প্রবাস জীবন

প্রবাস জীবন
খালেদা বেগম জ্যোৎস্না :

আপু দেখ দেখ দুলাভাইয়ের প্লেন নামতেছে। সদ্য তরুণীটি পারলে নেচে উঠে খুশীতে। মা, বাবা, ভাই, বোন, তালুই, মাউয়, তালত ভাই বোন এক দংগল এসেছে, ছেলে/মেয়ের জামাই বিদেশ থেকে আসছে তাকে রিসিভ করার জন্য। ছেলের মা বাবা চোখ ছল ছল, বউয়ের চেহারায় লাজুকভাব, বাকীদের চোখে মুখে আনন্দ। যা নিত্য দিনের বিষয়, বর্তমানে এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না, যে পরিবারের কেউ না কেউ বিদেশে গেছে বা আছে। হয়ত কাজ, লেখাপড়া, স্বামী বা স্ত্রীর ভিসায়। আমাদের সময় দেখা যেত ছেলেরা বেশীরভাগ লেখাপড়ার জন্য আর মেয়েরা স্বামীর সাথে বিদেশ যেত।
একপর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার প্রবণতা ছিল, টাকার আয় করার জন্য, প্রয়োজনের তাগিদে। বুকে কন্ঠ, চোখে জল, গলা দিয়ে কথা বের হয় না, মুখে এখানা অদ্ভুত হাসি। কোন রকমে ক্রাফটে উঠা, তারপর সবার সে কি কান্না। যা চেপে রেখেছিলেন। আমার একবার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো প্লেনে সব যাত্রী হাউ মাউ করে কান্না করছে, ক্র, হোস্টেস সবাই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে, হয়ত, তারা অভ্যস্ত। পাশের সীটের ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাওতে প্রথমে কান্না চাপতে সময় নিলেন, তারপর বলল দশ মাসের ছেলেটাকে রেখে যাচ্ছে, মেয়েটা আব্বু আব্বু ডাকতে শিখেছে, মায়ের হার্টের অসুখ, বিগত দশ বছর বিদেশে আছেন, দেশে কিছু করার মতো অবস্তা হলে চলে আসবেন। এরকম কতজনের কথা শুনবেন। যারা বিদেশে গিয়ে টাকা আয় করে তারা জানেন, এ যেন আশি বিষে দংশিনি যারে। কিন্তু দেশে যাদের জন্য টাকা পাঠান, তাদের খরচপাতি, খাওয়া দাওয়া, কেনাকাটা দেখলেই মনে হয় এনারাই বিদেশে থাকেন।
বাহাদুরি, ফুটানি কাকে বলে! এ ফুটানি, বাহাদুরি এক সময় বের হয়, যখন বিদেশ ফেরত এসে জানতে চান, কত টাকা জমা আছে, কি সম্পদ কিনেছেন, কার নামে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন প্রায় বাড়ীতেই খেলা চলে, খেলা মারামারি, খুনাখুনি পর্যন্ত গড়ায়। এমনও দেখা যায়, সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করেছে, কিন্তু যে বিদেশে আছে, তার কোন অংশ নাই, কারণ যারা ভাগ করেছেন তাদের মনগড়া কাহিনী সে তো বিদেশে ভাল আয় করে দেশে ফিরবে না, তার ভাগ রাখার দরকার নেই ।

