লোকবল শূন্য সেন্টমার্টিনের ২০ শয্যার হাসপাতাল

লোকবল শূন্য সেন্টমার্টিনের ২০ শয্যার হাসপাতাল
সেন্টমার্টিন দ্বীপের ১১ হাজার মানুষের চিকিৎসায় ২০ শয্যার একমাত্র সরকারি হাসপাতালে নেই কোন চিকিৎসক। জনবল না থাকায় চিকিৎসা পাচ্ছে না দ্বীপের মানুষ। বাইরে গিয়েও চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই দ্বীপের মানুষের। এ অবস্থায় হাতুড়ে ডাক্তার আর ফার্মেসিই যেন তাঁদের শেষ ভরসা।

জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, সেন্ট মার্টিনের ২০ শয্যার হাসপাতালটিতে অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে ২ জন চিকিৎসক, সিনিয়র স্টাফ নার্স ১ জন, সহকারী নার্স ৩ জন, ফার্মাসিস্ট ১জন, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান ১ জন, অফিস সহকারী ১ জন, ওয়ার্ড বয় ১ জন, আয়া ১ জন, এম এল এস এস ১ জন, ঝাডুদার ১ জন, নিরাপত্তা প্রহরী ১ জন ও স্টোরকিপার ১সহ মোট ১৫ জনের পদই এখন শূন্য। এই পদগুলোর মধ্যে শেষ পর্যন্ত ছিলেন চিকিৎসক ডাঃ নওশেদ আলম কানন। তিনিও হাসপাতাল ছেড়েছেন। বর্তমান তিনি টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স'র রোগী দেখছেন বলে জানা যায়।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য হাবিব উল্লাহ খান বলেন, 'সেন্টমার্টিনের মানুষ এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছে। একটি সরকারি হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক নেই। দ্বীপের মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না।
তিনি গত সোমবার তাঁর ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের গুচ্ছ গ্রামের নুর জাহানের ছেলে মোহাম্মদ বেলাল। বয়স ৫ বছর।  
২০ শয্যার হাসপাতালে কবে থেকেই চিকিৎসক নেই। কর্তৃপক্ষ কি জানে না?  

ডেইল পাড়া গ্রামের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ বলেন, 'নামেই হাসপাতাল। কেউ নেই। ফামের্সীর ওপর নির্ভরশীল এখানের মানুষ। আল্লাহ আল্লাহ করে সময় কাটানো।'
পূর্ব পাড়া গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ আবুল কালাম বলেন, 'কিছুদিন ধরে শরীর অসুস্থ। হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কাউকে পাইনি। ফার্মেসী থেকে ঔষধ নিয়ে খাচ্ছি। কিন্তু জ্বর কমলেও কয়েকদিন পর আবার উঠে।'
পর্যটন ব্যবসায়ী মাহবুব উদ্দিন বলেন, 'ব্যবসা বানিজ্য, চিকিৎসা, মাছ ধরা সব বন্ধ। দ্বীপের মানুষের চিন্তা কারোই নেই। আমরা কি এ দেশের মানুষ নই? আবহাওয়া একটু খারাপ হলে টেকনাফ যাওয়া যায় না। জরুরি কাজে যেতে হলেই কোস্ট গার্ডদের সাথে কথা বলে রিজার্ভ বোট ভাড়া করে টেকনাফ যেতে হয়। এই দ্বীপের মানুষ সীমাহীন কষ্টে আছে। এভাবে চলতে থাকলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে।'
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুর রহমান বলেন, 'দ্বীপবাসীর দাবি প্রয়োজনীয় প্যাথলজি পরীক্ষা, অন্তর্বিভাগ সেবাসহ ২০ শয্যার একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় বর্ষা মৌসুমে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে ৩৪ কিলোমিটার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে টেকনাফ যাওয়া সম্ভব হয়না। গর্ভবতী নারীদের জরুরি চিকিৎসা খুবই প্রয়োজন।'
ফয়েজুর রহমান বলেন, 'এই দ্বীপে প্রায় ১১ হাজার মানুষের বসবাস। দেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। জনগুরুত্বপূর্ণ এই দূর্গম ইউনিয়নের বর্তমান চিকিৎসা সেবা নেই বললে চলে। বিশেষ করে প্রসূতি মা ও শিশুর জরুরি চিকিৎসার জন্য সাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফ যাওয়া সম্ভব হয়না। এজন্য সেন্টমার্টিনে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।'
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১ ফেব্রুয়ারী থেকে সেন্টমাটিনে পর্যটক যাওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ চাইলেও দ্বীপ থেকে বের হতে পারে না। কোনো রোগী বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে কোস্ট গার্ডদের অনুমতি নিয়ে বোট ভাড়া করে টেকনাফ যেতে হয়। কিন্তু সেন্টমার্টিনে আয়-রোজগার না থাকায় অর্থ সংকটে পড়েছে দ্বীপের মানুষ। পর্যটন বান্ধব এই দ্বীপের মানুষের আয়ের উৎস পর্যটন ব্যবসা। কিন্তু গত চার মাস থেকে খালি পড়ে আছে ২৪০ টির মত হোটেল ও কটেজ। যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছিল আড়াই হাজার মানুষের। এখন কারোরই চাকরি নেই।
সিভিল সার্জন অফিস জানিয়েছেন, ২০০২ সালে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে সেন্টর্মাটিন ( ২০) শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল। প্রশাসনিক ভবন ও চিকিৎসকের আবাসিক ডরমিটরি নির্মাণ শেষে ২০০৮ সালে হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।  ২৪ বছরে পা দিলেও হাসপাতালটিতে অন্তর্বিভাগে সেবা চালু হয়নি।
এদিকে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে চিঠি দেন টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স'র চিকিৎসক ডাঃ প্রণয় রুদ্র।
জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক প্রণয় রুদ্র দৈনিক কক্সবাজারকে বলেন, 'সেন্টমার্টিন ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের জন্য কোনো বাজেট নেই। এনজিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চলমান ছিল। কিন্তু, ২০২৪ সালের অক্টোবরে হেলথ এন্ড জেন্ডার সাপোর্ট প্রজেক্ট (IGSP) এর মেয়াদ শেষ হওয়াতে এনজিও কর্তৃক নিয়োগকৃত জনবলের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।'
সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদুল হক দৈনিক কক্সবাজারকে বলেন, 'সেন্টমার্টিনের ২০ শয্যার হাসপাতালের জন্য সরকারি কোন পদ নেই, বরাদ্দও নেই। ২০১৪ সালে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। যোগদানের কিছুদিন পর তিনি কাউকে কিছু না বলেই চলে যান। এরপর আর শূন্য পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।'
তিনি বলেন, ' স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য সরকারি পদ আছে। কিন্তু তারা-ও এখন নেই। বিষয়টি নিয়ে উর্ধতন মহলে কথা হয়েছে। আশা করি আগামী মাসে কোন একটা ব্যবস্থা হবে।'
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো সালাহউদ্দিন দৈনিক কক্সবাজারকে বলেন, 'সরকারি একটা প্রজেক্ট ছিল। ও-ই প্রজেক্টে চিকিৎসক, নার্স এবং স্টাফদের বরাদ্দ ছিল। সেটার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। গেলো বছরের অক্টোবরে বিষয়টি মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারি নজরে নিয়েছে। একটি প্রজেক্ট অনুমোদন হয়েছে।'
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.