বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০২৪ : পর্যালোচনা

বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০২৪ : পর্যালোচনা
সিভিল রুলস এন্ড অর্ডারস,১ম খন্ডের ৯২৮ বিধি ও ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস,১ম খন্ডের ৪৮২ বিধি মোতাবেক  করোনার কারণে দীর্ঘ বিরতির পর গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১থ্রিঃ তারিখ  সকাল ৯.৩০ ঘটিকার সময় কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের সভাপতিত্বে জেলা জজের সম্মেলন কক্ষে ’বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০২১’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিগত ২/৪/২০২২খ্রিঃ তারিখ বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০২২ একই জেলা ও দায়রা জজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গত ৪/১১/২৩খ্রিঃ তারিখ কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ শাহীন উদ্দিনের সভাপতিত্বে বিচার বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 
বিগত ১৬/১১/২৪খ্রিঃ তারিখ কক্সবাজার জেলা জজের সম্মেলন কক্ষে বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মুন্সী আব্দুল মজিদ এর সভাপতিত্বে সকাল সাড়ে নয় ঘটিকার সময়। সম্মেলনে জেলার অতিরিক্ত জেলা জজ, ২য় আদালত মোহাম্মদ রহমত আলী, অতিরিক্ত জেলা জজ, ৩য় আদালত মোহাম্মদ আবদুল কাদের, অতিরিক্ত জেলা জজ, ৫ম আদালত নিশাত সুলতানা, যুগ্ন দায়রা জজ ২য় আদালত মোহাম্মদ আবুল মনসুর সিদ্দিকী, সিনিয়র সহকারী জজ,সদর,সুশান্ত প্রসাদ চাকমা, সিনিয়র সহকারী জজ,রামু, মৈত্রী ভট্টাচার্য্য, সিনিয়র সহকারী জজ, চকরিয়া চৌকি,রাজীব দে, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ, সাজ্জাতুননেছা, সিনিয়র সহকারী জজ,টেকনাফ, সেঁজুতি জান্নাত,সিনিয়র সহকারী জজ,মহেশখালী, সায়মা আফরীন হীমা, সহকারী জজ, উখিয়া, মোঃ মাজেদ হোসাইন, সহকারী জজ, কুতুবদিয়া, মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন, সহকারী জজ (শিক্ষানবিশ) মোঃ রুহুল আমিন, সহকারী জজ (শিক্ষনবিশ) মোঃ ওমর ফারুক, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ, সিভিল সার্জন ডাঃ আসিফ আহমেদ হাওলাদার, র‌্যাব- ১৫ এর মেজর আহসান, দুদকের সহকারী পরিচালক মোঃ রিয়াজ উদ্দিন, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ মারুফ হোসেন, গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, জেলার সকল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ, সিনিয়র পুলিশ অফিসারগণসহ জেলায় কর্মরত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহনে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জিপি,পিপিসহ ১০জন সিনিয়র আইনজীবীও অংশগ্রহন করেছেন। সম্মেলনের প্রথম পর্ব বেলা এক ঘটিকার সময় সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা সমাপ্ত হয়েছে ২.৪৫ ঘটিকার সময়। অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের কোন সংবাদ অপ্রত্যাশিতভাবে পরের দিন কোন সংবাদপত্রে প্রকাশ হতে দেখা যায়নি।
পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ পাঠ ও অতিরিক্ত দায়রা জজ নিশাত সুলতানার স্বাগত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হওয়া সম্মেলনে অংশ গ্রহনকারীদের মধ্যে করোনাকালের আগের সম্মেলনগুলোর মত লিখিত কোন প্রতিবেদন বিতরণ করা না হলেও সভাপতি জেলা ও দায়রা জজ মুন্সী আব্দুল মজিদের ১০.২০টা থেকে ১১.২০ টা পর্যন্ত এক ঘন্টাব্যাপী দেওয়া ভাষণে বিচার সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সবকিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। তবে লিখিত প্রতিবেদন থাকলে আগের সম্মেলনে কি কি বিষয় আলোচিত হয়েছে,কি কি সিদ্ধান্ত বা সুপারিশ করা হয়েছিল, সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরী করা হয়েছে কিনা ইত্যাদি আলোচনা করতে ও নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়।
