॥ সুপ্রতিম বড়ুয়া ॥
কোন শিশু হত্যাকারী মানেই সে নরপশু, নর ঘাতক ও নরপাষন্ড।নরপাষন্ডরা শেখ রাসেলের বাঁচার অধিকারকে অভয় দিয়েও রক্ষা করেনি। বেঁচে থাকার সে কি অশেষ ইচ্ছে। বাড়ির প্রায় সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাকে মারা হবে না এই অভয় দিয়ে নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। সে সময়ই রাসেল বাঁচার জন্য কাকুতি মিনতি করেছিল। কিন্তু খুনিরা তার পরিচয় নিশ্চিত জেনেই ওপরে নিয়ে হত্যা করে। একারণেই রাসেল ও আগস্টে নিহত শিশুদের হত্যার বিষয়টি সমগ্র বাঙালীর কাছে আবেগের শোকাহত উপলদ্ধি। ঘাতকদের কাছে মানবিক গুন, মানবতা ও জাতিসংঘের শিশু সনদ এবং জাতীয় শিশু নীতিমালা অতি তুচ্ছ। এরা মানুষ নামে নরপশু, নর ঘাতক ও নরপাষন্ড। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালো রাতে শিশু রাসেলকে সেদিন যারা হত্যা করেছিল তারা কিন্তু ব্যাপারটি হঠাৎ করে ঘটায়নি। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সুচিন্তিত ভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বশেষ রক্তের ধারা শেষ চিহ্নটি নিধন করার জন্যই ঘাতকেরা এই নির্মম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছিল। শিশু রাসেলকে ঘাতকেরা হত্যা করেছিল এই ভেবে যে, বাংলাদেশ যেন কোন অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো জীবিত প্রাণীকে প্রতীক হিসেবে না পায়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন, আর রক্ষা পেয়েছিলেন বলেই আজ মানব সভ্যতার জঘন্যতম বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের হত্যাকান্ডের সব তথ্য এক এক করে বেরিয়ে আসার সুযোগ হয়েছে। আজ সেই খুনিদের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। অনেকের বিচারও হয়েছে সময়ের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। অমোঘ নিয়মে উদ্ঘাটিত হচ্ছে পঁচাত্তরের সেই ষড়যন্ত্রের জাল-আর ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে রক্ত মাখা সময়ের ঘটনাবলী। আমরা চাই মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত ঘাতকদের যারা বাকী আছে তাদের গ্রেফতার করে ফাঁসির রায় কার্যকর করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্নাঙ্গ রায় বাস্তবায়ন হোক। এর বাইরে আমাদের আরও একটি চাওয়া আছে, পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট হত্যাকান্ডের প্রধান নেপথ্যেবর নায়ক, প্রধান ষড়যন্ত্রকারী, প্রধান ক্রীড়নক, প্রধান হত্যাকারী, প্রধান বেনিফিসিয়ারী, খুনি চক্রের প্রধান পরামর্শ দাতা, খুনী চক্রের প্রধান আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা ও খুনিচক্র ও আন্তর্জাতিক ভাবে যে সমস্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলো, যারা পরিকল্পিতভাবে দেশ স্বাধীনের পর আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে, দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিল, যারা আইন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে ও পরে সংসদ বিল পাশ করে বঙ্গবন্ধুর আত্ম স্বীকৃত খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করেছিল, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ, বিলম্বিত, প্রলম্বিত করেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের শুনানীতে যে সমস্ত বিচারপতি বিব্রত বোধ করেছিল একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে তাদের চিহ্নিত করে মুখোশ উম্মোচন করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক। শেখ রাসেল বিশ্বের অধিকারহারা, নির্যাতিত, নিপীড়িত শিশুদের প্রতীক ও প্রতিনিধি। যখনই অবোধ শিশু-বলি দেখি, তখনই রাসেলের কচি মুখখানা ভেসে ওঠে। মানুষরূপী রক্তখেকো হায়েনাদের হাত কাঁপেনি ১৫ই আগস্টে নিরাপরাধ শিশু রাসেলকে হত্যা করতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার নিকৃষ্টতম শিশু হত্যার অমানবিক হৃদয় বিদারক দৃশ্যপট শেখ রাসেলের নারকীয় হত্যাকান্ড ও মৃত্যুর আগ মুহূর্তে নিষ্পাপ রাসেলের আর্তি- ‘আমাকে মারবে না তো ভাইয়া’ বুকের মাঝে শোকের নদী বইয়ে দেয়। পৈশাচিক খুনিদের নিকট শেখ রাসেলের বেঁচে থাকার আকুতি কতই না মানবিক আবেগের। