আইনজীবীদের শপথ ও আচরণবিধি : আদালতাঙ্গণে রাজনীতি !

আইনজীবীদের শপথ ও  আচরণবিধি : আদালতাঙ্গণে রাজনীতি !
পেশাগতভাবে কেবলমাত্র আইনজীবীদেরকেই ’বিজ্ঞ’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়। তাই আইনজীবীদের কাজে-কর্মে-আচরণে বিজ্ঞতার ছাপ থাকা আবশ্যক। প্রচলিত আইন অনুযায়ী আদালতে উকালতি করতে গেলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকর্তৃক স্বীকৃত যে কোন আইনজীবী সমিতির সদস্য হতে হবে।  তবে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী দল, আওয়ামী আইনজীবী লীগ,বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ, ইসলামী আইনজীবী পরিষদ ইত্যাদি হরেক নামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত সংঘটনের সদস্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। উক্ত দলীয় সংঘটনগুলোর সদস্য হওয়া আইনতঃ বাধ্যতামূলক নয়। বরং তা বাংলাদেশের বৃহত্তর আইনজীবী সমাজের ঐক্যের বুকে কুঠারাঘাত করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী আইন আদালতের ভাবমূর্তি, নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কোন কোন সময় প্রশ্নের সম্মূখিন হয় কেবলমাত্র আইনতঃ অপ্রয়োজনীয় রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণের প্রভাবে করা কাজের  কারণে। একজন আইনজীবীর নাগরিক হিসেবে যে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য বা নেতা হওয়ার অধিকার থাকলেও আদালতে ও আইনজীবী সমিতিতে সকল রাজনীতির উর্ধ্বে একজন পূর্ণাংগ আইনজীবী হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ বলে নিরপেক্ষ প্রকৃত আইনজীবীদের অভিমত। এতে করে জনসমক্ষে ও আদালতের কাছে  আইনজীবী হিসেবে যোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। কথিত স্বৈরাচার এরশাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুৎ করার কার্যকর আন্দোলন শুরু করেছিলেন দেশের ঐক্যবদ্ধ আইনজীবীরা। সকল রাজনৈতিক দলের আইনজীবী নেতারা বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট শামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ ছিলেন। ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে শরীক তিন জোটের নেতারাও আইনজীবীদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতেন, দেশবাসীও শ্রদ্ধার সাথে মান্য করতেন। আওয়ামী লীগ,বিএনপি,জামাত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরা ভোট দিয়ে শামসুল হক চৌধুরীকে ১৯৮৩-৮৪, ১৯৮৪-৮৫, ১৯৮৫-৮৬, ১৯৮৬-৮৭, ১৯৮৭-৮৮, ১৯৮৮-৮৯ সাল পর্যন্ত লাগাতার ছয়বার বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করেছিলেন।
 বিগত ৩/২/১৯৭৯খ্রিঃ তারিখ আমি,এডভোকেট আবুল কালাম ছিদ্দিকী,এডভোকেট দিল মোহাম্মদ চৌধুরী,মরহুম এডভোকেট আমজাদ হোসেন ও মরহুম এডভোকেট মোহাম্মদ শাহজাহান  বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে এডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে কক্সবাজার মহকুমা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়েছিলাম। আমরা ৫জন টিনের ছাউনীর, উত্তর দিকে ও দক্ষিণ দিকে বারান্দাসহ সেমি-পাকা আইনজীবী সমিতি ভবনে যোগদান করেছিলাম। তখন সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০জন। এখন কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি দুইটা অত্যাধুনিক বহুতল ভবনের মালিক,সদস্য সংখ্যা বার শতের অধিক। সকলে জজ কোর্টের আইনজীবী। কক্সবাজারে বর্তমানে একজন জেলা জজ, ৫জন অতিরিক্ত জেলা জজ, ২জন যুগ্ন জেলা জজ, তিনজন জেলা জজের মর্যাদা সম্পন্ন নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল, একজন চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট, অনেক জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট,অনেক সহকারী জজ,অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে উকালতি করার সুযোগ আছে। বর্তমানে কক্সবাজার জেলায় কর্মরত সকল বিচারকের সুনাম আছে, সততা নিয়ে বিতর্ক নাই। এখন জেলা আইনজীবী সমিতির লাইব্রেরীতে প্রচুর বই আছে। আমাদের দায়িত্ব হবে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে আইনানুগভাবে আদালতকে ন্যায় বিচার করতে সহায়তা করা এবং বিচারপ্রার্থী জনগণকে ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে আইনী সহায়তা দেওয়া। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হলে আইনের বই ও মামলার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বেশী করে পড়তে হবে। এই পেশায় পড়ার কোন বিকল্প নাই। আদালতে উপস্থাপনযোগ্য বক্তব্য মাঠেময়দানে, রাস্তাঘাটে পেশ করলে জনসমক্ষে আইন-আদালত ও আইনজীবীদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়।
বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বার কাউন্সিলকর্তৃক আয়োজিত একাধিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। সিলেবাসে থাকুক বা না থাকুক বাস্তবে আইন পেশা শুরু করতে গেলে প্রথম দিন থেকে অবশ্যই একজন আইনজীবী হিসেবে নিজের শপথ ও আচরণবিধি সম্পর্কে জানতে হবে এবং সব সময় স্মরণ রাখতে হবে। ’দি বাংলাদেশ লিগেল প্র্যাকটিশনারস এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস,১৯৭২ এবং ক্যাননস অব প্রফেশনাল কনডাক্ট এন্ড এটিকেট’ (  The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order,1972, The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Rules,1972, Canons of Professional Conduct and Etiquette ) বইটি পড়তে হবে। 
 ১৯৭২সালের রুলস এর ৬২(২) অনুচ্ছেদে ইংরেজীতে এডভোকেটের শপথনামা আছে যা বাংলা অনুবাদ করলে হবে,           ” আমি.......... সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আইনজীবীরূপে আমি আমার পেশার সুউচ্চ মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখিব; একই সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধ ও এই পেশার প্রতি যথাযথ নিষ্ঠাবান থাকিব এবং পেশাদারী আচরণ ও নৈতিক মানদন্ড অনুসরণ করিয়া চলিব। সংবিধানের রক্ষণ,সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানকে আমার পবিত্র কর্তব্য মনে করিব এবং বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ ইহার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিতে সচেষ্ট হইব। সংবিধানের পরিপন্থী কোন কর্মকান্ডের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করিব না। মানবাধিকার রক্ষায় আমি হইব একজন সদাপ্রহরী এবং এমন একটি সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখিব যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার সুনিশ্চিত হইবে।”
 বিজ্ঞ এডভোকেটদের ’বিজ্ঞতার’ ছাপ সব সময় দৃশ্যমান করার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগণের আস্থা ও সম্মান অর্জন করার  জন্য আইনে নির্ধারিত মোট ৪২দফা আচরণবিধি অনুসরণ করা অবশ্যই উচিত। এডভোকেটদের আচরণবিধি হিসেবে অধ্যায়-১ এ আইনজীবীদের প্রতি আচরণ ১-১১ দফা, অধ্যায়-২ এ  মক্কেলের প্রতি আচরণ ১-১৪ দফা, অধ্যায়-৩  এ আদালতের প্রতি কর্তব্য ১-৯ দফা ও অধ্যায়-৪ এ জনগণের প্রতি আচরণ ১-৮ দফা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ইদানিং উক্ত আচরণবিধি সম্পর্কে অনেক আইনজীবীই জ্ঞাত নন বা জ্ঞাত হলেও শ্রদ্ধাশীল নন বা যথাযথভাবে অনুসরণ করেন না। যদিও উল্লেখিত আচরণবিধি প্রত্যেক এডভোকেটের জন্য জ্ঞাত থাকা ও মেনে চলা একান্ত বাধ্যতামূলক। আচরণবিধির যে কোন ধারা অমান্য বা লংঘন করলে তা পেশাগত অসদাচরণ( Professional Misconduct ) বলে গণ্য হবে, যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করা হলে ট্রাইব্যুনাল গঠন পূর্বক পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগের বিচার করা হয় ও দোষী সাব্যস্থ আইনজীবীকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বা চিরকালের জন্য আইন পেশা থেকে বহিস্কারের মত কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। সেই সংক্রান্ত সংবাদ প্রায় সময় সংবাদপত্রে দেখা যায় যা খুবই দুঃখজনক। 
তবে দুঃখের সাথে এই সত্য স্বীকার করতে হবে যে ১৯৯১ সাল থেকে আইনজীবীদের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ্যে দলীয়করণ শুরু হয় যা এখন মারাত্মক আকার ধারণ করে বৃহত্তর আইনজীবী সমাজের ঐক্যেকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া রাজনৈতিক হিসেবে পরিচিত সুপ্রীমকোর্টের সাবেক বিচারপতি মানিক,সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক,মহিলা ও সাবেক মন্ত্রী দিপু মনি,মহিলা ও সাংবাদিক ফরজানা রূপা আদালত প্রাঙ্গণে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ দেশবাসী দেখেছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বলেছে তারা বাহিরের কোন লোককে আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে বা গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের কাছে যেতে দেন নাই। কালো পোশাক বা সাদা পোশাকে আইনজীবীরাই আসামীদের কাছে যেতে পেরেছেন। অতি সম্প্রতি আমির হোসেন আমুর আইনজীবীকে প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা লাঞ্ছিত করে মাটিতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ও বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পরের দিন পিপি সাহেব তা অস্বীকার করে বলেছেন আমুর পক্ষের একাধিক আইনজীবীদের মধ্যেই উকালতনামা দেওয়া নিয়ে হাতাহাতি হয়েছে। তা হলে আদালতের মধ্যে আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে? তা সম্পূর্ণ বেআইনী ও বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী দন্ডনীয় পেশাদারী অসাদাচরণ এর অপরাধ।
 এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণ হল উগ্র দলীয়করণ, প্রতিপক্ষের প্রতি চরম শ্রদ্ধাহীনতা ও মারাত্মক ঘৃণা। এই হিংসাত্মক ও অবৈধ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে আইনজীবীসহ সকলকে আইন মান্য করতে বাধ্য করা ও আদালতাংগণে বুয়েটের মত সর্মসম্মতিক্রমে রাজনীতি,রাজনীতিকরণ বা দলীয়করণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে, যা বর্তমান দলনিরপেক্ষ, ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত অন্তবর্তীকালীন সরকার না করলে আর কোন সরকারের করার সম্ভাবনা নাই। আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা এবং আদালতাংগণে রাজনৈতিক কার্মকান্ড চালানোর প্রবণতা দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থের পরিপন্থী।

লেখকঃ একজন কলামিষ্, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.