স্মৃতি ও প্রীতির বন্ধনে রামু রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসা

স্মৃতি ও প্রীতির বন্ধনে রামু রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসা
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর :

আব্বাজানের আপন মামা, আমার দাদীর ছোট ভাই মাওলানা মুহাম্মদ শফী রহ. ছিলেন, ঐতিহ্যবাহী চাকমারকুল মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস । তাঁকে আমরা মৌলভী দাদা বলে ডাকতাম। শৈশব থেকেই মৌলভী দাদার আমলী জিন্দেগীতে মুগ্ধ ছিলাম। দাদার মত আলিম হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আবার কোন একসময় আমার আব্বাজান হ্নীলার সদর সাহেব হুজুর রহ. এর কাছ থেকে সন্তানকে নেককার হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ নসীহত শুনেছেন। যা আব্বাজানের হৃদয়ে রেখাপাত করে। এতে করে তিনি আমাকে মাদ্রাসায় পড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত হন।
ইতিমধ্যে ১৯৯৪ সালে আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়েছি। সময়কাল তখন ১৯৯৫। রমযানের পরে আব্বাজান মৌলভী দাদার পরামর্শে আমাকে রামু জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসার তৎকালীন মুহতামিম হাফেজ আব্দুল হক সাহেব হুজুরের কাছে সোপর্দ করেন হাফেজে কুরআন বানানোর উদ্দেশ্যে। তিনি নিজেই আমাকে হিফজ বিভাগের শিক্ষক মাওলানা হাফেজ আব্দুল করিম রহ. (হাফেজ সাহেব হুজুর) এর হাতে ন্যস্ত করেন। কীর্তিমান এ শিক্ষকের কাছ থেকেই পবিত্র কুরআন মজিদের শুদ্ধতম তিলাওয়াতের প্রথম সবক গ্রহন করেছিলাম। হুজুরের তত্ত্বাবধান ও স্নেহমাখা শাসনের পরশে আমি পুরো কুরআন মজিদের হিফ্জ শেষ করি। আমার যে বছর হিফজ শেষ হয় সেবছর হুজুর রাজারকুল আজিজুল উলুমের হিফজ বিভাগে যোগদান করেন। এর কিছুদিন পরে মুহতারাম হাফেজ সাহেব হুজুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে যাই আজিজুল উলুম মাদ্রাসায়।
নদী তীরে প্রকৃতির ছায়াঘেরা পল্লী গাঁয়ে সাজানো গোছানো এই দ্বীনি বাগিচার প্রতি তখনই আমার হৃদয়ে এক আকর্ষণ তৈরি হয়। ২০০০ সালে মাহে রমযানের পরে আমি ইলমে নবভী আহরণের ভর্তি হই সেই প্রিয় আজিজুল উলুমে। শীতকালের মিষ্টিরোদে গাছতলায় বসে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছিলেন হযরত আদিব সাহেব হুজুর (মাওলানা আব্দুল খালেক কওছর দা. বা.)। ভর্তি হলাম জামাতে নাহুমে। শুরু হলো ইলমী অঙ্গনে নতুন অভিযাত্রা। সেই তখন থেকে জামাতে পঞ্জুম। দীর্ঘ পাঁচ বছর কাটিয়েছি মুহতারাম আসাতিযায়েকেরামের স্নেহের পরশে ইলমে নবভীর সুরভিত উদ্যানে। আজিজুল উলুম আমাদের বেড়ে উঠার সোপান, আলোকিত চেতনার বাতিঘর।

