মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ :
দু'বছর থেকে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরাইল নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সংকটসহ নানাবিধ টানাপোড়নে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটা শ্লথ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির এই নেতিবাচক গতির মধ্যেও স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত মূল্যায়নে বেশ ভালোভাবেই উতরে গেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতিমালা বিষয়ক কমিটি (সিডিপি)’র ২৬তম অধিবেশনে ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের তিনটি সূচকেই টানা তৃতীয়বারের মত উত্তীর্ণ হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪-৮ মার্চ, ২০২৪ তারিখে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে সিডিপি’র এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে এলডিসি তালিকা প্রণয়নের পর থেকে এ যাবত এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া সাতটি দেশ এবং উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এমন ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র সদস্য রাষ্ট্র যেটি টানা তিন মূল্যায়নে সব সূচকে উত্তীর্ণ হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বরই হচ্ছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
গত শতকের ৬০ এর দশকের শেষ দিকে বিশ্বে এলডিসি ধারণার জন্ম নেয়। ১৯৭১ সালের ১৮ নভেম্বর প্রথম জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা প্রণয়ন করে। পারম্ভিক তালিকায় ২৫টি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে ৪৬টি দেশ এলডিসি তালিকাভুক্ত। মাথাপিছু কম জাতীয় আয়,অনুন্নত মানবসম্পদসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিম্নমানের সূচকধারী দেশগুলোই এলডিসির অন্তর্ভুক্ত।
সিডিপি তিনটি সূচক যথা- মাথাপিছু জাতীয় আয় (Gross National Income per capita), মানবসম্পদ সূচক (Human Assets Index) এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের (Economic and Environmental Vulnerability Intex) ভিত্তিতে তিন বছর পরপর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয় পর্যালোচনা করে। মানবসম্পদ সূচকের মান আবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এই দুটি পৃথক উপসূচকের মানের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। স্বাস্থ্য সূচকের মান নির্ণিত হয় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার এবং অপুষ্টির ব্যাপকতার ভিত্তিতে। শিক্ষা সূচকের মান নির্ধারণ হরা হয়ে থাকে নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার হার এবং নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতার হারের ভিত্তিতে। অনুরূপভাবে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের মান পৃথকভাবে নির্ণিত হয় অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মান ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের মানের উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক একটি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষি, বন ও মৎস্যখাতের অবদান, বিশ্ববাজার থেকে দেশটির বিচ্ছিন্নতা, বাণিজ্য ঘনত্ব এবং রপ্তানিখাতের অস্থিতিশীলতা এই বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। অনুন্নত উপকূল অ ল ও মরু অ লে বসবাসরত জনসংখ্যার অনুপাত, দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যা এবং কৃষিজাত উৎপাদনে অস্থিতিশীলতার মানের ভিত্তিতে পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের মান নির্ণয় করা হয়।
২০১৮, ২০২১ ও ২০২৪ সালের সিডিপি’র ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের নির্ধারিত সীমা এই থাকলেও মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নির্ধারিত সীমা সময়ের সাথে কিছুটা হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে টানা তিনি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে মানবসম্পদ সূচকের সর্বনিম্ন সীমা ৬৬ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের সর্বোচ্চ সীমা ৩২ নির্ধারিত ছিল। অপরদিকে, ২০১৮ সালের মূল্যায়নে সর্বনিম্ন মাথাপিছু জাতীয় আয় ১,২৩০ ডলার, ২০২১ সালে এই সূচকের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন ১,২২২ ডলার এবং চলতি বছরের মূল্যায়নে এই পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ১,৩০৬ ডলার।
কোন সদস্য রাষ্ট্র সিডিপি’র পর পর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে উপরিউল্লিখিত তিনটি সূচকের যেকোন দুটির নির্ধারিত সীমা (threshold) অর্জন করতে পারলে অথবা মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নির্ধারিত সীমার দ্বিগুন (চলতি ২০২৪ সাল থেকে এটি তিনগুন করা হয়েছে) অর্জন করতে পারলে সিডিপি ঐ দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে থাকে। সিডিপি’র সুপারিশ প্রাপ্তির পর ঐ বছরের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রেজুলেশনের মাধ্যমে দেশটিকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয় এবং উত্তরণের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে অনুমোদন প্রাপ্ত সদস্যরাষ্ট্রকে প্রস্তুতিমূলক সময় (preparatory period) হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত তিন বছর তবে বিশেষক্ষেত্রে এই সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে)। