# এসব বই যাচ্ছে স্কুলের লাইব্রেরীতে
ইস্টিশন; একটি ব্যতিক্রম বুক স্টলের নাম। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের লাবণী সৈকত পয়েন্টের খুব কাছে অবস্থিত এটি। যেখানে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে নানা ভাঁজে সাজানো আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ নানা ধরনের বই। আছে বিখ্যাত ও বরেণ্য সব কবি সাহিত্যিকের কবিতা, গল্প, উপন্যাসও। বইয়ের পাশাপাশি নান্দনিক কারুকাজে টি-শার্ট, শোপিচসহ নানা ধরনের দেশীয় পণ্য সামগ্রীও।
খুব স্বাভাবিকভাবে পর্যটন স্পট ঘিরে ব্যবসার কথা বিবেচনা করে নানা প্রসাধনী, খাবার সহ ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও ইস্টিশন গতানুগতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে একটি প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী উন্নয়ন কর্মী অনুরণন সিফাত। যাকে সকলেই ডাকেন ইস্টিশন মাস্টার হিসেবে।
ইস্টিশন মাস্টার অনুরণন সিফাত একটি সংস্থায় চাকুরির সুবাদে কক্সবাজারে এসেছিলেন ৫ বছর আগেই। তখনই গড়ে তুলেন এ প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিফাত ছাত্রজীবনেই সৃজনশীল বিকাশ র্চচার মানুষ। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগৎকে ঘিরে বেড়ে উঠা। একদিকে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত সাহিত্যের লেখালেখির সাথেও। কর্মজীবনে এসেই ব্যবসায়িক কোন উদ্দেশ্যে নয়, সৃজনশীলতার বিকাশ, সৃষ্টিশীল মানুষের আনাগোনা বাড়ানো এবং মনের খোরাক মেটাতে ইস্টিশনের মতো প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছিলেন।
গত ২৯ জুন ইস্টিশন মাস্টার সিফাত বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। মোটেল লাবণীর গেইটের পশ্চিমে ছোট্ট পরিসরের সাদামাটা সাইজ বোর্ড দিয়ে যেমন ইস্টিশন প্রতিষ্ঠানটি, তেমনি সাদামাটা পরিবেশেই ছিল তাঁর বিয়ে। ইস্টিশনে বসেই সম্পন্ন হয়েছে বিয়ের কাবিন নামা সম্পাদন সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানও। এক লাখ টাকার বই দেন মোহর নির্ধারণ করে সম্পন্ন হওয়া এই বিয়ের যুগল ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ে গেছেন ইস্টিশন থেকে নিকটবর্তী মোটেল শৈবালে। যেখানে খুব স্বল্প পরিসরে বন্ধু-বান্ধব, নিকট স্বজনদের উপস্থিতিতে আয়োজন হয় প্রীতিভোজের। ওখানে বন্ধু মহলের গানের অনুষ্ঠান আর সন্ধ্যায় ইস্টিশনে ছিল মুক্ত আড্ডা। ওখানে শেষ হয়েছে বিয়ের সকল কার্যক্রম।
যখন বিয়ের দেন মোহরের অর্থের পরিমাণ অংকের বিশালতার প্রতিযোগিতা। সেখানে এক লাখ টাকা বই দেন মোহর নিয়ে শেষ হয়েছে বিয়েটি। আর এই এক লাখ টাকার বই দুইজন মিলেই দিয়ে দেবেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ইতিমধ্যে বই বিতরণও শুরু করেছেন দুইজন।
ইস্টিশন মাস্টার সিফাত যার সাথে যুগল জীবনে বন্দি হয়েছে তিনি একজন গণমাধ্যমকর্মী। জড়িত রয়েছেন সাহিত্যের সাথেও। ইতিমধ্যে তার একটি ছোট্ট গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁন নাম মোজাহিদুল ইসলাম রাকিব। তিনি পড়াশোনা করেছেন প্রকৌশলে করেন সাংবাদিকতা। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে তিনি আজকের পত্রিকা নামের দৈনিকে কর্মরত।
বিয়ের বিষয়ে কথা হয়েছে এই যুগলের সাথে। তাদের প্রশ্ন করা হয়েছি ৪ টি। পৃথকভাবে প্রশ্ন সমুহ করা হয় দুই জনকে। উত্তর এসেছে কাছা-কাছি।
প্রশ্ন : এক লাখ টাকা বই দেন মোহর নির্ধারণ করে বিয়ের কারণ কি?
