ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দিন :
১৯৭৮ সালের আলমা আতা ঘোষণার যা ’প্রাইমারি হেলথ কেয়ার’ তথা ’২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল গৌরবের বিষয় বাংলাদেশ সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান প্রথম স্বাক্ষর কারী। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রা বলা আছে ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ বা হেলথ ফর অল।
নার্সিং পেশার মাধ্যমে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে ।নার্সিং পেশা একটি মানবিক পেশা বর্তমানে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কারণ নার্সিং পেশার মাধ্যমে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। তাছাড়া তরুণদের কাছে জনপ্রিয় কারণ এই পেশায় খুবই দ্রুত অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা পাচ্ছে সবাই। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবায় যুগ যুগ ধরে নার্সিং খাত অবদান রেখে চলেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অন্যন্য অর্জন যেমন: মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো, ভ্যাকসিন হিরো পুরস্কারসহ সর্বশেষ করোনা মোকাবিলায় নার্সদের আত্মত্যাগ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মতৎপরতা দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের যে দায়িত্ববোধ তাই প্রমাণ করে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া। দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে গ্রামের মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান ও সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন বর্তমানে প্রায় ৪৭ হাজার নার্স সরকারিভাবে কর্মরত। বিশ্বব্যাপী সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় স্বাস্থ্য খাতে। কারণ, ১৯৭৮ সালের আলমা আতা ঘোষণার (যা ’প্রাইমারি হেলথ কেয়ার’ তথা ’২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল--একটু বয়সী পাঠকদের মনে থাকবে) আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ছিল মূলতঃ পয়সাওলা মানুষদের ক্রয়যোগ্য পণ্যের মতো, ঠিক অধিকার নয়। সেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণার প্রবর্তনের ফলে স্বাস্থ্য পেল গণমানুষের অধিকারের মর্যাদা। গৌরবের বিষয়, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বকালীন বাংলাদেশ ছিল আলমা আতা ঘোষণার অন্যতম স্বাক্ষরকারী এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জ্বল মডেল। নার্স সামগ্রিক নার্সিং সেবার মাধ্যমে যে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় পাশাপাশি আলমা আতা ঘোষণার যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত কল্পে নার্সিং পেশা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
√কমিউনিটি নার্সিংয়ের মাধ্যমে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া ও হাসপাতালে রোগীরভর্তির হার কমবে এতে জনগণের অর্থ ও সময় দুটো বাঁচবে:
কমিউনিটি নার্সিং কেয়ার মাধ্যমে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হার কমাতে অবদান রাখেন নার্সরা। কমিউনিটি নার্সিং কেয়ারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে এবং একসাথে বিশাল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবায় আওতায় সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এতে জনগণের অর্থ ও সময় দুটো সাশ্রয় হচ্ছে।সঠিকভাবে কমিউনিটি নার্সিং কেয়ার প্রদান করলে রোগের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্য হারে কমবে এবং আমরা উল্লেখ করতে পারি করোনাকালীন সময়ে কমিউনিটি নার্সিং কেয়ার এর মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিয়েছিল এতে রাস্ট্র ও জনগণের অর্থনৈতিক সাশ্রয় হয়েছে ।কমিউনিটি নার্সিং সেবা পদ্ধতি কানাডা সহ অন্যন্য দেশে খুবই জনপ্রিয়।
√প্রতিরোধমূলক নার্সিং সেবা অসংক্রামক ব্যাধি কমাবে ফলে চিকিৎসা ব্যায়ভার কমছে:
প্রিভেন্টিভ নার্সিং কেয়ার বা প্রতিরোধমূলক নার্সিং সেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।জনসচেতনতা বাড়লে সংক্রামক/ অসংক্রামক ব্যাধি গুলো সংক্রমনের হার কমে যায় ফলে হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি হার কমে। জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। কারন একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় তাহলে তার আয় বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়।
√সংক্রমন বিধিমালা মেনে নার্সিং সেবা দেয়ায় হাসপাতালে রোগীর অবস্থান কাল কমছে এতে হাসপাতালে থেকে অতি অল্প সময়ে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে :
সংক্রমন বিধি মেনে হাসপাতালে নার্সরা সঠিকভাবে সেবা প্রদানের ফলে হাসপাতালে রোগীর অল্প সময়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায় তার স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করে। কিন্তু যদি সংক্রমন বিধিমালা না মেনে সেবা দেওয়া হলে Hospital Acquired Infection ( HAI) স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত সংক্রমন হার বেড়ে যায় এতে হাসপাতালে রোগীর অবস্থান কাল দীর্ঘ হয় ফলে অতিরিক্ত অর্থ, সময় ও বাড়তি জনশক্তি দরকার হয় যার বিরূপ প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে। ডলার সংকট বা রিজার্ভ সংকট সময়ে কৃচ্ছতা সাধনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
