প্রবারণার শিক্ষা ও প্রেক্ষাপট

প্রবারণার শিক্ষা ও প্রেক্ষাপট
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু :

আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই সময়কাল কে বৌদ্ধ পরিভাষায় বর্ষা ঋতু বলা হয়। বুদ্ধ যুগে চার মাসে এক ঋতু গণনা করা হত। এই বর্ষা ঋতু প্রবারণা উদযাপনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। আশ্বিনী পূর্ণিমার অপর নাম প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রবারণা মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘের একটি বিনয়-কর্মের নাম।
বুদ্ধের সময় শত শত এমনকি হাজার হাজার ভিক্ষুসংঘ একই স্থানে একসঙ্গে অবস্থান করে ধর্ম ও বিনয় শিক্ষা করতেন। একত্রে অবস্থানকালীন ভুল-ত্রুটি হতে পারে এই চেতনা থেকে প্রবারণা উদযাপন করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। প্রবারণা মানে ভুল-ত্রুটির নির্দেশ। আশার তৃপ্তি, অভিলাষ পূরণ ও ধ্যানশিক্ষা সমাপ্তি। সকল প্রকার ভেদাভেদ, গøানি ভুলে গিয়ে দোষমুক্ত হওয়ার জন্য ভিক্ষুসংঘ পবিত্র সীমা ঘরে সম্মিলিত হয়ে একে অপরের নিকট ভুল স্বীকার করেন। ভুল-ত্রæটি দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকার করে সংশোধনের প্রচেষ্টায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই প্রবারণার শিক্ষা।
আরেক অর্থে প্রবারণার অর্থ হল, বরণ আর বারণ করা। অর্থাৎ সকল প্রকার পাপকর্ম, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ, রিপুর তাড়না বর্জন বা বারণ করে পুুণ্যকর্ম সম্পাদন বা যা সত্য, সুন্দর, ন্যায় তা বরণ করার শিক্ষা প্রবারণা দিয়ে থাকে।

প্রবারণার বিধান প্রজ্ঞপ্তি:
মহাকারুণিক বুদ্ধ তখন শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। কোশলরাজ্য হতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভিক্ষুসংঘ বর্ষাবাস শেষে বুদ্ধ-দর্শনে এলেন। বুদ্ধের সঙ্গে তাদের কুশলাদি বিনিময় হল। বুদ্ধ তাদের কাছ থেকে কীভাবে তাঁরা বর্ষাবাস উদযাপন করেছেন তা জানতে চাইলেন। তাঁরা উত্তর দিলেন, পরস্পরের সঙ্গে বাদ-বিসংবাদ এড়াবার জন্য তাঁরা প্রত্যেকে মৌনভাবে বর্ষাবাস অতিবাহিত করেছেন। বর্ষাব্রতের সমাপ্তিতে তাঁরা কেউ কারো সঙ্গে কোনো ধরনের বাক্যালাপ না করে মৌনভাব বজায় রেখে বুদ্ধ-দর্শনে এসেছেন।
তাদের কথা শুনে শাস্তা বুদ্ধ তাদের উপদেশ দিলেন, " হে ভিক্ষুসংঘ, একসঙ্গে অবস্থান করলে মৌনব্রত পালন উচিত নয়। তোমাদের এরূপ আচরণ প্রশংসাযোগ্য নয়। বর্ষাবাস শেষে তোমরা প্রবারণা উদযাপন করবে। তোমাদের জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাত ভুল-ত্রæটির জন্য একে অপরের প্রতি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। একস্থানে থাকাকালীন একজন অপরজনকে অনুশাসন করলে উভয়ের কল্যাণ হয়। শাসন পরিশুদ্ধ হয়। এতে সমগ্র ভিক্ষুসংঘের শ্রীব্রদ্ধি সাধিত হয়।"
অতঃপর তথাগত বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে আহবান করে বাধ্যতামূলকভাবে প্রবারণা উদযাপনের বিধান প্রবর্তন করেন।
প্রবারণার প্রকারভেদ:
বিনয় বিধান অনুসাওে প্রবারণা দুই প্রকার।– ১। পূর্ব-কার্তিক প্রবারণা ২। পশ্চিম কার্তিক প্রবারণা। আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করে আশ্বিনী পূর্ণিমায় যে বর্ষাবাস সমাপ্ত হয় তা পূর্ব-কার্তিক প্রবারণা। আর আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বর্ষাবাস আরম্ভ করেও মাস পর যে প্রবারণা অনুষ্ঠিত হয় তার নাম পশ্চিম কার্তিক প্রবারণা। এই দ্বিবিধ বর্ষাবাসকে যথাক্রমে ১ম ও ২য় বর্ষাবাস বলা হয়। এটা সম্পূর্ণরূপে ভিক্ষুসংঘ কেন্দ্রিক বিনয়গত একটি বিষয়। 
প্রবারণা পূর্ণিমাকে ঘিরে কিছু আনুষ্ঠানিকতাও আছে। ফানুস উত্তোলন, কল্পজাহাজ ভাসানো, বিহারে বিহারে আলোকসজ্জা, বুদ্ধপূজা, দান করা, শীল পালন করা, ধ্যানচচর্চা করা, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, দেশ ও বিশ^শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনাসহ নানাবিধ আচার-আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়ে থাকে। তবে এসবের মধ্যে কোনটাই প্রবারণার মূল অনুষ্ঠান নয়। এগুলো প্রবারণা উপলক্ষে পালিত একেকটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। প্রবারণা মূলত, আত্মশুদ্ধির আহবান জানায় এবং এটা প্রধানত ভিক্ষুসংঘ কেন্দ্রিক এবং দ্বিতীয়ত, বৌদ্ধ নর/নারী যারা তিনমাস ব্যাপী উপোসথ শীল পালন করেছেন তারা এই দিনে তিনমাস ব্যাপী একটানা চলা বর্ষব্রতের সমাপনী উপোসথ শীল পালন করে থাকেন।  
প্রবারণার অত্যুজ্জল স্মৃতিসমূহ লালন করতে প্রবারণা উদযাপনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর মূল শিক্ষাও আমাদের অন্তরে ধারণ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক চেতনা, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, অনৈতিক কর্মকান্ড, হিংসা, হানাহানি, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইত্যাদি খারাপ দিকগুলো আমাদেরকে বর্জন করতে হবে। সত্য, সুন্দর যা আত্ম ও পরকল্যাণকর, সুখপ্রদায়ী, শান্তিময় এবং দেশ ও দশের জন্য কল্যাণকর সেসব কর্মকান্ডে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে হবে।
শুভ প্রবারণা উপলক্ষে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে দেশবাসীকে জানাই মৈত্রীময় শুভেচ্ছা। জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার। সভাপতি, কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.