৃঙ্খলার সাথে শীপে উঠলাম। আমাদের সাথে কয়েকজন বিদেশীনি ছিলেন।
শীপ চলা শুরু করলো, আমরা ফ্রেশ হয়ে জড়ো হলাম, সবাইকে সিডিউল দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো যা সচরাচর হয়ে থাকে। মজার বিষয় সাদা চামড়ায় রোদের আলোর জন্য স্বল্প বসনা ছিল, পুরুষ সহকর্মীগন কানে কানে বলছে, আপা, মাথা শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে, ঘিলুতে কিছুই ঢুকছে না। দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, চুপ থাকা ছাড়া উপায় নাই। যাই হোক রাতে ডিনারের পর যে যার কেবিনে শুতে গেলে আর চারিদিকে হৈ চৈ, ঘটনা প্রোগ্রামের চীফ কাঠের পাটাতনের ফাকে পানিতে পড়ে গেছেন। পুরুষ সহকর্মীরা কোন ফাকে লাল পানি (বুঝে নিয়েন) নিয়ে একটা ছোট্ট রুমে রেখেছে, যা শুধু তারাই জানেন। নারী সহকর্মীদের ডিনারের পর শুভ রাত্রি জানিয়ে ওনারা আসরে বসেছেন। কেউ কেউ বেসামাল হয়ে পড়েছেন যাদের মধ্যে উনিও একজন। কোন রকমে রাত পার করে সকালে সমুদ্র দেখতে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন লোনা পানিতে সঠান শুয়ে আছেন, শুধু হাতের ইশারায় জানালো চুপ থাকতে! বুঝলাম রাতের গরম তখনো কাটেনি। চাকরী জীবনে দেখলাম কেউ হাত বাড়িয়ে দেয় উপরে উঠার জন্য যেমন আমার তিন জন গুরু আছেন যাঁরা বাংলা কম্পিউটিং শেখার বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন, আবার কেউ হাত দিয়ে কি ভাবে নীচে নামানো যায়, তার প্রচেস্টা চালিয়ে যায়। আগুন যেমন চেপে রাখা যায় না, কারো দক্ষতাও দমিয়ে রাখা যায় না। চলুক না এ অসম প্রতিযোগিতা, কারণ এটাই মনুষ্য চরিত্র!
আরো অনেক কথা ঝুলিতে আছে যা পর্বের পর পর্ব লিখা যায়। আপনাদের ধৈর্য্য হবে কি?
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.