॥ মুহাম্মদ মুসা খান ॥
চলে গেলেন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যতিক্রমী জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ 'ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী'। কিংবদন্তি এই মানুষটি গত ১১ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন (ইন্না…..রাজেউন)। ৮১ বছর বয়সী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতা ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। গত ৫ এপ্রিল তাঁকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। 'ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী' শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস । মহান মুক্তিযুদ্ধ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়ন, জাতীয় ঔষধ নীতি এবং বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি আন্দোলন ও কর্মকান্ডের সাথে যিনি দ্বিধাহীন চিত্তে জড়িয়ে যেতেন- তিনি ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জীবনের শেষদিকেও অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি হুইলচেয়ারে বসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন। গত ২৬ মার্চ'২৩ তারিখেও বঙ্গভবনে 'মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস' উদযাপন উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে হুইল চেয়ারে বসে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের' প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের একটি ছবিতে দেখা যায়- 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা' -ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন।
জন্ম, শিক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ : ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম গ্রহণ করেন । তাঁর বাবা হুমায়ন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। মা–বাবার ১০ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। তিনি বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে । ছাত্র ইউনিয়নের মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি । সে সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে সবার নজর কেড়েছিলেন । ১৯৬৪ সালে ডিএমসি থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য 'ভারতে ফেরার' গল্পটি সিনেমার কাহিনীকে হার মানায়। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনে যে কয়েকজন বাঙালি জনসন্মূখে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন- তাঁদের একজন ডা. চৌধুরী। তারপর বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলিতে' ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন- ‘চেনা হয়ে উঠেছে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এমএ মোবিন। এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিলো, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করলো, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসলো'। সেদিন তরুন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নানা রকম বিপদের ভেতর দিয়ে লন্ডন হতে এসে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষে 'সেক্টর টু' রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন । মুক্তিযুদ্ধে হতাহত যোদ্ধা ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসাসেবার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে আগরতলায় গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল।
মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান : ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী অকুতোভয় একজন মানুষ। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন মানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যতটুকু কাজ করা সম্ভব-তার সর্বোচ্চটাই করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রেসিডেন্ট এরশাদের প্রস্তাবও তিনি উপেক্ষা করেছিলেন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশের চিকিৎসার জগতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অসামান্য অবদান হলো 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা। 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠার পটভূমি বর্ননায় ডা.চৌধুরী বলেন, সচিবালয়ে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘মুজিব ভাই, বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল' করতে দেওয়া হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'বাংলাদেশ নাম থাকলে কেমন সরকারি সরকারি মনে হয়। অন্য কোনো সুন্দর নাম ঠিক করো হাসপাতালের জন্যে'। অনেক তর্কের পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই তিনটি নাম ঠিক করবি। আমি তিনটি নাম ঠিক করব। দুজন বসে যে নামটি ভালো সেই নামে হাসপাতাল হবে।’ তিনটি নাম ঠিক করে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ‘বল, কি নাম ঠিক করেছিস? বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন। ’ডা. জাফরুল্লাহ বলতে শুরু করলেন, ‘এক. বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল, দুই. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র…।’ তৃতীয় নামটি বলার সুযোগ না দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ খুব সুন্দর নাম। এই নামেই হবে হাসপাতাল। এই হাসপাতালে শুধু চিকিৎসা হবে না। দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা সবকিছু নিয়ে কাজ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে।’' হাঁ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এখনও সেই নীতি ধরেই চলছে।। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মাত্র এক হাজার ২০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করতে পারেন দরিদ্র মানুষ। তার প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামী প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া।
জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন : ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আরেক উল্লেখযোগ্য অবদান হলো 'জাতীয় ওষুধনীতি' প্রনয়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। স্বাধীনতার পর দেশের ওষুধের বাজারে বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তখন বাজারে চার হাজার ধরনের ওষুধ ছিল, তার প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ওষুধের দাম ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসনামলের ১৯৮২ সালের 'জাতীয় ওষুধনীতি' পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। জাতীয় ওষুধনীতি দেশি কোম্পানিগুলোকে ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করে দেয়, পাশাপাশি দেশে তৈরি হওয়া ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা বন্ধ হয়। দেশের মানুষকে স্বল্পমূল্যে ওষুধ দেওয়ার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওষুধ কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর উদ্যোগের সুফল ভোগ করছে বাংলাদেশের জনগণ। দূ:খজনক বিষয় হলো, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তাঁর সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ। বিনা বিচারে তাঁর ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটিয়েছিল! আমাদের দেশের জন্য এই চিত্র ছিল লজ্জাজনক।