যে মাঝখানে লেখাপড়ার জন্য বিদেশে পাঠানো ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছিলো। গর্ব করে মা বাবা বলতেন ছেলে অমুক দেশে পড়ছে। অনেকে সত্যিকারের লেখাপড়া করেন, অনেকে আবার মা বাবার পাঠানো টাকায় মৌজ মাস্তি করেন, যা আদৌ মা বাবা জানেন না । কেউ বা কাক হয়ে ময়ূরপুচ্চ ধারণ করে, তখন না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায় পড়েন। কেউ পড়াশুনা বাদ দিয়ে টাকা কামানো ধান্ধায় জড়িয়ে পড়েন, যা মা বাবার উদ্দেশ্য ছিল না। ন্যাশ্যনালিটি পাওয়ার জন্য হেন কাজ নাই যা করেন। হরেক রকম বিয়ে করেন, যদি সোনার কাঠি হাতে পাওয়া যায়! ইদানীং বলে বড় রাস্ট্রে গেছে, অর্থাৎ ইতালি, জার্মান ইত্যাদি। বিয়ের বাজারে উনারা হীরা, আবার যৌতুক হিসেবে অনেকে ভিসার আবদার করে। পাশের বাসার এক তরুণ দীর্ঘদিন আমেরিকা থাকার পর দেশে ফিরে, অনেকটা গৃহবন্দী, কারণ তার বন্ধুরা সব টাকার গল্প করে, যা তার পছন্দ না । খুব কাছের এক জনকে জানি, বিদেশ থেকে আসার পর বসন্তের কোকিলের মতো বন্ধুরা টাকা ফুতুর করে সরে গেছে, এক সময়কার তুখোর মেধাবী ছাত্র অবসন্ন, বিষন্ন, হাজারো কন্ঠ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে। তবে আজকাল আমাদেশের ছেলেমেয়েরা খুব ভালো করছেন, দেশের সুনাম বয়ে আনছেন, বিদেশেও সুনাম কুড়াচ্ছেন। কেউ দেশে ফিরছেন, আবার কেউ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচেছন, যা প্রশংসার দাবীদার। আমরা তাদের জন্য বুক ফুলিয়ে গর্ব করি, সরকারও নানা রকম সুযোগ সুবিধা দিয়ে উৎসাহিত করছেন।
নারীদের কথায় আসি, সবাই জানেন কয়েক বছর আগে, ঢাকায় সম্মেলন করে জনগনকে তাঁদের কষ্ঠের কথা জানিয়েছে, যার প্রেক্ষিতে সরকার বেশ কিছু নারীবান্ধব পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর পরেও যারা যাচেছন তাদের অবস্থা অথৈবচ। কোন একটা এয়ারর্পোটে ট্রানজিটের জন্য অপেক্ষা করছি, অনেক দেশের যাত্রী আছেন, হটাৎ দেখি একটা মেয়ে এসে মোবাইলটা চায়লো, জানতে চাইলাম উনার কাছে আছে কি না, জানালো আছে কিন্তু ডাটা বা ডলার নাই, যা দিয়ে সে দেশে কথা বলতে পারবে। অগত্যা দিয়ে যা দেখলাম সে কি কান্না তার, কোন রকমে চোখের পানি চেপে রাখলাম, কারণ আশেপাশের লোকজন তাকিয়ে আছে।"
এয়ারপোর্টে (দেশের বাইরে) যারা ঝাড়ু দিচেছ সব দেশি কম বয়সের ছেলে ধরেন ২০-২২ বছরের, কয়েকজন এগিয়ে এসে কথা বল্ল, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের সন্ধানে এসেছে, দেশে নিয়মিত টাকা পাঠায়। ওরা কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম, কারো চোখ ছলছল, কারো গলা দিয়ে ঠিক মতো কথা বেরুচেছ না, কেউ একপাশে দাড়িয়ে, যাতে চেহারা দেখা না যায়। একসময় উঠে ওয়াসরুমে গেলাম, যারা কাজ করছে সব দেশি মেয়ে। যদিও বর্তমানে আমাদের