ইতিহাস কখনো অস্বীকার করা যায় না, যারা অস্বীকার করে তারা নির্বোধ। ইতিহাসের সব চেয়ে বড় শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহন করে না। আমরা এই দেশের মানুষ এখন পর্যন্ত তিনটা স্বাধীনতা দেখেছি। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ব্রিটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রামের পর পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়ে ১৯৭১ সালে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ বছরের নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থ-সম্পদ পাচার, হামলা-মামলা, আয়নাঘরে নির্যাতন, হত্যা-গুম ও পরিশেষে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানকে নির্মমভাবে দমন করার জন্য নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েও ব্যর্থ হয়ে ভারতে পালিয়ে গেলে দেশ আওয়ামী স্বৈরাচারমুক্ত হলে ৫ আগস্ট ২০২৪ দেশের মানুষ তৃতীয়বার স্বাধীন হয় । দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ছাত্রজনতার উপর গুলি চালায়নি। তারা ছাত্রজনতার গনবিস্ফোরণে হাজারো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। ক্ষমতার লোভ করে নাই, ক্ষমতা দখল করে নাই বা সামরিক শাসন জারী করে নাই। দেশে কিন্তু এখনও সাংবিধানিক শাসন চালু আছে। সামরিক শাসন জারী হলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সামরিক ফরমান অনুযায়ীই দেশ চলতো। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের আমলে দেশ যেভাবে চলেছিল। এখন দেশের সকল সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী ও জনগণকে দেশের সংবিধানসহ অন্যান্য প্রচলিত আইনকে সম্মান করতে হবে,মানতে হবে। আইনভঙ্গ করা বা আইন না মানা অপরাধ। স্বাধীনতা মানে যার যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীনতা নয়। অন্য জনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে আইনতঃ যা করা উচিত তা করাই স্বাধীনতা। যার যা ইচ্ছা নিজের হীন স্বার্থে সবাই তা করলে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আইন মানলেই সব কিছুতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে,দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার চিরদিন ক্ষমতায় থাকার কুমানসে প্রকৃত ভোটবিহীন পাতানো নির্বাচনের সংসদের ’ব্রæট মেজরিটি’ দিয়ে দলীয় স্বার্থে,ব্যক্তি স্বার্থে সংবিধান সংশোধনের নামে লেজেগোবরে ও লংকাকান্ড করে ফেলেছেন, যা গিলতে পারাও যায় না ফেলে দেওয়াও সম্ভব নয়।
আইন বিভাগ,নির্বাহী বিভাগ,বিচার বিভাগ সব কিছু নিলজ্জভাবে দলীয়করণ বা আওয়ামীকরণ, রাজনীতিকরণ করে দেশ জাতির বারটা বাজিয়ে দিয়েছেন পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার। আগে কি কোন দিন কেউ সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে এত মিটিং, মিছিল, মানববন্ধন, বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবীতে আন্দোলন দেখেছেন? সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে এখন তা দেখা নিয়মিত ব্যাপার নয় কি? আদালত প্রাঙ্গণে রাজনৈতিক শ্লোগান,জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়া নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারি আগে কেউ কি দেখেছেন? নিজেদের ইচ্ছামত, চাহিদামত আদেশ পাওয়ার জন্য বিচারকের উপর প্রকাশ্যে চাপ প্রয়োগ করা, প্রত্যাশিত আদেশ না পেলে বিচারককে বকাবকি করার ঘটনা আগে তেমন ছিল না। আইনজীবীদের মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে অবৈধ দলাদলি, হাতাহাতি, শোরচিৎকার ইত্যাদি দেখে অপরাধ-মনস্ক কতিপয় জনগণও এখন বিচারকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, শ্লোগান দেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অশনি সংকেত। তবে আশার কথা শুনেছি চকরিয়া উপজেলা আদালতে কর্মরত আইনজীবীরা দল মত দলীয়করণের উর্ধ্বে উঠে একতাবদ্ধ হয়ে বিচারকের পক্ষে দাড়িয়েছেন, স্বার্থান্ধ বিভ্রান্ত কতিপয় উগ্র মানুষের আদালত অবমাননাকর কার্যকলাপকে নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন। চকরিয়ার আইনজীবী বন্ধুদের স্যালুট জানাই।
কেন এমন নজিরবিহীন আদালত অবমাননাকর ঘটনা হচ্ছে? আগে যে আদালত অবমাননা আইন দেশে প্রচলিত ছিল আওয়ামী লীগ সরকার তা বাতিল করে নতুন আদালত অবমাননা আইন জারী করেছিল। রিট মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রীমকোর্ট নতুন আইন বাতিল করে দিলে তার বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছিল যা এখনও পেন্ডিং আছে। বর্তমানে দেশে কোন আদালত অবমাননা আইন চালু আছে তা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। বিচারপতিদের অসদাচারণ বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে তা তদন্তের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট সিনিয়র বিচারপতিদের নিয়ে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান ছিল। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার সেই বিধান বাতিল করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে আসলে তা নিয়ে মামলা হয়। প্রধান বিচারপতি এস,কে সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রীমকোর্ট তা বাতিল করে দিয়েছেন যার জন্য এস,কে সিনহাকে দেশত্যাগে ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে । সরকার পক্ষে সুপ্রীমকোর্টের সেই রায় রিভিউ করার দরখাস্ত দিলেও তা এখনও পেন্ডিং আছে। সুতরাং বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের আইনও আওয়ামী স্বৈরাচার অকার্যকর করে রেখেছে। ছাত্রদের দাবীর প্রেক্ষিতে বিচারপতিদের পদত্যাগ করার বা তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের পথও আওয়ামী লীগ সরকার জটিল করে দিয়েছে। আমি ১৯৯১ সালে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলাম। কথিত স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিন ঐক্যজোটের স্বাক্ষরিত রূপরেখা বা সমঝোতাপত্র উপেক্ষা করে সেই বছর থেকেই আইনাংগন তথা বিচার বিভাগ দলীয়করণ শুরু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগের দলীয়করণ ষোলকলা পূর্ণ করে এখনকার এই অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই অসহনীয় অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একমাত্র প্রতিকার আইন আদালত প্রাঙ্গণকে দলীয়করণমুক্ত, রাজনীতিমুক্ত করা। অতি সম্প্রতি দলীয় পরিচিতির বা দলীয়করণের উর্ধ্বে উঠে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় কর্মরত আইনজীবীরা আদালতের স্বাধীনতা ও মানসম্মান রক্ষার তাগিদে একতাবদ্ধ হয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে দেশের সকল আইনজীবীদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।