হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর :
আমরা কি গভীরভাবে হিসাব করেছি? আমাদের জীবন থেকে যে দেখতে দেখতে আরও একটি বছর বিয়োগ হয়ে গেলো! ১৪৪৫ হিজরী বিদায় নিয়ে সূচিত হলো ১৪৪৬ হিজরী নববর্ষ। এভাবে বছরের বিদায়-আগমন আল্লাহ পাকের কুদরতী ব্যবস্থাপনারই অংশ। দিনে সূর্যের কিরণ, রাতে চাঁদের আলো, রাতের শেষে দিন, দিনের শেষে রাত এভাবে সপ্তাহ, মাস, বছর করে ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর হায়াতের ক্রমশঃ সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া আল্লাহ তা'আলার চিরন্তন নিয়মেরই ধারাবাহিকতা। মানুষ যাতে সময়ের হিসাব রেখে সন্তর্পনে জীবন যাপন করতে পারে, ক্ষণস্থায়ী এই হায়াতের শেষে একদিন যে অবশ্যয়ই আল্লাহর দরবারে ফিরে যেতে হবে তা যাতে কেউ ভুলে না যায় সে জন্য আল্লাহপাক দিন রাতের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যদিয়ে বর্ষের গমনাগমনের এই নেজাম কায়েম করেছেন। এতে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য রয়েছে আল্লাহ তা’আলার মহান নিদর্শন। এ বিষয়ে কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি বানিয়েছেন সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনজিল সমূহ, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব, আল্লাহ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি। কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে। নিশ্চয় রাত-দিনের পরিবর্তনের মাঝে এবং যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমীনে সবই হল নিদর্শন সে সব লোকের জন্য যারা ভয় করে’। (সূরা- ইউনুছ, আয়াত- ৫ ও ৬)। অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে’। -(সূরা- আলে ইমরান, আয়াত- ১৯০)।
কুরআনে কারীমের উপরোক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা প্রতিভাত হয়, দিন রাতের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যদিয়ে বছরের বিদায়-আগমনে বোধসম্পন্ন, জ্ঞানী ও তাক্ওয়াবান লোকেরা অবশ্যয়ই চিন্তা করবেন। তারা জীবনের হিসাব করে আপন বিবেকবোধ থেকে বলবেন, দেখতে দেখতে জীবন থেকে আরও একটি বছর বিদায় নিয়ে গেল, হায়াত ক্রমশঃ ফুরিয়ে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্য কি আমল করতে পারলাম! নিজেকে আল্লাহ তা’আলার খালিস বান্দাহ্ হিসেবে কতটুকু গড়তে পেরেছি। মহানবী স. এর প্রকৃত উম্মত হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করতে পেরেছি কি না? হায়াত শেষ হয়ে গেলেতো আর আমল করার অবকাশ নেই। এমন অনুভূতিই মুমিনদের অন্তরে জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন।
একেকটি বছরের বিদায় মানে তো হায়াতের গন্ডি ছোট হয়ে আসা, মৃত্যুর পথে অগ্রসর হওয়া! তাই নববর্ষ বরণের নামে কোন প্রকৃত মুসলমান বা নীতিবান মানুষ অনৈতিক উল্লাসের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিতে পারে না। মেতে উঠতে পারে না অপসংস্কৃতিতে। বরং বিদায়ী বছরের যে সময়টুকু আল্লাহ তা’আলার মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত করার তাওফিক হয়েছে তার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন, আর যা আল্লাহর নাফরমানিতে কেটেছে তার জন্য অনুশোচনা, সেই সাথে মহান আল্লাহর নিকট আগামীতে সৎ জীবন যাপনের তাওফিক এবং আগত বছরের জন্য শান্তি ও রহমত কামনা করাই বর্ষের গমনাগমনে আমাদের জন্য ইসলামের মহান শিক্ষা।
কারণ জীবনের প্রতিটি মূহুর্তের হিসাব রাখা এবং আল্লাহভীতি তথা পরকালীন জবাবদিহির মানসিকতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করা মু’মিনদের জন্য কর্তব্য। মানবতার মুক্তির অগ্রদুত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ স. ইরশাদ করেন ‘পাঁচটি অবস্থাকে পাঁচটি অবস্থার পূর্বে গণীমত মনে কর, তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, তোমার ধণাঢ্যতাকে দারিদ্রের পূর্বে, তোমার অবকাশকে ব্যস্ততার পূর্বে, তোমার জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে’। এই হাদীসে যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে এবং জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে মূল্যায়নের তাগিদ দিয়ে রাসুল স. মূলতঃ হায়াতকে দায়সারাভাবে না কাটিয়ে প্রতিটি মূহুর্ত পরকালীন জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে অতিবাহিত করার শিক্ষাই দিয়েছেন। এই শিক্ষার অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার জন্য একটি বর্ষের বিদায় এবং নতুন বর্ষের আগমনের এ সন্ধিক্ষণ খুবই গুরুত্ব বহন করে। গত বছরের পর্যালোচনা ও নতুন সঙ্কল্পে উজ্জীবিত হওয়ার এটি যথার্থ সময়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের হিসাবের সময় খুবই নিকটে। অথচ তারা গাফিল হয়ে বিমূখ হয়ে রয়েছে’।- (সূরা- আম্বিয়া, আয়াত-১)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক র. বলেন, ‘হিসাব করার পূর্বে নিজের হিসাব করে নাও, তোমার আমল পরিমাপ করার পূর্বে নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও। তোমার জীবনের আমলকে সজ্জিত করে নাও, কিয়ামত দিবসের সেই বিশাল ময়দানে উপস্থিতির প্রস্তুতি নাও, যেদিন কারো আমলনামা স্পষ্ট থাকবে না।-(তিরমীযী)।
অতএব মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাহর মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনা। আসুন, হিজরী নববর্ষের এই মহতি সন্ধিক্ষণে অতীতের গোনাহ'র জন্য তওবা করে নিই এবং ভবিষ্যতে আল্লাহ তা'আলার হুকুম ও রাসুল স. এর তরীকা মোতাবেক আদর্শিক জীবনধারার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করি।
লেখক-
খতিব, শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।