দেশেও বাসস্টপেজ গুলোতে মেয়েরা কাজ করছে। কোন কাজই নিন্দনীয় নয়। কথা হচেছ যাঁরা টাকা কামানোর জন্য বিদেশে গেছেন তাদের পরিবার কি জানেন তারা কি কাজ করছেন, আর কত কষ্ঠের কাজ করছেন। যদি জানেন খুব ভালো, কিন্তু বেশীর ভাগই সঠিক কাজটা গোপন রাখেন, হয়ত পাছে লোকে কিছু বলে এই ধারণায়। আর একদল আছেন, তাদের পোস্ট দেখবেন ঘর, আংগিনা সব সময় ঝকঝকে, একটা শাড়ী পড়ে, মাথায় কিছু ফুল গুঁজে ছবি তুলে বিভিন্ন দিবস পালনের, যারা করে, কষ্ঠ থেকেই করে। কারণ তার আপনজন কেউ কাছে নেই, নিজে খুশী এবং আপনজনদের খুশীর জন্য এ কাজ। এরা আবার নিজস্ব পরিধির মধ্যে কিটি পার্টি করে। যাওয়ার সময় রেইন কোট গায়ে দিয়ে যায়, ভিতরে ঢুকে কোট খুলেল দেখা যায়, বাহারি পোষাক, বলে এটা একটা সুযোগ বাহারি কাপড় পড়ার, যা আমাদের বোধের বাইরে, কারণ আমাদের সাজুগুজু করতে কোন পার্টি লাগে না, হরেক ধরনের অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।
এমনও দেখ যায় ওদের দিন আমাদের রাত, ওদের মাথায় থাকে না, মা সারাদিন কাজের পর ক্লান্ত, কিন্তু ছেলে ঘুম থেকে উঠে ভিড়িও কলে থাকবে, মা অনেক সময় ঐ লেপটপের উপর ঘুমিয়ে পড়ে। আরো মজার, বাচ্ছা ছোট, বাবা কাজে গেছে, ভিন্ন দেশে থাকা বোনের সাথে কথা বলার সময় মায়ের হয়ত ওয়াস রুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েছে, তখন বলে তুই কি আমার বাচচাটা দেখতে পারবি, দেখে কিন্তু, ডিজিটালি বাচচার সাথে খালা গল্প করে, রাইমস শোনায়, খেলনা দেখ, কেউ থাকে কানাডায় কেউ থাকে লন্ডনে, যা আমরা কোন সময় কল্পনাও করিনি।
অনেককেই দেখেছি পায়ের গোড়ালি শক্ত হয়ে গেছে, কারণ টানা দাঁড়িয়ে আট ঘন্টা কাজ করতে হয়, এর মধ্যে তিরিশ মিনেট টিফিন বা খাবারের সময়। কারো টানা ডীপ ফ্রিজ খুলতে আর বন্ধ করতে হাতের আংগুল, বেঁকে গেছে। আস্তে আস্তে এসব বাড়তে থাকে। এমন কি অপারেশনে যে ১০০% নিরাময় হবে, তার গ্যারান্টি কোন ডাক্তার দেন না। কারো কোমরের হাঁড় বাঁকা হয়ে পড়েছে, কুজু হয়ে পড়েছে, এটা কাজের উপর।
ভাবুন তো কি অমানবিক কণ্ঠ করে আমাদের লোকগুলো। এরা যখন দেশে ফিরে বিদেশের ইয়ারপোর্টে যেমন নাজেহাল হন, তার চেয়ে বেশী দেশে। দেখেছি বোনের বিয়ের জন্য তিন ভরি স্বর্ণ এনেছে, কেউ মেয়ের জন্য কানের দুল, বউয়ের জন্য গলার চেইন, মায়ের জন্য কম্বল। যেখানে হাজার ভরি পাচার হয়, ব্যাংকের টাকার হদিস পাওয়া যায় না, তাদের বেলায় লবডংকা, আর যত বেহুদা আইন ঐসব বেচারাদের বেলায়। অথচ এনারাই বেশি রেমিটেন্স পাঠান, স্যুটেট বুটেটরা তো আয়েশি করতে বেশির ভাগ টাকা খরচ করে, যা পাশের দেশের কোন