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে যখন এ নারকীয় তান্ডব চলছিল, তখন ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিনের একটি শিশু থরথর করে ভয়ে কাঁপছিল। তাঁর নাম শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য। ঘাতকেরা ভয়ংকর আক্রোশে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে বঙ্গবন্ধুর বিশাল মাপের বুকটা ঝাঁঝরা করে দেয়। এ বীভৎস চিত্র দেখে ছোট্ট শিশু রাসেল বুক চাপড়িয়ে আহাজারিরত মায়ের ক্রন্দনে হতবিহবল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে খুনিরা তার সামনেই তার প্রিয় মাকে হত্যা করে। নিজের চোখের সামনে বাবা-মায়ের স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা মুখ ছোট শিশুটির মনে কি ধরনের রেখাপাত করেছিল তা ভাববার বিষয়। বাপ-মা হারা শিশুটিকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন পুলিশ অফিসার অনেক অনুনয় করেছিল। বিনিময়ে তারও ভাগ্যে জুটেছিল ব্রাশ ফায়ার। মাকে হারিয়ে মায়ের ক্ষতবিক্ষত শরীরের ওপর লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছিল রাসেল। ঘাতক শকুনের দল তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মা’র কাছ থেকে আলাদা করলে রাসেলের মুখে করুণ আকুতি ঝড়ে পড়ল, ‘আমাকে মেরো না, আমি কোনো অন্যায় করি নি। আমাকে হাসুপা’র কাছে পাঠিয়ে দাও।’ কিন্তু ঘাতকের কর্ণকুহরে জাতির পিতার এ মাসুম শিশুটির আবেদন পৌঁছালো না। কারণ তারাতো মানুষ ছিল না- ছিল পিশাচ। এরপর রাসেল এক দৌড়ে বড় ভাবি সুলতানা কামালের কাছে আশ্রয় নেয়। সুলতানার পাশে ছিলেন ছোট ভাবি রোজী। তাঁরা দু’জনই মাসুম শিশুটির বুকে আগলে রেখে তাকে রক্ষার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালান। কিন্তু ঘাতকেরা কাউকেই ছাড়বে না। এক এক করে সবাইকে সরিয়ে দেবে এ পৃথিবী থেকে। তার পরক্ষণেই তারা বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রবধূকে একত্রে হত্যা করে। একের পর এক মৃত্যুর মিছিল আর বিভীষিকায় হতবিহ্বল রাসেল এবার ঠাঁই খুঁজে বেড়ায় বাড়ির কাজের লোকজনের কাছে। বাড়ির লোকজনকে জড়িয়ে কান্নারত রাসেলকে টেনে অন্যত্র নিয়ে যায় মেজর আজিজ পাশা। ঘাতকেরা অবুঝ শিশু রাসেলকে এত বেশি ভয় পাচ্ছিল, যদি না শিশুটি কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যায় তাহলে তো তাদের সাত-পুরুষের ভিটেয় ঘুঘু চড়বে। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠে বাংলাদেশের ভাবীকালের শিশু নিধনে। তারা এ কচি প্রাণটার ওপর একটা, দুইটা নয়, বেশ কয়টা গুলি চালায়। মুহূর্তে ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিনের নিষ্পাপ শিশু রাসেল নিরব নিথর হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কি দোষ ছিল এ মাসুম শিশুটির? কি দোষ ছিল বাংলার বুকে তার জন্মদাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের? একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা, একটি আলাদা জাতিস্বত্ত্বা, একটি জাতীয় সংগীত ও সর্বোপরি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার পুরস্কার কি এই বুলেট? আমাদের বড় প্রয়োজন এসব নিয়ে গবেষণার, আজকের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে যতই বিচার-বিশ্লেষণ করবে তাতে করে বাঙালি জানবে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ।