বর্ষবরণ

বর্ষবরণ
খালেদা আকতার জ্যোৎস্না :

’মমা’ আজ রাতে কিন্তু বাসায় কোন রান্না হবে না। জানান দিলো বছরের শেষ দিন, বাইরে খাবো, ছেলেটা মমাই ডাকে, মা. না আম্মু, ভালই লাগে। জানতে চাইলাম খরচ কে দিবে, সোজা উত্তর গৌরী সেন অর্থাৎ মমা। সবার আবদার মেয়ে. ছেলে, বোন আর যারা প্রতিদিন আসে। উপভোগ করি, আবদার তো আপনজনরাই করবে। খরচ দিতে রাজি হলাম এক শর্তে- বাসায় রান্না হবে, সবার মুখগুলো দেখার মতো! তা ছাড়া দোকানের খাবারে কারো পেট ব্যথা, বুক জ্বালা, ডিসেনট্রি হয়, এ সবও বিবেচনা করে সবাই রাজি। তোরজোড় শুরু করলো- কি খাবে, কে বাজারে যাবে, কে রান্না করবে, ওরাই ঠিক করে নিলো, আর আমাকে ক্ষনে ক্ষনে ডাক- এটা দাও ওটা দাও। ওদের সাথে সামিল হয়ে থাকলাম কিছু পরে, নিজের কাজ করতে লাগলাম।
কত লক্ষ জীবন, কত মা বোনের ইজ্জত, অসংখ্য সম্পদের ক্ষতি, এর পরে তো আমরা বাংগালী হিসেবে পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিয়েছি। কিন্তু দু’শো বছরের গোলামী এখনো অস্থি-মজ্জা জুড়ে আছে। যেমন স্যার, সেক হ্যান্ট, আইন যা এখনো চলমান। বৃটিশরা আইন করেছিল কি ভাবে গোলাম বানিয়ে রাখা যায়, ওরা নিজেদের দেশে সে আইন মানে না, ওদের আইন আলাদা, যেমন ভারতে কাশ্মীরের।
এসব তো আজকালের ছেলেমেয়েদের মাথায় নেই। এর মধ্যে কিভাবে  নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করবে তা নিয়ে ব্যস্ত, কে কোন কাপড় পরবে, কি সাঁজ মারবে, তার প্রতিযোগিতা। কেউ পার্লারে, কেউ বাসায় ফেসিয়াল, শ্যাম্পু, চুলে জেল লাগানো, কাপড় ইস্তিরি, জুতা পালিশ, দেখতে রইলাম। ভাবলাম জীবনের কৌটা থেকে ৩৬৫ দিন, ২১৯০০ মিনিট, ১৩১৪০০০ সেকেন্ট চলে গেল, যেখানে এক সেকেন্ডের ভরসা নেই। এসব বাদ দিয়ে আয়োজনে যোগ দিলাম।

দুপুরে সবাই বিউটি স্লিপ নিলো, বিকেলে খুব কম নাস্তা করলো সবাই। রাতে বাসায় আর বীচে যা পায় তা খাবে এটাও তাদের পরিকল্পনা। সন্ধ্যায় শুরু হলো খাবারের আয়োজন। অন্য দিনের চেয়ে আগে খেয়ে নিলো। তারপর সাজের পালা, শেষ হতে হতে রাত ১১টা, কারণ সবাই যাবে রাত ১২টার দিকে।
১২টার একটু আগে টমটমে ঝুলে, কোন রকমে পাছাটা ঠেস দিয়ে বসে সবাই একসাথে বীচের দিকে টমটমওয়ালাকে যেতে বল্লাম। বীচে পৌঁছে একজন একজন নামতে লাগলাম। এর মাঝে সবার মোবাইলে টুং টুং নিউ ইয়ারের শুভেচ্ছা-ছবি-কোটস আসছে। বীচের কাছাকাছি গিয়ে দেখি লোকে-লোকারণ্য! অসংখ্য-গাড়ী, পাজারো, নিশান, টয়োটা, সুযুকি, হুন্দাই, অডি, মার্সিডিজ আরো কত রকমের কার ছড়িয়ে আছে।
আমরা নেমে দাঁড়াতেই কোত্থেকে এক নিশান এসে আমাদের গা-ঘেঁসে দাড়ালো, একটা ২৪/২৫ বছর এর সুদর্শন যুবক গাড়ী থেকে নেমে আমার ছেলেকে চুমু দিতে শুরু করেছে যা থামছে না, আর বলছে সরি সরি, মনে হয় একটু রংগিন পানি পান করেছে, ছেলেতো লজ্জায় লাল, সবার সামনে কোন রকমে আমার ছেলেটাকে তার খালা যুবকটার ভালোবাসা থেকে বের করে আনলো।