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে একটি দেশ চূড়ান্তভাবে উত্তরণের পরও উত্তরণকাল (transition period) হিসেবে কিছুটা সময় পেয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৮ সালের ১২-১৬ মার্চ তারিখে নিউউয়র্কে অনুষ্ঠিত সিডিপি’র ২০তম অধিবেশনের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে বাংলাদেশ প্রথমবারের মত এলডিসি থেকে উত্তরণের মাপকাঠি অর্থাৎ তিনটি সূচকেই নির্ধারিত সীমা অর্জন করতে সক্ষম হয়। সিপিডির মূল্যায়নে সে সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ১,২৭৪ ডলার। অন্য দুটি সূচক অর্থাৎ মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের অর্জন করে যথাক্রমে ৭৩.২ পয়েন্ট ও ২৫.২ পয়েন্ট। এলডিসি থেকে উত্তরণের নিয়মানুযায়ী পরের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন অর্থাৎ ২০২১ সালের মূল্যায়নেও বাংলাদেশকে যেকোন দুটি সূচকের নির্ধারিত মাত্রা অর্জন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। ২০২০ সাল থেকে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তার গতিপথ হারিয়ে ফেলে। ফলে ২০২১ সালের মূল্যায়নে বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি না এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দেয়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সঠিক দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ যেমন করোনা মহামাররি ধাক্কা সামলে উঠেছে তেমনি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকাও সচল রাখতে পেরেছে। ফলে ২০২১ সালের ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিডিপি’র ২৩ অধিবেশনের ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকেরই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কেবল লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নয় মাথাপিছু জাতীয় আয় এবং মানবসম্পদ সূচকে আগেরবারে তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন বেশি ছিল। যদিও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকের মান ২০১৮ সালের চেয়ে ২০২১ অবস্থান কিছুটা কম ছিল। টানা দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে সকল সূচকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় সিডিপি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক) বরাবর সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রেরণ করে। এলডিসি উত্তরণ নীতিমালা অনুযায়ী ইকোসক ঐ বছরের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশ দুই বছর বর্ধিত সময়ের আহবান জানালে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ পাঁচ বছর প্রস্তুতিমূলক সময় দিয়ে এলডিসি উত্তরণসংক্রান্ত ইকোসকের প্রতিবেদন রেজুলেশনের মাধ্যমে অনুমোদন প্রদান করে। কোভিড-১৯ এর ধকল সামলে উঠতে বরাদ্দকৃত পাঁচ বছর প্রস্তুতিমূলক সময় যথেষ্ট কি না তা পর্যালোচনার জন্য অনুমোদিত রেজুলেশনে ২০২৪ সালের সিডিপি’র পরবর্তী ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে সিদ্ধান্তের আলোকে ৪-৮ মার্চ, ২০২৪ তারিখে সিডিপি’র ২৬তম অধিবেশনে নির্ধারিত তিনটি সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে আবারও মূল্যায়ন করা হয়। সে মূল্যায়নে তিনটি সূচকেই আগের দুবারের চেয়ে অধিকতর সাফল্য দেখিয়ে বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। সিডিপি’র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে কোভিড-১৯ এর প্রভাব বাংলাদেশ যথাযথভাবে মোকাবেলা করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। ত্রিবার্ষিক এই মূল্যায়নে ইতঃপূর্বে নির্ধারিত প্রস্তুতিমূলক সময়ের চেয়ে অধিক সময়ের প্রয়োজনীয়তা নেই মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০২৬ সালেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তনণ ঘটবে বাঙলাদেশের। ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বরই হচ্ছে আনুষ্ঠানিক উত্তরণের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
২০১৮, ২০২১ এবং ২০২৪ সালে সিডিপির ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্যমাত্রা ও বাংলাদেশের অর্জন নিচের সারণিতে বর্ণনা করা হলো:
সূচক
মূল্যায়নের সাল
২০১৮
২০২১
২০২৪
লক্ষ্যমাত্রা
অর্জন
লক্ষ্যমাত্রা
অর্জন
লক্ষ্যমাত্রা
অর্জন
মাথাপিছু জাতীয় আয়
১২৩০ ডলার
১২৭৪ ডলার
১২২২ ডলার
১৮২৭ ডলার
১৩০৬ ডলার
২৬৮৪ ডলার
মানবসম্পদ সূচক
>৬৬
৭৩.২
>৬৬
৭৫.৪
>৬৬
৭৭.৫
অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক
<৩২
২৫.২
<৩২
২৭.২
<৩২
২১.৯
১৯৭১ সালে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা প্রকাশের পর এখন পর্যন্ত মোট সাতটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করতে পেরেছে। এই সাতটি দেশ ও তাদের উত্তরণকাল হলো: বাতসোয়ানা (ডিসেম্বর, ১৯৯৪), কেপ ভার্দে (ডিসেম্বর,২০০৭), মালদ্বীপ (জানুয়ারি,২০১১), সামোয়া (জানুয়ারি, ২০১৪), ইকুয়েটরিয়াল গিনি (জুন,২০১৭), ভানুয়াতো (ডিসেম্বর, ২০২০) এবং ভূটান (ডিসেম্বর, ২০২৩)। বর্তমানে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রেেয়ছে বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশ। অন্য পাঁচটি দেশ হলো: অ্যাঙ্গোলা, লাওস, নেপাল, সাওতোমে এবং সলমান দ্বীপপুঞ্জ।
৪-৮ মার্চ অনুষ্ঠিত সিডিপি’র সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনকারী দেশগুলোকে চারটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে বৈশি^ক সংকট, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধিকরণ।
স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুল্ক মুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু এলডিসি থেকে চূড়ান্ত উত্তরণের পর এই সুবিধাগুলো আর থাকবে না। অবশ্য গেল বছরের ২৩-২৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ডব্লিউটিও’র বিশেষ সভায় এলডিসি থেকে চূড়ান্ত উত্তরণের পরও সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তবে কতদিন এই সুবিধা প্রদান করা হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি। অন্যদিকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্কমুক্ত সুবিধা বলবৎ থাকবে। অতি সম্প্রতি এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত ``Expanding and Diversifying Exports in Bangladesh: Challenges and the Way Forward©” শীর্ষক প্রতিবেদনে (এডিবি ব্রিফ-২৯৩, মার্চ, ২০২৪) এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে রপ্তানি পণ্যে শুল্ক আরোপ করা হলে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫.৫ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
এলডিসিভুক্ত হওয়ার কারণে ডব্লিউটিও’র ``Agreement on Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights (TRIPS)’’ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেধাস্বত্ব হিসেবে ঔষধ আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে কোন অর্থ প্রদান করতে হয় না। ট্রিপস চুক্তি অনুযায়ী ২০৩৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত এলডিসিভুক্ত দেশগুলো ঔষধ শিল্পের মেধাস্বত্বসংক্রান্ত এই ছাড় সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তবে কোন দেশ যদি এর আগে এলডিসি থেকে চুড়ান্তভাবে উত্তরণ হয়ে যায় তবে উত্তরণের দিন থেকে সে দেশ ঔষধ শিল্পের মেধাস্বত্বসংক্রান্ত ছাড় সুবিধা পাবে না। সে অনুযায়ী ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বরের পর থেকে বাংলাদেশকে ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে ঔষধ আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেধাস্বত অর্থ প্রদান করতে হবে। এতে করে দেশে ঔষধের দাম বৃদ্ধি পাবে। তবে আশার কথা জীবন রক্ষাকারী অনেক ঔষধের মেধাস্বত্বের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় অতি জরুরি এসব ঔষধের মূল্য বৃদ্ধির আশংকা থাকছে না।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশ যে অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে থাকে তা সীমিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে দেশের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বৃত্তি, ফেলোশিপ, প্রশিক্ষণে যে বিশেষ ছাড় পেয়ে থাকে এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সেসব সুযোগ কিছুটা সীমিত হয়ে আসবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত করে দিবে অপার সম্ভবনার দুয়ারও। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমুর্তির ইতিবাচক পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক পরিমÐলে দেশের অবস্থান পাকাপোক্ত হবে। মিলবে উন্নয়নের বৈশ্বিক স্বীকৃতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বির্নিমাণের যে প্রত্যায়ে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি), ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরের পথকে প্রশস্ত ও সহজতর করবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ বাড়বে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতার সূচকে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ টানা তিনটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে সাফল্যের সাথে এ সূচকে কেবল উত্তীর্ণ হয়নি বরং ক্রমাগত মানের উন্নতি করেছে। এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলক কম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে যা বিদেশি বিনিয়োগীকারীদের আকর্ষণ করার অন্যতম অনুষঙ্গ।
বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গাড়ি এবং মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারী বিশ্বের অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠান শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সবিধা আছে এরকম অনেক দেশে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে তাদের বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশে শ্রমমূল্য তুলনামূলক কম এবং দেশটি বর্তমানে জনসংখ্যার লভ্যাংশ (ফবসড়মৎধঢ়যরপ ফরারফবহফ) পর্যায়ে রয়েছে সুতরাং বর্তমানে ঐসব কোম্পানির বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে অন্যতম উপযুক্ত স্থান। এতে করে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে দেশে শিল্পায়নের সুযোগ বাড়বে এবং অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। শিল্পায়ন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের ফলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণ দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াবে ফলে আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থাগুলো থেকে বড় অংকের ঋণ পাওয়া যাবে। বেশি অর্থের যোগান উন্নয়নখাতে অধিক পরিমাণ ব্যয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দেবে। এতে করে অবকাঠামো খাত ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বেশি করে ব্যয় করা যাবে। ক্রেডিট ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং সম্ভবনাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ইতিবাচক ও কার্যকর অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মত এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী প্রভার নিরুপণ এবং তা মোকাবেলায় পদ্ধতি বের করার জন্য একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করে। এই সমীক্ষার আলোকে ২০২০ সালে ``Impact Assessment and Coping up strategies of Graduation from LDC Status for Bangladesh” একটি ধারণাপত্র প্রকাশিত হয়। এতে উত্তরণের