শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের ও বাংলাদেশের ক্ষতি করেছেন

শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের ও বাংলাদেশের ক্ষতি করেছেন
বেশ কয়েক মাস ধরে প্রতিবেশী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে বিকট শব্দে বাংলাদেশের টেকনাফ এলাকা কেপে উঠতো,অনেক মাটির ঘরে ফাটল ধরেছে। এখন আর তেমন বড় গোলাগুলি, মটার, বোমার শব্দ এই পারে বাংলাদেশে শুনা যাচ্ছে না। তবে রাখাইন রাজ্যের আকাশে এখনও আগুনের কুন্ডলী দেখা যাচ্ছে। মন্ডু শহর সহ রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে ছাড়া প্রদেশের প্রায় সকল অঞ্চল আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেল সহ শত শত জান্তা সৈনিক আরাকান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানা যায়। শেষ পর্যায়ে জান্তা বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসাবে যুদ্ধরত রোহিঙ্গাদের আরসা,আরএসও সদস্যরা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের কঠোর অবস্থানকে ফাঁকি দিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার তথ্য মতে অতিরিক্ত ৬০ হাজার রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আগের রোহিঙ্গাদের সাথে মিশে গেছে।
 বার্মিজ সেনাবাহিনী ১৯৬২সালে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে ’ডিভাইন এন্ড রুল’ নীতি অনুসরণ করে ক্ষমতায় থাকার লক্ষে আরাকানে হাজার বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে রাখাইনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছিল। জান্তাবাহিনী শুরু থেকে প্রচার করছিল রোহিঙ্গা মুসলমানরা বার্মার অরিজিনাল বাসিন্দা নয়। তারা কোন এক সময় বাংলা থেকে বার্মায় অনুপ্রবেশ করে বসবাস করতে শুরু করে এখন পর্যন্ত অবৈধভাবে বসবাস করে আসছে। জান্তাবাহিনীসহ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বা রাখাইনরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘৃণা করে আসছিল। এই উছিলায় মাঝে মাঝে নানা অজুহাতে মুসলমান-রাখাইন দাঙ্গা লাগিয়ে দিত সেনাশাসকরা। সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনরা মিলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯২ সালে পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ববাসীর প্রতিক্রিয়া দেখে পরে আবার রোহিঙ্গদের তাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকার করেই ইউএনএইচসিআর এর সহায়তায় স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে নিজ বসতবাড়ীতে পুনরায় বসবাস করে নিজেদের জমিতে চাষবাস করার সুযোগ দিয়েছিল। সেনা শাসকরা ১৯৮২ সালে নাগিরকত্ব সংক্রান্ত আইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নাই। উগ্ররাখাইনদের সহায়তায় বার্মিজ সেনাশাসকরা পরিকল্পিতভাবে আবার ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন অজুহাতে নির্যাতন শুরু করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করে। সেনাশাসকরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়ার ৫০বছরের লালিত স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার সুযোগ পেয়ে যায় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়ে ঘোষণা করেন যে আমি বাংলাদশের আঠারো কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে আশ্রিত রোহিঙ্গাদেরও খাওয়াতে পারব। মিয়ানমারের সেনাশাসকরা এত দিন যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল শেখ হাসিনার ঘোষণায় সেই সুযোগ পেয়ে অধিক উৎসাহিত হয়ে রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা,ধর্ষণ,নির্যাতন,বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়ে আশ্রয়হীন করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। অভিজ্ঞ মহল মনে করেন শেখ হাসিনা এমন আত্মঘাতি ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের পাহাড়-পর্বত, গাছ-গাছালি, বন-জংগল কেটে রোহিঙ্গাদের জন্য যদি আশ্রয় শিবির প্রস্তুত না করতেন তবে একেবারে প্রায় ১২লাখ রোহিঙ্গাকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভবনা শেষ করার জন্য বাড়ীভিটি জ্বালিয়ে দিয়ে বোলড্রোজারের সাহায্যে সমতল করে সনাক্ত করার অযোগ্য করে তড়িঘড়ি করে চীন,ভারতকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে ভাগবাটোয়ারা করে দিত না। শেখ হাসিনার অপ্রত্যাশিত ঘোষণায় বর্মি সেনাশাসক ও উগ্রবাদী রাখাইনরা এত ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর জ্বালিয়েপুড়িয়ে নিচিহৃ করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করত না।  শেখ হাসিনার ঘোষণা রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, গাছ-গাছালি পরিস্কার হয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের নজিরবিহীন ক্ষতি হত না। বিনাযুদ্ধে আমাদের মাতৃভুমির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভিনদেশী রোহিঙ্গাদের দখলে চলে যেত না। শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের ক্ষতি করেছেন, বাংলাদেশেরও ক্ষতি করেছেন নিজে ’মাদার অব হিউমিনিটি’ খেতাব ও বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয় দানের জন্য নোবেল পুরস্কার পাবার লোভে।
 বর্মী সেনাশাসকদের চর হিসেবে প্রথম থেকে সমালোচিত সন্দেহভাজন আরশারা গণহারে রোহিঙ্গাদের উপর জান্তাবাহিনী আক্রমণ করার অজুহাত সৃষ্টির জন্য রাখাইনের পুলিশপোস্টে আক্রমণ করে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে কতিপয় পুলিশসদস্য হত্যার মাধ্যমে।  শেষে তারা জান্তা বাহিনীর পক্ষে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় আগের সমালোচনা ও সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আরাকান আর্মি রাখাইন প্রদেশ প্রায় দখল করে ফেললেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এখনও আছে সেনাশাসকরা। এখন জান্তা সরকার সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক ঘোষণা করতে কোন বাধা নাই। এই যুদ্ধ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা সম্ভব না হলেও সরকারীভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ আরশা বাহিনী করতে পারে। তখন আরাকান আর্মি বিরোধীতা করলেও রোহিঙ্গারা মাতৃভুমি রাখাইনে ফিরে যেতে সাহস পাবে,উৎসাহ পাবে।
গত ১৯ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের বাংককে মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সীমান্তবর্তী দেশগুলোর করণীয় নিয়ে ছয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরী বৈঠকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসনের জন্যঃ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অনুকুল পরিবেশ বাংলাদেশ দেখতে চায় বলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন। আরাকান আর্মির সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে একে একে জান্তা বাহিনীর সেনানিবাসসহ রাখাইন রাজ্যের প্রায় অঞ্চল বেদখল হয়ে যাচ্ছে,জেনারেলসহ সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। রাখাইন রাজ্যে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষমতা দৃশ্যত মিয়ানমার সরকারের হাতে বর্তমানে নাই। মিয়ানমার সরকারের হাতে যে ক্ষমতা এখনও আছে তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের তাদের পূর্বের নাগরিকত্ব ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে আবার  ফিরিয়ে দিতে পারে। আমাদের সরকার শুধু মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে যোগাযোগ,সম্পর্ক রাখলে হবে না, চলমান যুদ্ধে বিজয়ী আরাকান আর্মির সাথেও নিজেদের স্বার্থে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। গোপনে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে,লেনদেন করতে হবে। অন্যথায় এখনও রাখাইন রাজ্যে থাকা ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিতে পারে।

আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.