আমরা এগুতে থাকলাম, যাবো কি! ঠেলা ঠেলিতে একে অন্যের হাত ধরে এগুচ্ছি যাতে দলছুট না হয়। এর মাঝে মেয়েটা আর বোনটা জীবনে দেখে নাই মতো সব দোকানে ঢুকছে, যেমন ঝিনুকের, মুক্তোর, নকল পাথরের মালা, কানের দুল, ছাতা, মেমদের হেড, কিছু দর করছে আবার কিনছে, দাম কয়েকগুন বেশী, ঐসব জিনিস প্রায় দোকানে পাওয়া যায় বেশ কম দামে। আমাদের দেশে কোন উৎসব, কোন অজুহাত পেলেই দাম বেড়ে যায়। অন্যান্য দেশে দাম কমিয়ে দেয় যাতে সবাই আনন্দ করতে পারে। আরবদেশে শুনেছি ক্রেতারা ঈদ উল আজহার সময় দাম বাড়ায়, যেমন বিক্রেতা গরু/ছাগলের দাম কম বল আর বিক্রেতা  বাড়িয়ে বাড়িয়ে সঠিক দাম দিয়ে কিনে খাস বৃটিশরা নিউ ইয়ারের গুড ফ্রাইডের, সময় দাম কমিয়ে দেয়, যাতে সবাই আনন্দ করতে পারে। নিউ ইয়ারের পরের দিন, বক্রিং ডে তে কল্পনার বাইরে দাম কমিয়ে দেয়, খুব ভোর থেকে লোকজন লাইনে দাঁড়ায় কেনার জন্য। আমরা কেন অন্যদের ভালোটা নিতে চাইনা। বাদ দেন এসব।
বীচে কিছুটা এগুতেই কে যে কোথায় হারিয়ে গেলো, একমাত্র অবলম্বন মোবাইলই ভরসা, যার মাধ্যমে কে কোথায় তা জানা যাচ্ছে। দেখলাম- ফানুস উড়ানো, পটকা ফুটানো, ফায়ারওয়ার্কস। গান নাচের কথা! কথাকলি, ভরতনাট্যম, সক্্রীয়া, ডিসকো, শকিব খান- কার নাচই না আছে। কেউ একা কেউ জোড়ে, কেউ দলবদ্ধ হয়ে নাচছে। আর গান! মাইকে খালি গলায়, সুর, তাল, লয়ের পরোয়া নাই। হয়ত যে আসল শিল্পী সে শুনলে তার বেহুশ হ্ওয়া ছাড়া উপায় নেই! কেউ মাহফুজুর রহমানের মতো হেঁড়ে গলায়, খালি গলায়, মাইকে, সাউন্ট বক্সে গান চলছে। এসব শুধু শহর এলাকায় না গ্রামেও চলে। অনেক সময় দূর্ঘটনা ঘটে, যা কাম্য নয়।
কোন এক সময় বৃটিশদের কোন এক শহরে থাকার সুযোগ হয়েছিলো দেখেছি  নিউ ইয়ারসডে তে সারা দিন পিন পতন শব্দ নাই, তবে সবাই বাসায় থাকে। রাতে জম্পেস ডিনার করে একসাথে, ওদের মাঝে উপহার দেওয়া, কার্ড দেওয়া রীতিটা প্রশংসনীয়।  টিন এজ থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত জোড়ায় জোড়ায় বয়স অনুযায়ী নাইট ক্লাবে যায়, সারা রাত যে যার মতো মজা করে, টেমস নদীর পাড়ে জমায়েত হয়, ফার্য়া ওয়ার্কস দেখতে যায়, টেলিভিশনে দেখায়। অনেকে ১২টার সময় খোলা মাঠে, নির্জন স্থানে ফার্য়া ওয়ার্কস করে, যাতে অন্যদের অসুবিধা না হয়। পৃথিরীর সব দেশেই বর্ষবরণ উৎসব হয় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। তবে হুজুগে বাংগালীর মতো এতো মাতামতি করে না।