√বৈদেশিক মূদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির সচল রাখছে নার্সরা:
বর্তমানে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যেমন: কুয়েত, সৌদি আরব, লিবিয়া, সহ ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী প্রায় পাঁচশত অধিক নার্স কর্মরত। বুয়েসল (BOESL) মাধ্যমে আরও কিছু দেশে নার্স রপ্তানি কাজ চলমান ফলে আমাদের যে রিজার্ভ সংকট তা কমাতে সহায়ক হচ্ছে। তাই আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নার্স শিক্ষা-কারিকুলাম ও বিদেশ গমন সহজতর করা জরুরি।
√বয়স্ক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র চালু করলে সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে:
জেরিয়াট্রিক সেবা কেন্দ্র চালু করলে বয়োজ্যেষ্ঠ (সিনিয়র সিটিজেন) আপদকালীন সময়ে চিকিৎসা ব্যায়টা কমবে কিংবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার হারটা কমবে।ফলে অল্প খরচে ভালোমানের চিকিৎসা দেশে দেওয়া সম্ভব হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে , ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দুই লাখ ৫০ হাজার নার্সের প্রয়োজন হবে। কারণ তখন আমাদের ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য জেরিয়াট্রিক সেবা কেন্দ্র দরকার।
√তাই নার্সিং পেশাটাকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি :
এখন সময় এসেছে নার্সিং পেশার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা ।এখন এটা সুস্পষ্ট যে, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে নার্সিং পেশার মান্নোয়ন প্রয়োজন। বলা হয়, একটি দেশের স্বাস্থ্য সেবার মানদণ্ড ৮০ শতাংশ নার্সিং সেবার মানের উপর নির্ভরশীল। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর,থায়ল্যান্ড,কানাডা, ইংলান্ড আমেরিকাসহ যেসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত, ওইসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির পেছনে নার্সদের সেবা প্রদানের ভূমিকা রয়েছে। পাশের দেশ ভারত, মায়ানমার তাদের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন করেছে নার্সিং পেশাকে উন্নতি করে সম্ভব করেছে। সাবেক প্রয়াত প্রেসিডেন্ড জিয়াউর রহমানের ৩১ দফায় নার্সদের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
যদি নার্সদের পদ বিন্যাস সৃজন করা যায়, তাহলে এসডিজি অর্জন সহজতর হবে এবং আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো।সেবার মান বেড়েছে যেভাবে সে অনুপাতে বেড়েছে জনবল নার্সিং খাতে। তাই এ বিশাল জনবলকে সুষ্ঠুভাবে মনিটরিং দরকার।নার্সিং খাতের আরেকটি সহযোগী খাত হচ্ছে মিডওয়াইফারি খাত। নার্সিং বিদ্যমান প্রশাসনিক জনবল কাঠামো দিয়ে মিডওয়াইফারিকে দেখভাল করা হচ্ছে। বর্তমানে মিডওয়াইফ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। ফলে এটিও বর্তমান নার্সিং প্রশাসনিক কাঠামোর উপর নতুন করে চাপ তৈরি করছে। এজন্য নতুন প্রস্তাবিত পদ বিন্যাস বহুলাংশে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
√চতুর্থ শিল্পবিল্পব মোকাবোলায় ও সেবা সহজিকরণে নার্সিং খাতে পদবিন্যাস করা দরকার :
সেবা সহজীকরণ অবাধ তথ্য প্রবাহ বর্তমান সরকারের একটি যুগপৎ সিদ্ধান্ত। নার্সিং পেশায় ও এর ধারাবাহিকতা প্রয়োজন এজন্য জেলার সেবাগুলো যেন জেলা সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হতে একটা সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন। আলাদাভাবে বণ্টিত পদ সৃজন না হওয়ার কারণে সেবা সহজলভ্যতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মিশন ভিশন গ্রাম হবে শহর, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার যে প্রয়াস তা সঠিকভাবে পালন করতে হলে অপার সম্ভাবনাময়ী এ নার্সিং পেশায় পদ বিন্যাস প্রয়োজন। জনগণের সেবা প্রাপ্তি সহজীকরণ ও নার্সদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (অটোমেশন) সময়োপযোগী দক্ষ ও আধুনিক জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে, এ পেশায় প্রশাসনিক সক্ষমতা ও পদবিন্যাস বা উচ্চতর গ্রেডের নতুন পদ সৃজন অনেকটা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুতরাং বলা চলে, স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করতে হলে নার্সিং পেশার মান্নোয়নে প্রয়োজন। নার্সদের সুষ্ঠু জনবল কাঠামো বা পদসোপান তৈরির মাধ্যমে নার্সিং পেশার মান্নোয়ন সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি পাবে।
তাই সময় এসেছে প্রিভেন্টিভ নার্সিং, কমিউনিটি নার্সিংয় ও সংক্রমণ বিধিমালার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের প্রতিরোধযোগ্য রোগবালাই,রোগের প্রাদ্রুভাব হাসপাতালে রোগীর ভর্তির হার ও ভর্তিকৃত রোগীর অবস্থানকাল কমানো যাবে,সেক্ষেত্রে অনেকগুলো উপকারিতা লক্ষ্য করা যায় হাসপাতালের অতিরিক্ত স্বাস্থ্যসেবার যে অর্থ ব্যয় সেটা কমে যায় এবং হাসপাতালে জনবলের উপর বাড়তে যে চাপ তৈরি হয় সেটা কমে যায়। এতে অর্থনীতির নিরব বিপ্লব সংগঠিত হবে।
সুতরাং অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের একটি সোপান জনগণের দোরগোড়ায় নার্সিং সেবা পৌঁছে দেওয়া। যদি আমরা সামগ্রিক সেবার মাধ্যমে রোগীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করতে পারি তাহলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অর্থব্যায় যেভাবে কমবে পাশাপাশি জনগনের অর্থিক ক্ষতিটা হ্রাস পাবে এবং এবং আলমা আতা ঘোষনা অনুযায়ী সার্বজনীন সেবা নিশ্চিত হবে।