সবার প্রিয় শিক্ষক নুরুল আজিজ চৌধুরীর চির বিদায়

সবার প্রিয় শিক্ষক নুরুল আজিজ চৌধুরীর চির বিদায়
শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫ সন্ধ্যা ৭টায় মগরিবের নামাজের পর কক্সবাজার সদরের পিএমখালী ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়ার দীঘির পাড়ে পারিবারিক কবরস্থানে মা কুলসুম বাহার চৌধুরানী ও নানা নুর মোহাম্মদ চৌধুরীর পাশে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক,গবেষক ও লেখক নুরুল আজিজ চৌধুরীকে দাফন করা হয়েছে। আগের দিন বৃহস্পতিবার ২৪ এপ্রিল রাত ১১টার সময় রাজধানী ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শুক্রবার আসরের নামাজের পর স্থানীয় বদরমোকাম মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা ও মগরিবের নামাজের পর পিএমখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী হাসনা হেনা,পুত্র আখলাকুর রহমান গালিব, কন্যা সারওয়াত বিনতে আজিজ স্বর্ণা, নাতি ও আত্মীয় স্বজনসহ অসংখ্য ছাত্রছাত্রী গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি ১৯৫১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর(ভাদ্র মাস) পিএমখালীর চৌধুরী পাড়াস্থ মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী এখলাছুর রহমান উকিল (এডভোকেট) যিনি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি ও কক্সবাজার মহকুমা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন। তাঁর স্থায়ী আবাস কক্সবাজার পৌরসভার কস্তুরাঘাট বদরমোকাম এলাকায়। মরহুম নুরুল আজিজ চৌধুরীর পৈত্রিকবাড়ী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মধ্যম হালি শহর । তিনি কক্সবাজার পি,টি,আই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর কক্সবাজার মডেল হাইস্কুল(বর্তমানে কক্সবাজার সরকারী বালক বিদ্যালয়) থেকে ১৯৬৮ সালে এস,এস,সি, ১৯৭১ সালে কক্সবাজার কলেজ (বর্তমানে কক্সবাজার সরকারী কলেজ) থেকে এইচ,এস,সি ও ১৯৭৪-৭৫ সালে স্থাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত¡ বিষয়ে এম,এ পাশ করেন। তাকে পিতার মত আইনজীবী বানানোর জন্য মা কুলসুম বাহার চৌধুরানীর ইচ্ছা থাকলেও তিনি শিক্ষকতাকে জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহন করে ১৯৮৬ সালে কক্সবাজার সাহিত্যিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সন্তানদের পড়ালেখার সুবিধার জন্য তিনি কক্সবাজার কে,জি এন্ড মডেল হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে অতি সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারীতে ছাত্রছাত্রী,সহকর্মী শিক্ষক ও স্কুলের অন্যান্য কর্মকতা-কর্মচারীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অবসর গ্রহন করেন। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর লেখা-লেখির হাতে খড়ি। নানা বিষয়ে তিনি গবেষনাধর্মী ও ইতিহাস নির্ভর প্রবন্ধ লিখে লেখক পরিচিতি পেয়েছেন। তিনি কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর স্থায়ী পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর লেখা কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই ’সাগর পাড়ের কতকথা’ লেখকের সমকালীন জীবন ও সমাজ-সংস্কৃতির এবং পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশির দশকে কক্সবাজার কেমন ছিল তার প্রামাণ্য চিত্র পেয়ে পাঠক মহলে এই বই খুবই সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে।  নুরুল আজিজ চৌধুরী আমার মা’র ফুফাতো ভাই। তাকে আমি ছোটবেলা থেকে আজিজমামু বলে ডাকতাম। বয়সে আমার ২ বছর বড় হলে আজিজমামু আমার খুব প্রিয় ও বিশ্বস্থ বন্ধুদের একজন ছিলেন। আমি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে সকল সিদ্ধান্তগুলো উনার সাথে পরামর্শ করেই চুড়ান্ত করতাম। গত ঈদের দিন আমি তাঁর সাথে ফেবুতে ছবি পোস্ট করে লিখেছিলাম তিনি আমার একমাত্র জীবিত মুরব্বী। মৃত্যুর আগের দিন সকালে তিনি মোবাইলে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন,ভাগিনা আমি তোমার আজিজমামু। আমি ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। দুই দিনের মধ্যেই কক্সবাজার ফিরে আসবো ইনশাল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবে। দুই দিন পরে আজিজমামু ঠিকই কক্সবাজার ফিরে আসলেন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত লাশবাহি এম্বুল্যান্সে করে। তবে আর কোন কথা বললেন না। 
