মিয়ানমারের রাখাইনে এবার আরাকান আর্মির নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। তাদের দাবী, জান্তা বাহিনীর চেয়ে এখন বেশী নির্যাতন চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। যার কারণে দিনে গড়ে প্রায় অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন করে এক লাখ পঞ্চাশ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। এ নিয়ে দৈনিক কক্সবাজার গতকালের সংখ্যায় প্রথম পৃষ্টায় লিড নিউজ করেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীপুরুষের মুখে জানা যায় বিভিন্ন অজুহাতে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর তল্লাশী করছে। মালামাল লুটপাট করছে। যুবতী মহিলাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যুবকদের আরাকান আর্মিতে যোগদানের কথা বলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ী থেকে বের হতে,খেতে গিয়ে কাজ করতে,বাজারে যেতে আরাকান আর্মিকে টাকা দিতে হয়। নির্যাতনের পর টাকা দিলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে তারা।
স্মরণ করা যেতে পারে ৬০ এর দশকে বার্মিজ সেনাবাহিনী সামরিক শাসন জারী করে ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতায় দীর্ঘ দিন থাকার জন্য আরাকান রাজ্যে পরিকল্পিতভাবে ’ডিভাইড এন্ড রূল’ নীতি গ্রহন করে। রোহিঙ্গারা বার্মার নাগরিক নয়,তারা কোন এক সময় বাংলা থেকে সেখানে গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস শুরু করে। রোহিঙ্গারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী রাখাইনদের শত্রæ। যুগ যুগ ধরে একই প্রচারণার ফলে রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের সত্যিই শত্রæ মনে করতে শুরু করে এবং সুযোগ পেলেই নির্যাতন করতে থাকে। জান্তা বাহিনীকে ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯২ সালে লাখে লাখে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিতে রাখাইনরা প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিল। তখন বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার জান্তাবাহিনী স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়। আবার ২০১২ থেকে শুরু করে ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর সাথে উগ্র রাখাইনরা অস্ত্র হাতে নিয়ে বাড়ীঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হত্যা,ধর্ষণ,নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের আবার বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। সেই রাখাইনরা মূলত আরাকান আর্মি তৈরী করে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যুদ্ধ করে সরকারী সেনাদের পরাজিত করে রাখাইন রাজ্যের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৪টি শহর, প্রায় ৮০% এলাকা দখল করে নিয়েছে। আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা এবং জান্তাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা এখনও রাখাইনে বসবাস করছে বলে জানা যায়।
সম্প্রতি ব্যাংঙ্ককে বিমসটেকের ষষ্ঠ সম্মেলনের ফাঁকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ থান শিউ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমানকে জানান যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য চিহিৃত করেছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ। আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে চুড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ছবি ও নাম মিলিয়ে দেখার কাজ চলমান। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ছয়টি ধাপে বাংলাদেশের পক্ষে আট লাখ রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্ত বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। প্রত্যাবাসনে দীর্ঘ নীরবতার কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে বাকী রোহিঙ্গাদের তালিকা হস্তান্তর করে নাই। যখন জান্তা সরকারের হাতে আরাকান রাজ্যের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও সুযোগ ছিল তখন প্রায় আট বছরের মধ্যে বিভিন্ন তালবাহানায় প্রতারণামূলক আচরণের মাধ্যমে নিয়ানমার সরকার একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করে নাই। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অপ্রত্যাশিত ঘোষণার পর কক্সবাজারে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা প্রশ্ন করছেন তাদেরকে কোথায় প্রত্যাবাসন করা হবে? বর্তমানে আরাকান রাজ্যে জান্তা সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও দখল নাই। জান্তার সৈনিকরা আরাকান আর্মির সাথে যুদ্ধে নিহত
হয়েছে,আত্মপমর্পণ করেছে বা পালিয়ে গেছে বা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রচুর গোলা বোমা নিক্ষেপ করে গণহত্যা চালানোর পরও জান্তা বাহিনী আরাকানে হারানো কোন এলাকা পুনদখল করতে পারে নাই। আরাকানে জান্তা বাহিনী যেখানে নিজেরাই আরাকান আর্মি কর্তৃক বিতাড়িত, নৌ-বাহিনী,বিমান বাহিনী ব্যবহার করেও হারানো অঞ্চল পুনরায় দখল করতে ব্যর্থ হচ্ছে সেখানে রোহিঙ্গাদের কিভাবে,কোথায় তারা প্রত্যাবাসন করবে সেই যৌক্তিক প্রশ্ন থেকে যায়। এখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জান্তা বাহিনী থাকায় তারা সহজেই ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক ঘোষণা করতে পারে। নিয়ত ভাল হলে, সদিচ্ছা থাকলে তা করে নাই কেন? বর্তমান বাংলাদেশ অর্ন্তবর্তী সরকারের কুটনৈতিক চাপে বাধ্য হয়ে ও ভুমিকম্পে লন্ডভন্ড হওয়ার কারণে বর্হিবিশ্বের সহানুভুতি পাওয়ার অপকৌশল হিসেবে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রতারণামূলক ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শরণার্থী প্রত্যাবাসন অবশ্যই নিরাপদে,স্বেচ্ছায়,সসম্মানে ও টেকসই হতে হবে। ব্যাংঙ্ককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যে আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ইউএনডিপির সতর্কবার্তার মধ্যে রাখাইন থেকে আরো বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করার জন্য জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাখাইনে একটি মানবিক চ্যানেল স্থাপনের আহŸান জানিয়েছেন। বর্তমানে একটি মানবিক করিডর দিতে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে মর্মে প্রচারিত সংবাদকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রতিক্রিয় সৃষ্টি হয়েছে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নাগরিক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে। বর্তমানে সরকারের পক্ষে কোন করিডল দেওয়া না হলেও গোপনে কিছু দিনের মধ্যেই এক লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। স্বীকৃত ’মানবিক করিডর’ পেলে বাকী রোহিঙ্গাদেরও আরাকান রাজ্য থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এলাকা দখল নিয়ে যুদ্ধ চললেও রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিতে আরাকান আর্মি ও জান্তাবাহিনীর মধ্যে কোন বিরোধ আগেও ছিল না,এখনও নাই।
দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের মত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারাও মানবিক করিডর চান না। তারা আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে বসবাস করার জন্য জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি নিরাপদ অঞ্চল চান। জান্তাবাহিনী ও আরাকান আর্মি মুদ্রার এপিট-ওপিট,রোহিঙ্গাদের অতীত অভিজ্ঞতায় তারা তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করা হলে রোহিঙ্গারা সরকারীভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষা না করে তারা যেভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, সেভাবেই স্বেচ্ছায় নিজ দায়িত্বে স্বদেশ মিয়ানমারে চলে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন ।