লুটপাট-দুর্নীতির দায়মুক্তির ধারা-উপধারা অবৈধ ঘোষণা

লুটপাট-দুর্নীতির দায়মুক্তির ধারা-উপধারা অবৈধ ঘোষণা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য করা মন্ত্রীর একক ক্ষমতা ও লুটপাট-দুর্নীতির দায়মুক্তি দিয়ে ’বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর দ্রæত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন,২০১০’ এর ৬(২) ধারায় মন্ত্রীকে দেওয়া একক ক্ষমতা ও ৯ ধারায় এই আইনের অধীন করা বা করা হয়েছে বলে বিবেচিত কোন কাজ,গৃহীত কোন ব্যবস্থা,প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না মর্মে উক্ত ধারা উপ-ধারা ২টি মহামান্য হাইকোট বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বে  চুড়ান্ত শুনানী শেষে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আইন নামে পরিচিত উক্ত আইনে জরুরী ভিত্তিতে বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে দরপত্র ছাড়াই মন্ত্রীকে এককভাবে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষমতা এবং এ সংক্রান্তে কোন প্রশ্ন কোন আদালতে উত্থাপন করা যাবে না মর্মে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার ১৮আগস্ট উক্ত আইনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। এরপর গত ২৭ আগস্ট এ আইনের ৬(২) উপধারা ও ৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্ছ করে হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক ও আইনজীবী মোঃ তায়্যিব উল ইসলাম সৌরভ। এ দুটি ধারাকে সংবিধানের ৭, ২১, ২৬, ২৭, ৩১, ৪২, ৪৪, ১৪৩ ও ১৪৫ অনুচ্ছেদের লংঘন বলে রিটে দাবী করা হয়।
 ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর আইনটি পাশ হওয়ার পর আমরা দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় অতিথি কলামে এ আইনটি দুর্নীতিকে আগাম দায়মুক্তি দিয়ে ভয়হীন ও উৎসাহিত করবে বলে মন্তব্য করেছিলাম। তখন আমি কক্সবাজার জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ছিলাম। দুর্নীতিবান্ধব আইনটি প্রথমে মাত্র ৪ বছর মেয়াদের জন্য ছিল,পরে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালের ৩ নং আইনদ্বারা মেয়াদ বাড়িয়ে ৮ বছর করে। 
আওয়ামী লীগ সরকার কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতে এ বিতর্কিত আইন করেছিল। সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর সাথে শাসকগোষ্ঠীর বড় নেতাদের গোপন ভাগাভাগির চুক্তি আছে বলে মিডিয়ায় নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। প্রায় ১৪ বছর আগে এই দায়মুক্তি আইনটি করার সময় বলা হয়েছিল জরুরী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সাময়িক সময়ের জন্য এটা করা হচ্ছে। কিন্তু পরে হাসিনা সরকার দফায় দফায় এটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। এই আইনের অধীনে নেওয়া হয়েছে শতাধিক প্রকল্প। কয়েক লাখ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে এই আইনের আওতায়। দীর্ঘ দিন ধরে দেশের স্বার্থ বিরোধী এই আইন বাতিলের দাবী জানিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
দুর্নীতিবন্ধব আইনটি করার আগে আমরা দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় ২১ অক্টোবর,২০০৮ সালে ’রাজনীতি থেকে দুর্নীতি পৃথকীকরণ নিশ্চিত করুন’ শিরোনামে কলাম প্রকাশ করেছি। ’রাজনীতি থেকে দুর্নীতি পৃথকীকরণ প্রসঙ্গে’ শিরোনামে বিগত ১৮/১২/২০২৩ তারিখ একই ধরনের আরো একটি কলাম প্রকাশ করেছি। দৈনিক কক্সবাজার সব সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব ছিল।
 আদালতে যেতে পারবেন না,এমন দায়মুক্তি দিয়ে কোন সভ্য দেশে এমন আইন হতে পারে না। এই লুটপাটবান্ধব বিতর্কিত আইনের অন্তত দুইট ধারা সরাসরি আমাদের সংবিধানের ৯টি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী হয়েছে। 
পিডিবির সর্বশেষ  নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৪৩টি। এর মধ্যে সরকারী বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬২টি। বাকী ৮১টি বেসরকারী খাতের। মোট উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। বিশেষ বিধান আইনে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে জ্বালানীর নিশ্চয়তা ছাড়াই। এর ফলে সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় বিগত তিন বছর ধরে গ্রীস্ম মৌসুমে লোডশের্ডি করতে হচ্ছে। অথচ জনগণের করের টাকায় পিডিবির এ বাড়তি সক্ষমতার দায় গুনতে হচ্ছে, টাকা দিতে হচ্ছে। চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয় পিডিবির। বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও দিতে হয়, না করলেও দিতে হয়। তবে অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দিলে পিডিবির লোকসান আরো বেড়ে যায়। জানা যায় গত দেড় দশকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ার পিছনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে ২৫ হাজার কোট টাকার বেশী। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই খরচ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়।
শুধু বিদ্যুৎ নয়,গ্যাস আমদানিতেও ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ এই মহাবিতর্কিত অভুতপূর্ব জাতীয়স্বার্থ বিরোধী আইন। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস(এলএনজি) আমদানী করতে বেসরকারী খাতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল করা হয়েছে এই আইনে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত এই আইনে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার এলএনজি আমদানী করা হয়েছে বলেও জানা যায়। মহা-দুর্নীতিবাজ মহা-স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর এখন উচ্চ আদালতের রায়ের পর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংবিধানবিরোধী আইনের অযৌক্তিক চুক্তির অস্বাভাবিক ভাড়া সহ সবকিছু পুনবিবেচনা ও পুনমূল্যায়ন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় স্বার্থে অবশ্যই তা করা উচিত। 

লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
 
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.