এক মন্ত্রী বলেছিলেন। কে একজন একটা মুভির কথা বলেছিল, বিদেশে গিয়ে তরল মেটাল মেখে ঠাই দাড়িয়ে থাকে, পথচারীরা ভিক্ষা দেয়। সে আবার কোন গাড়ীর পাশে, সুন্দর কটেজের সামনে দাড়িয়ে দেশে ছবি ওয়াটসআপ করে, নীচে লিখে দেয় এসবের মালিক সে। ম্যাথুয়ু বলে এক তরুনের সাথে পরিচয় হয়েছিলো, যার মা জার্মান, বাবা ফ্রান্সের। সে ইয়ুরোপে পড়ে। মা বাবা দু জনেই খরচপাতি পাঠাই। যখন পাঠান না তখন সে বাঙ্কিং করে, সে নির্দ্বিধায় জানালো, তার মাথার হেট টা সিটি সেন্টারে মাঝ বরাবর রেখে গিটার বাজায়, আর লোকজন ডলার,পাউন্ড যা খুশী দেয়, তাতে তার খরচ মিটে যায়। ভদ্র ভাষায় ভিক্ষা, যা আমাদের দেশে করে না।
যারা বিদেশ থেকে এসেছেন তাদের খবরের চেয়ে মূল্যবান তার ব্যাগেজ, মা, বোন না বউ কে খুলবে তা নিয়ে চলে কষাকষি। অমুকের জন্য কেন কিছু আনে নি তা নিয়ে অনেক কথা। অনেকে আবার লিস্টি পাঠিয়ে দেয়, তোদের ওখানকার এ জিনিস, সে জিনিস টা ভাল, ভাবে না তার ওয়েট লিমিট আছে। হায় রে বেচারা, দেশে এতো ফুলকি, আবার গিয়েও ফুলকির মুখে। পৃথিবীটা এমন চিড়িয়াখানা যে কেউ সবাইকে খুশী করতে পারে না, বরং এ চেষ্ঠা বৃথা। তাই সবাইকে সন্তুস্ট, খুশী করার চেয়ে নিজের খুশীটাকেই প্রাধান্য দেওয়া দরকার। বিদেশ থেকে লাগেজ নিয়ে আসার ধকল যারা আনেন তারা বুঝেন।
আমার এক ভাই বলেন, বোন রে, তোকে বলি, মনে কর চায়ের কেটলিটা সুইস দিয়ে হিটারে বসিয়েছিস, কিন্তু পানি দিতে ভুলে গেছিস, কেটালি জ্বলছে জ্বলছে। সবাইকে ছেড়ে থাকতে আমাদের অবস্তা ঐ কেটলির মতো। একটা ফোন আসলে বুক ধকধক করে, কি খবর? কোন সময় ভাল জিনিষটা মনে আসে না রে।
অনেক চাকরীজীবি সল্প, মধ্য বা দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদেশে যান। আমার এক ভাইয়ের ছেলে কিছু সময়ের জন্য গিয়েছিলো, আরে সে গল্প শুনতে শুনতে আমাদের সব মুখস্ত, সব চেয়ে ভাল শ্রোতা ছিল আমার ছোট  জামাই,, আবার বড় জন পারত পক্ষে দু একটা গল্প করে, তাও যদি জানতে চাই এমনটা অনেক চরিত্র পাবেন। এই বিশ্বায়নের যুগে বিদেশে যাওয়া আসা ঠেকাতে পারবেন না, দিনে দিনে বাড়বে, যাঁরা রেমিটেন্স দিচেছ তাদের প্রতি সদয় হয়, আপন লোকজনদের কি মাছ রান্না করছেন সে খবর না দিয়ে আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, মা,বোন, ছেলে, মেয়ে যারা বিদেশে, তাঁরা কি অবস্থায় থাকেন, কতটা সময় কাজ করেন, মালিকের ব্যবহার কেমন, সময়মতো খাচেছন কি না, সুস্থ্য কি না, কোন অবসর আছে কি না? সে খোঁজ নিন, মনোবল বাড়ান, আনকন্ডিসনাল ভালোবাসুন !!!
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.