হাফেজ সাইফুল ইসলাম ও আমি সেই ছোটকাল থেকে পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আজিজুল উলুম মাদ্রাসায় সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে আরবীতে আমরা দু'জনের কথোপকথনকে ঘিরে পুরো অনুষ্ঠান হয়ে উঠতো প্রাণবন্ত। সেই স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে আন্দোলিত করে। সেখান থেকেই সাহিত্যাঙ্গনে আমাদের অভিযাত্রা তরান্বিত হয়। পরবর্তীতে আল-আজিজ দেয়ালিকা হয়ে উঠে আমাদের সাহিত্য অভিযাত্রার অন্যতম সোপান। সেক্ষেত্রে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় উস্তায মাওলানা মোহাম্মদ মোহছেন শরীফ (জদিদ সাহেব হুজুর), মাওলানা আব্দুল খালেক কওছর (আদিব সাহেব হুজুর) ও মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কুদছী রহ. আমাদের বিচক্ষণ ও বিদগ্ধ রাহবার। আকাবিরে দেওবন্দের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজের দায়িত্বশীল হিসেবে আমার আদর্শিক অভিযাত্রা ও মাঠপর্যায়ে দাওয়াতী তৎপরতার বিকাশধারার শুভ সূচনাও এ মাদ্রাসার ছাত্রাবস্থায়।
এছাড়াও এই ইলমী বাগিচায় কত যে স্মৃতি জড়িয়ে তা ভাষায় বর্ণনাতীত। যাঁদের অভিভাবকত্বের ছায়ায় কেটেছে ওই সোনালী সময় সেই মুহতারাম আসাতিযায়েকেরামকে মনে পড়ে প্রতিমুহূর্তে। বিশেষতঃ সুযোগ্য মুহতামিম প্রিয় দাদা মাওলানা আমান উল্লাহ সিকদার রহ. এর দরদী ব্যবহারের স্মৃতি মনে পড়তেই দু'চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যায়। এছাড়াও হযরত মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কদিম সাহেব হুজুর রহ., মাওলানা আব্দুল জলিল রহ. (উমখালী হুজুর), হাফেজ আব্দুল করিম রহ. (হাফেজ সাহেব হুজুর) মাওলানা আব্দুচ্ছালাম কুদছী রহ., মাওলানা কারী নুরুল হাকিম রহ. (কাতেব সাহেব হুজুর), মরহুম আব্দুল্লাহ স্যার, মরহুম মোহাম্মদ হোসাইন স্যারসহ যে সকল শিক্ষকমণ্ডলীকে চিরতরে হারিয়েছি তাঁদের স্মৃতিগুলো হৃদয়ে শোকের ঝড় বয়ে দেয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের মরহুম আসাতিযায়েকেরামকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।
আজিজুল উলুমে আমরা আরও যেসকল উস্তাযগণের স্নেহপূর্ণ সান্নিধ্যে ধন্য তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সুযোগ্য মুহতামিম মাওলানা মোহছেন শরীফ (জদিদ সাহেব হুজুর), উস্তাযুল হাদীস মাওলানা হাফেজ জুনাইদ (খতীব সাহেব হুজুর), মাওলানা আব্দুল খালেক কওছর (আদিব সাহেব হুজুর), মাওলানা হাফেজ তাহের সাঈদ (নাজেম সাহেব হুজুর), মাওলানা ইমাম হোসাইন (ইমাম সাহেব হুজুর), মাওলানা আব্দুল মজিদ (বুড়া হুজুর), মাওলানা জিল্লুর রহমান (চকরিয়া হুজুর), মাওলানা আতাউল করীম ( তাবলীগ হুজুর), মাওলানা আশরাফ আলী (মহেশখালী হুজুর), হাফেজ লুৎফুর রহমান শাহেদ স্যার, মাওলানা কারী সাঈদুল হক (কারী সাহেব হুজুর), মাওলানা আবুল হোসাইন (নতুন হুজুর), মাওলানা শরাফতুল্লাহ সাহেব হুজুর, মাওলানা আসহাব উদ্দিন (কক্সবাজারী হুজুর), মাওলানা শুয়াইব স্যার, মোঃ নাছির উদ্দিন স্যার প্রমুখ। আল্লাহ সকল আসাতিযায়েকেরামকে হায়াতে তায়্যিবাহ দান করুন।
প্রাণপ্রিয় এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রজীবনের পাঁচ বছর ছাড়াও কর্মজীবনেও দীর্ঘ ৬ বছর শিক্ষকতার খেদমতের আবেগমাখা স্মৃতি রয়েছে। ২০১২সালের শেষ দিক থেকে প্রায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত খেমদতে নিবেদিত ছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। যে দেয়ালিকায় ছাত্র জীবনে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলাম সে "আল-আজিজ" সম্পাদনা, ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সৃজনশীল অঙ্গনে শিক্ষার্থীদের পরিচর্যা, আল-আজিজ সাহিত্য কাফেলা গঠনসহ নানা স্মৃতিগুলো হৃদয়ের জানালায় ভীড় করছে। দরস-তাদরীস, লেখালেখি, সাহিত্য চর্চা, গবেষণাসহ কত স্মৃতি, কত প্রীতি, কত অনুভূতির কেন্দ্র শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবনের স্মৃতিমাখা এই দ্বীনি বাগিচা । মনে পড়ে সহপাঠী ও সহকর্মীদের যাঁদের সাথে কেটেছে প্রাণবন্ত সময়, মনে পড়ে সেই প্রিয় ছাত্রদের যাদের কোলাহলে আসতো আনন্দমুখরতা। আমার লজিং বাড়িসহ মাদ্রাসা অঞ্চলের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষদেরও মনে পড়ে, যাঁরা পরিণত হয়েছেন আমার অতি আপনজনে।
খুব বেশি মনে পড়ে সেই মনোরম ও পবিত্রতামুখর পরিবেশকে যে পরিবেশে অনুভব করতাম স্বচ্ছ, নির্মল স্বাচ্ছন্দ্য । মনে পড়ে আমার পড়া-লেখার টেবিল ও সেই স্মৃতিময় রুমটিকে যেখানে বসে রচনা করেছি কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, স্মৃতি ও জীবনকথা। যেখানে বসে সম্পাদনা করেছি আল-আজিজ দেয়ালিকা। যেখানে নির্ঘুম কত রাত পার করেছি দেয়ালিকা সম্পাদনা ও লেখালেখির স্বার্থে। যেখানে থেকে বুনেছি কত স্বপ্ন। সবমিলিয়ে এ মাদ্রাসার প্রতিটি বালি-কণা এমনকি প্রতিটি বৃক্ষের সাথেও যেন গড়েছে আমার আত্মার বন্ধন।
আজ ৫১ বার্ষিক সভার শুভ সন্ধিক্ষণে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি এই ইলমী ঝর্ণাধারা কিয়ামত পর্যন্ত অবারিত রাখুন। আমিন।
লেখক-
সভাপতি, প্রাক্তন ছাত্র পরিষদ আজিজুল উলুম মাদ্রাসা, রাজারকুল, রামু।
প্রচার সম্পাদক, রামু প্রেস ক্লাব।
সভাপতি, রামু লেখক ফোরাম।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.