আজিজমামুর সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে। তাঁর বিয়েতে আমার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। তাই তিনি আমাকে তাঁর অভিভাবক হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমার নানার বাড়ী ও তাঁর নানার বাড়ী পিএমখালীর চৌধুরীপাড়ার নুর মোহাম্মদ চৌধুরীর বাড়ী। ১৯৭১ সালের ফেব্রæয়ারী মাসের ২৮ তারিখ চট্টগ্রাম সরকারী কর্মাস কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পরীক্ষার ফরম পূরণ করে পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে হোস্টেলে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে র্নিবিঘেœ পড়ালেখা করে ভাল প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য হামিদ ভাই (শহীদ আবদুল হামিদ)এর নির্দেশে কক্সবাজার বাড়ীতে চলে আসি। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিপাগল নিরস্ত্র বাঙ্গালী ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে আমার পিতা আমাকে উখিয়ার গোরাইয়ারদ্বিপ আমার মা’র মামা কালু সিকদারের বাড়ীতে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসেন । পরে পিএমখালী নানার বাড়ীতে চলে আসলে সেখানে মা কুলসুম বাহার চৌধুরানীসহ আজিজমামুকে দেখতে পেয়ে খুব খুশী হই। যেন নিস্প্রাণ পলাতক জীবনে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। দুইজন মিলে আমরা মামা-ভাগিনা আক্তারমামুর বাড়ীতে গোপনে রেডিওতে বিবিসির মার্কটালীর সংবাদভাষ্য ও ভারতের দেবদুলালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কথিকা শুনতাম। তখন মামাত ভাই আব্বাস উদ্দিন চৌধুরী ও দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরীও কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র হিসেবে তারাও আত্মগোপনে ছিল। একদিন সন্ধ্যার পর উর্দুভাষী অবাঙ্গালী পুলিশ ও পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ধরতে চৌধুরীপাড়া ঘেড়াও করে তল্লাশী চালায়। আমরা গভীর পানির নর্দমায় /কবরস্থানে আত্মগোপন করে রক্ষা পাই। পরের দিন সকালে আমি আজিজমামুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঈদগাও গিয়ে লিয়াকত নুরের বাড়ীতে,ভুলু মিয়ার বাড়ীতে আশ্রয় নিই। বিগত পাঁচ দশক ধরে পিএমখালীতে কোন আত্মীয়স্বজন মারা গেলে আমি ও আজিজমামু একসাথে জানাজা পড়তে যেতাম। আমরা একসাথে কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সকল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতাম। অবশ্য দলীয়করণ হওয়ার পর প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে তেমন না গেলেও কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতাম। কোন বই নিয়ে প্রকাশনা উৎসব হলে সেখানে দুইজন একসাথে যেতাম। নুরুল আজিজ চৌধুরী একজন পাঠক,সৎ, র্নিলোভ, নিরহংকারী, দায়িত্বশীল, সহজ, সরল,ভদ্রলোক ও ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি যতদিন চলাফেরা করতে পারতেন ততদিন বই মেলা থেকে বা লাইব্রেরী থেকে নতুন কোন বই পেলে নিজের টাকা দিয়ে ক্রয় করে আমাকে লিখে উপহার দিয়ে পড়তে বলতেন,যেন ৭০+ বয়সেও আমি তাঁর ছাত্র। আমার ছেলে মেয়েদেরও তিনি প্রচুর বই উপহার দিয়েছেন। তিনি সারা জীবন বন্ধু বান্ধব,আত্মীয়স্বজনের বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানে বই উপহার দিতেন।                                             
                     উনার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কক্সবাজারের আর একজন প্রবাদতূল্য সৎ মানুষ,ভাল মানুষ আমার ও আজিজমামুর প্রিয় মানুষ কক্সবাজার প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য আনোয়ারুল আজিম জোসেফ (৭৯) বদ্দা ইন্তেকাল করেছেন। সিসিডিবির পরিচালক হিসেবে স্বাধীনতার পর তিনি ইঞ্জিন,নৌকা,মাছ ধরার জাল অতি সততার সাথে বিনামূল্যে বিতরণ করে কক্সবাজারে সামুদ্রিক মৎস্য শিকারে জড়িত পরিবারগুলোকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে সহায়তা করেছেন। তার সততার জন্য তাঁকে এখনও উপকারভোগী সাগর পাড়ের মৎস্যজীবী পরিবারের মানুষরা অতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তাঁর সততা আজিজমামু ও আমাকেও কর্মজীবনে সৎ থাকতে অনুপ্রাণিত,উৎসাহিত করেছে তা স্বীকার করতেই হবে। কক্সবাজার প্রেসক্লাবের পক্ষেও তার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যের মৃত্যুতে শোক ও  সম্মান জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
 ৩ মে কক্সবাজার সাহিত্য একডেমীর পক্ষে গবেষক,লেখক ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নুরুল আজিজ চৌধুরীর সম্মানে কক্সবাজার সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে এক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয়। আল্লাহ কক্সবাজারের দুইজন অত্যন্ত জনপ্রিয়,অনুকরণীয় বুদ্ধিজীবী, সৎ, সহজ,সরল,ভালো মানুষ মরহুম আনোয়ারুল আজিম জোসেফ ও নুরুল আজিজ চৌধুরীকে বেহেস্তে নসীব করুন। আমিন।

লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কক্সবাজার


পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম

© 2025 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.