কক্সবাজার জেলা জজশিপে প্রায় ৯৭,৭৭৬টি মামলা বিচারাধীন আছে। এর মধ্যে ২৬,০০৫টি দেওয়ানী মামলা। ভুমির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও অপরাধও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করায় ইয়াবা-আইস ইত্যাদি মাদক পাচার, খুন, নারী নির্যাতন, মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজার জেলায় বিচারকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, রাষ্ট্রপক্ষের ও আসামীপক্ষের আইনজীবীদের সহযোগিতায় প্রত্যাশিতমতে মামলা নিস্পত্তি হলেও সত্য, অর্ধ-সত্য, মিথ্যা ও গায়েবী মামলা দায়ের ও অভিযোগপত্র দাখিলের সংখ্যা বেশী হওয়ায় বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বা মামলাজট কমছে না। এখনও প্রতি বিচারকের কাছে গড়ে ৩২০৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা যায়।
বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের উদ্দেশ্য মামলা রুজু করা থেকে শেষ পর্যন্ত বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে এক সাথে বসে বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা ও সমস্যার বিষয়গুলো খোলা মনে আলোচনা করে সমন্বয় সাধন করে মামলা দ্রুত নিস্পত্তি করে বিচারপ্রার্থী জনগণকে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সহায়তা করা। কারো বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করা, তর্কাতর্কি করে মন খারাপ করে হতাশ হয়ে কাজে নিরুৎসাহ সৃষ্টি করা নয়।
আমাদের জন্য অনুসরণীয় ফৌজদারী কার্যবিধি, দন্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন, পুলিশ রেগুলেশন ইত্যাদি বিধিবদ্ধ আইন যেমন আছে উচ্চ আদালতকর্তৃক প্রচারিত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও জাজ-মেইড ল আছে। লিখিত-অলিখিত আচরণবিধি, আচর-আচরণ, মূল্যবোধ,নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের মাঝে দৃশ্যমান না হলে আমাদের প্রতি গণ-আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে না। শত মহাজ্ঞানী,ক্ষমতাশালী হলেও কোন সভায় উপস্থিত থাকলে সভার সভাপতিকে ডিঙ্গিয়ে বার বার কথা বলার চেষ্টা না করাই অলিখিত আইন। মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও গায়েবী মামলা দায়ের করতে গেলে সাধারণ বুদ্ধি ও বিবেক প্রয়োগ করে তা গ্রহন না করা অলিখিত আইন। ব্যক্তিস্বার্থে, গোষ্ঠীস্বার্থে, দলীয়স্বার্থে প্রতিপক্ষকে হয়রানী করার ও কষ্ট দেওয়ার জন্য দায়েরকৃত মামলা গ্রহন করা হলে, অভিযোগপত্র দেওয়া হলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, মামলাজটও দীর্ঘ হবে। গত ১৫ বছরে বিচারাধীন মামলাজট ৩০লাখ থেকে ৪৫ লাখ হয়েছে।
 আমাদের সমাজে সব চেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হলেন যাদের অপরের ক্ষতি করার বা অপরকে বিপদে ফেলার ক্ষমতা বেশী আছে। প্রচলিত আইনে সেই ক্ষমতা বেশী আছে পুলিশের। শেখ হাসিনা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে পুলিশের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে মারাত্মক স্বৈরাচারী হয়েছিলেন। মিথ্যা ঘটনা, পাতানো ঘটনা, ভিত্তিহীন ঘটনা দিয়ে লাখ লাখ গায়েবী মামলা দায়ের করে, গ্রেপ্তার করে, অভিযোগপত্র দাখিল করে বিএনপি-জামাতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ী ছাড়া করে ভোটারবিহীন পরিকল্পিত নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে সহযোগীদের নিয়ে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচার করেছেন। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরে বুঝা গেল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের চেয়ে সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ বেশী ছিল। শুধু অত্যাধুনিক মরণাস্ত্র দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় না। যুদ্ধের জন্য আসল অস্ত্র হল নৈতিক মনোবল। ফিলিস্তিনীরা সুপার পাওয়ার আমেরিকা-ইসরাইলের বিরুদ্ধে শুধু ঈমানের জোর ও নৈতিক মনোবল দিয়ে প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ শহীদ হলেও হার না মেনে অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ বাহিনীসহ অত্যাধুনিক মরাণাস্ত্র থাকার পরও নৈতিক মনোবল না থাকায় নিরবে পরাজয় স্বীকার করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। আমাদের জনগণকে রক্ষা করার জন্য, নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য জনগণের কষ্ঠার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকায় ক্রয় করা অস্ত্র গোলাবারুদ নিজেদের দখলে থাকার পরও পুলিশ বাহিনী সেই অস্ত্রশস্ত্রসহ থানা ফাড়ি অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে শুধু নৈতিক মনোবল না থাকার কারণেই নিজের প্রাণটা নিয়ে পালিয়ে গেছেন বলে জনগণ মনে করেন। এ দেশের পুলিশ এ দেশের মাঠির সন্তান, আমাদের ভাই, আমাদের সন্তান। গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। অপর পক্ষে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৩০ জন শিশু সহ দেড় হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন বলে মিডিয়ায় দাবী করা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ মানুষের হাতে পুলিশ নিহত হয়েছেন, আর স্বৈরাচারের একান্ত অনুগত পুলিশ বাহিনীর হাতে মানুষ শহীদ হয়েছেন বলছেন কেন? স্বৈরাচারী একনায়ক সরকারের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকার  অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন বেনজির, মামুনদের মত কতিপয় উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তারা। আর উচ্চপদস্থদের আদেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন পুলিশের ইন্সপেক্টর থেকে নিচের দিকের সাধারণ কনস্টেবলরা। উচ্চপদের কেউ নিহত হয়েছেন বলে শুনা যায় নাই। বাস্তবতা হলো নিহত পুলিশদের ইতিহাসে লেখা হবে ’নিহত’ হিসেবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত জনগণকে লেখা হবে ’শহীদ’ হিসেবে, আর ২৫/২৬ হাজার পঙ্গু, আহতদের নাম লিখা হবে ’বীর’ হিসেবে।
মানুষ পুলিশকে ভয়  করে বলে মানুষ সামনা সামনি পুলিশের বিরুদ্ধে সত্য কথাও বলতে সাহস করেন না। এই দিনের বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে কক্সবাজারের সদ্য সাবেক চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল্লাহ আল মানুন সামনাসামনি পুলিশ সম্পর্কে কিছু বাস্তব, সত্য কথা বলেছেন। তার কথাগুলো গুরুত্বসহকারে নিয়ে আত্মসমালোচনা ও আত্মসংশোধনে মনোনিবেশ করলে ভবিষ্যতের পুলিশ বাহিনী জনগণের ভালবাসার পুলিশ বাহিনী হবে। সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করে, হেয়প্রতিপন্ন করে আগের মত পুলিশী মেজাজ ও পুলিশী চরিত্র দেখালে ফলাফলও আগের মত হবে বলে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। 
বিচার বিভাগীয় সম্মেলন বিচার বিভাগের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করে। সর্বোপরি বিচার বিভাগীয় সম্মেলন বিচারপ্রার্থীদের ন্যায় বিচার পেতে এবং বিচারের আদেশ-রায় যথাযথ বাস্তবায়নে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। বিচার সংশ্লিষ্ট সকলকে আত্মআবিস্কার ও আত্মউপলবিদ্ধ করতে সহায়তা করে। বিচার বিভাগীয় সম্মেলন সফল হয়েছে।

 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.