বাংলা নববর্ষ বরণের দিন, পহেলা বৈশাখ, যা বিশ্বের  সব প্রান্তের বাংগালীরা পালন করে। ভুলে যাবার চেষ্টা করে  অতীত বছরের দু:খ গ্লানি। সবার কামনা থাকে আগামী বছরটা সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধি নিয়ে আসুক। তবে পহেলা বৈশাখটা মনে রাখে, বাকি বাংলা কি মাস চলছে মনে থাকে না অথচ ইংরেজি মাস মুখস্ত। বাংলা ক্যলেন্ডার খুঁজে পাওয়া মুসকিল, তবে মোবাইলে সমাধান দেয়।
আমাদের দেশে বাংলা বছরকে আবাহন করে রমনা বটমূলে। ১৩৭১ সালে ইংরেজি ১৯৬৪ সালে রমনা বটমূলে ছায়ানট বাংলা বর্ষ পালন শুরু করে। যার চল এখনো রয়েছে। মেয়েরা লাল পেড়ের শাড়ী, কপালে লাল টিপ, মাথায়, গলায় লাল হলুদের ফুলের মালা, শোভাযাত্রা। ছেলেরা হলুদ রং এর জামা, ফতুয়া, ছোট ছোট বাচ্চারা নানা রং এর জামা পরে আমাদের দেখতে ভালো লাগে।    
 
তবে কিছু কিছু ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে, ঘরে ঘরে মোঁয়া, মুড়ি, চিঁড়ার মোয়া, তিলের নাড়–, মিস্টি বিলানো,পাস্তা ইলিশ,মাটির শানকি তে খাওয়া বছরে একদিন) নতুন বছরের হাল খাতা যা কম্পিটরের দখলে,রাখাইন মেয়েদের সুন্দর সুন্দর আংগি(ওদের ভাষা) থামি পড়ে, মুখে চন্দন, এক কিয়াং থেকে আর এক কিয়াংয়ে পূজাঁর জন্য যাওয়া যা এখন নাই।পার্বত্যবাসিরা তাদের মতো উদযাপন করে আর তাদের খাবারের তালিকা অভিনব। আমাদের বাসার পাশে দাদারা সকালে শত্রু কাটতো অদ্ভুত ভাবে, দিদিরা অনেক আগে থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুস্ঠানের আয়োজনে ব্যস্ত থাকতো, আমরা দেখতাম, আবার কিছু নকল করার চেস্টা করতাম। তবে স্বর্নকাররা ক্রেতাদের এখনো মিস্টি খাওয়ায়।
আমার উপদেশ বা জ্ঞান দেওয়ার উদ্দেশ্য বা ক্ষমতা নেই।
শুধু  বলতে চাই গোলমীটা কিছুট হলওে পরিহার করেন, নকল না করায় ভালো। আমরা বাংগালি  আমাদের বর্ষবরণ আমাদের মতো হউক এবং ৩১সে ডিসেম্বর সারা বিশ্ব পালন করে, আর পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশ, কোলকাতা ছাড়া, বিশ্বের  যে সব দেশে বাংগালী আছে তারাঁ কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে সল্প পরিসরে পালন করে।  আমরা অনেক সময় বাংলিশ বলি, কিন্তু আচরণে হলে তা হাস্যকর!
বাংগালি কবি লিখেছেন:
নিশি অবসান প্রায়, ওইপুরাতন বর্ষ হল গত।
আমি আজি ধূলিতলে ,এ জীবন করিলাম নত---
ইংরেজী কবি লিখেছেন
জরহম ড়ঁঃ, রিষফ নবষষং,ঃড় ঃযব ংশু
ঞযব ভষুরহম পষড়ঁফ ভৎড়ংঃু ষরমযঃ
ঞযব ুবধৎ রং ফুরহম রহ ঃযব হরমযঃ---
বর্ষ বরণ নিয়ে কবি সাহিত্যিকরা কত ভাবে বর্ননা করেছেন হিসেব নেই।
ক্ষুদ্র একজন হিসেবে বলতে চাই, আমরা আমাদের মতো বর্ষ বরন করবো,শ্লীলতা বজায় রাখবো, মজা করবো কিন্তু নকল করবো না, দূর্ঘটনা ঘটাবো না। ঐতিহ্য বজায় রাখবো। আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা দিবো কি বলেন?
জাতি, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবাইকে অগ্রীম ইংরেজি নব বর্ষের শুভ কামনা।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.