ফলে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং সৃষ্ট সম্ভবনাকে কাজে লাগানোর বিভিন্ন কৌশল, পদ্ধতি এবং নীতি বাস্তবায়নের সময়সীমা বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়গুলোর নিরিখে বর্তমানে চলমান অষ্টম প বার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) প্রণয়ন করা হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ ও শিল্পায়ন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অ ল কর্তৃপক্ষ ৯৭টি অ ল প্রতিষ্ঠার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। ৬৮টি অ ল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সরকারিভাবে আর বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ২৯টি অর্থনৈতিক অ ল। এসব অর্থনৈতিক অ লে সহজে যাতায়াত এবং বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয অবকাঠামোগত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পদ্মাসেতু দক্ষিণের ১৯ জেলার সাথে দেশের অন্যান্য অ লের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে বাণিজ্য সম্প্রসারণকে সহজতর করেছে। এক সময় গাড়ি দিয়ে বড় বড় নদী অতিক্রমের একমাত্র মাধ্যম ছিল ফেরি। বিগত ১৫ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক, কার্যকর ও পরিকল্পিত দিক নির্দেশনা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলনে দেশের সকল বড় বড় নদীর উপর নির্মিত হয়েছে সেতু। হাতেগোনা কয়েকটি স্থান ছাড়া এখন ফেরির ব্যবহার চোখে পড়ে না। প্রসস্থকরণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে বিভিন্ন জাতীয়, আ লিক ও স্থানীয সড়ক। আধুনিকায়ন করা হয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে। নতুন করে চালু করা হয়েছে পায়রাবন্দর। অতাধুনিক সকল সুবিধা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। কক্সবাজার অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরকে রূপান্তরিত করা হচ্ছে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। মহেশখালীতে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক হাব। ঢাকায় বুক চিড়ে চলছে মেট্টরেল। যানজটবিহিন এ্ক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে নিমিষেই নগরবাসী ছুটে চলছে তিলোত্তমা ঢাকার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও নির্মাণ করা হয়েছে এলিভেডেড সড়ক। ক্রমশ নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র যা দেশে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও শিল্পায়নের যে অপার সম্ভবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে সরকারের নেওয়া এই সকল উদ্যোগ সে সম্ভবনার সঠিক প্রতিফলনের অন্যতম নিয়ামক।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ মানবসম্পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ জনশক্তি গড়ার লক্ষ্যে দেশের সকল উপজেলায় কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এর ফলে কায়িক শ্রম নির্ভর জনশক্তির পরিবর্তে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন জনসম্পদ গড়ে উঠবে। যারা সারা দেশে নির্মিতব্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অ লসহ যেকোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবল হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে উদ্ভুত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও সৃষ্ট সম্ভবনার সঠিক বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। তাই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর দক্ষ জনবল তৈরিতে সরকার নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় আইসিটি পার্ক ও হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পিত এসব পদক্ষেপের কারণে তরুণদের মাঝে আউটসোসিংয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর আউটসের্সিংয়ের মাধ্যামে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে যা খুবই আশাজনক। এছাড়া, প্রবাসী কণ্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিটি উপজেলায় নির্মাণ করা হচ্ছে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি)। এসব কেন্দ্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষতা অর্জন করে তরুণরা বিদেশ যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে প্রবাসী আয়।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং উন্মুক্ত হওয়া সকল সম্ভবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের নেওয়া নানা পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও কার্যক্রম অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সঠিক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। গৃহীত প্রদক্ষেপ ও কর্মসূচিগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করা গেলে ২০৪১ সালের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে রূপকল্প ঘোষণা করেছেন তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অর্জন করা সম্ভবপর।
তথ্যসূত্র:
1| CDP Triennial reports on 2018, 2021, 2024;
2| Report of the Economic and Social Councilto theUN General Assembly, Seventy-sixth session, 2021
3| “Setting the scene: 50 years of the LDC category’’ report, 2021;
4| Brief on ÔÔExpanding and Diversifying Exports in Bangladesh: Challenges and the Way Forward,”
(ADB Brief no-293, March, 2024);
5| ÔÔImpact Assessment and Coping up strategies of Graduation from LDC Status for Bangladesh, 2020”;
6| UN, WTO, CDP Websites
লেখক : উপসচিব, শরণার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়, কক্সবাজার।