রাজনীতি সচেতনতা : ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ ছিলেন। যা তিনি বিশ্বাস করতেন তা প্রকাশ করতেন নির্ভয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা খুবই কম দেখা যায়। এজন্য বিভিন্ন সময় তিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের দ্বারা অপমানিত হয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রাখতেন। 'মুজিব ভাই' বলে সম্বোধন করতেন। বঙ্গবন্ধুও তাঁকে পছন্দ করতেন বলেই তিনি 'গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রতিও তাঁর অসম্মান ছিল না । বাকশালে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে 'বিএনপিতে স্বাধীনতাবিরোধী থাকায়' সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পদ্মা সেতু নির্মাণের ভূয়সী প্রশংসা করতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিকে পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন। জাতি এতে গৌরবান্বিত। এই সেতুর নাম অনেকেই শেখ হাসিনা সেতু করতে বলেছিলেন, উনি করেননি। পদ্মা সেতু নাম রেখেছেন।'’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বড় বড় কাজ করেই ফেলেছেন। এখন মানুষের দিকে নজর দিতে হবে। সবাই মিলে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি আমি।’ তিনি আবার কোন কোন সময় প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করতেও পিছপা হোননি। ১২ নভেম্বর'২২ তারিখে মওলানা ভাষানী অনুসারীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি ক্রমান্বয়ে ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন। সেই ভুল পথ থেকে বেরিয়ে আসেন। বিরোধী দলগুলোর সাথে বসুন, তাহলেই মুক্তি হবে।' তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক জিয়ার কঠোর সমালোচক ছিলেন । তিনি বলেছিলেন, 'দেশে থাকা সিনিয়র নেতাদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে দুই বছরের জন্য তারেক রহমানের সরে যাওয়া উচিত দল থেকে। নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি’র নতুন নেতা তৈরি হলে দলটি গতিশীল হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলের স্থায়ী কমিটির অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না দলটি।' গত ১৭ মে'২২ তারিখে 'জাতির সংকট নিরসনে জাতীয় সরকার’ শিরোনামে একটি লিখিত প্রস্তাব বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রস্তাবে ৯ মাসের মধ্যে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন এবং এর পরের ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট কারচুপির আশঙ্কা বেশি। যে কারণে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে- বিদ্যুৎ সংযোগ, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ, বড় কয়েকটি প্রকল্প শেষ করাসহ পাঁচটি সফলতার প্রশংসা করা হয় প্রস্তাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকের তহবিল লুট, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সেক্টরে দূর্নীতি, নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার উন্নতির পরও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প অব্যাহত রাখা ইত্যাদিকে দুর্ভাগ্যজনক বলেও মন্তব্য করা হয়।
২৮ মে '২২ তারিখে বরেণ্য সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনে 'বিএনপি না যাওয়াতে' তিনি বলেছিলেন- 'এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এতে দলটির ( বিএনপি)চিন্তার মধ্যে দীনতা প্রকাশ পেয়েছে।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য আন্দোলনে সম্পৃক্ততা ও সম্মাননা : বৈশ্বিকভাবে 'বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন' গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভূমিকা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি আয়োজন করে। এর বিকল্প হিসেবে কয়েক বছর পর পর আয়োজন করা হয় পাবলিক হেলথ অ্যাসেম্বলি বা জনগণের স্বাস্থ্য সম্মেলন। এটা আয়োজন করে পিপলস হেলথ মুভমেন্ট নামের একটি বৈশ্বিক সংগঠন। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশের 'পাবলিক হেলথ সার্ভিসের' এই আইকন ১৯৭৭ সালে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক 'স্বাধীনতা পদক' পান প্রথম বছরে। বিকল্প নোবেল খ্যাত র্যামন ম্যাগসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে সুুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ, সুইডেনের লাইভলি হুড পুরস্কার ( ১৯৯২) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ’ পুরস্কার লাভ করেন।
মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে একটির নাম 'রিসার্চ: আ মেথড অব কলোনাইজেশন'। এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। এরপর এটি বাংলা ছাড়াও ফরাসি, জার্মান, ইতালি, ডাচ, স্পেনিশ ও একাধিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
সর্বশেষ ১৮ মার্চ'২৩ তারিখে 'মুক্তিযুদ্ধ, চিকিৎসা ও সমাজসেবায় জীবনব্যাপী অবদানের জন্য' তাঁকে 'সমকাল-চ্যানেল টোয়েন্টিফোর গুণীজন সম্মাননা–২০২৩' প্রদান করা হয়।
নির্লোভ জীবন ও কিছু বিব্রতকর ঘটনা : ডা.চৌধুরী ছাত্রজীবনে জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করতেন। চড়তেন দামি গাড়িতে। তাঁর ছিল পাইলটের লাইসেন্স। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ মহান চিকিৎসক শেষ জীবনে অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। দেশে-বিদেশে কোথাও তাঁর একটি ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। বোনকে দান করে দিয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা। অথচ তাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ তোলা হয়েছে ভূমি দখলের। দেশের মানুষকে কম পয়সায় চিকিৎসা দিতে তিলতিল করে যে হাসপাতালটি তিনি গড়ে তুলেছেন-সেটির ওপর দুর্বৃত্তদের হাত পড়ছিল । ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর চাঁদাবাজি, জমিদখল, পুকুরের মাছ চুরির অভিযোগসহ একের পর এক মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়েছিল। অথচ সাধারণ মানুষকে কমদামে চিকিৎসা এবং ওষুধ সরবরাহ করতে হাসপাতাল ও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দামি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের বদলে ট্যাবলেট তিনি প্যাকেট করার প্রচলন করেন সাধারণ কাগজে। দেশের জন্য প্রানবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরা এই অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি ভিন্নমতের কারণে এমন আচরণ কোন যুক্তিতেই সঠিক ছিল বলে মনে হয় না। তাঁর ভুল হলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ক্ষমা করা যেতো। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। তিনি এখন সব বিতর্কের উর্ধ্বে। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি ও তাঁর সমাজচিন্তা আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা বিবেচনা করে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা- এখন সময়ের দাবি। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালকে তাঁর নামে করার জন্য (ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী জেনারেল হাসপাতাল) প্রস্তাব করছি। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি,এই মহান জনদরদী ও দেশপ্রেমিক মানুষটাকে যেনো জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।