মোজাহিদুল ইসলাম রাকিব : বই আমাদের দুজনেরই আবেগের জায়গা। আমি লেখালেখি করি, সিফাত লেখালেখি করে। সিফাত কক্সবাজারে ইস্টিশন নামে বুকশপ ও লাইব্রেরি চালায়। ফলে বই নিয়ে আমাদের আলাদা একটা আবেগের জায়গা আছে। আমরা দুজনই চাই, শিশু–কিশোর ও তরুণেরা বই পড়ুক। দেনমোহর হিসেবে বই নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটাও অন্যতম কারণ। আবার দেনমোহর তো একজন নারীর সামাজিক মর্যাদা বা সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে দেওয়া হয়। এ জায়গা থেকে বিবেচনা করলে সিফাতকে আমার সুরক্ষা দেওয়ার কিছু নাই। কারণ সিফাত আত্মনির্ভরশীল, কর্মঠ এবং একই সঙ্গে ইতিবাচক মানুষ। কারও কাছ থেকে সিফাতের আর্থিক নিরাপত্তা সিফাতের নিতে হবে, এটা আমার মনে হয়নি। সেই জায়গা থেকে সিফাতেরও দেনমোহর নেওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। পরে যখন আইনি বিষয় আসল তখন লাইব্রেরি করার প্রস্তাব আসে সিফাতের কাছ থেকেই। প্রথমে সিফাতের ভাবনা ছিল তিনটি বা চারটি স্কুলে লাইব্রেরি করার। পরে আমি সেটা বাড়িয়ে ১০টি স্কুলে লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা করি। এ কারণেই এক লাখ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা।
অনুরণন সিফাত : আসলে বিয়েটা কোন দেনমোহর ছাড়াই করবো ভেবেছিলাম। প্রথাগতভাবে একটা আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে তো দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। সেজন্য টাকাকড়ি বা সোনাদানা বা বিনিময়যোগ্য কোন সম্পদই সাধারণত দেনমোহর এর জন্য বিবেচ্য হয়। যেখানে দুটো মানুষ একটা বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে সেখানে আসলে একপক্ষ টাকাপয়সা বা অন্যকিছুর বিনিময়ে সেটাতে যুক্ত হবে এটা আমার ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ নয়। বন্ধনটা তো আসলে হৃদয়ের। বোঝাপড়াটা নিজেদের মধ্যে। সেখানে কোন ধরবাধা নিয়ম থাকা উচিত নয়। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমার মনে হয়েছে নিজের এই আর্থিক নিরাপত্তাটুকু আমার নিজেরই নিশ্চিত করা উচিত।কিন্তু যখন আমরা আসলে প্রচলিত নিয়মে বিয়ের দলিল তৈরি করতে গেলাম তখন দেনমোহর একটা কিছু ধরতেই হবে এমন একটা বিষয় আসলো, তখন আমার মনে হলো ঠিক আছে কোন সোনাদানা, টাকা পয়সা আমি নিজের জন্য নিতে চাই না বরং এই টাকা দিয়ে কিছু স্কুলে লাইব্রেরি হোক। তাতে কিছু শিশুকিশোরদের ভবিষ্যতটা অন্তত নিশ্চিত করা যাবে, ওদের চিন্তাজগতে তো একটা পরিবর্তন আসবে! ইস্টিশন এ বছরের জানুয়ারি থেকে সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রান্তিক স্কুলগুলোতে লাইব্রেরি গঠনে সহযোগিতা করার কার্যক্রম শুরু করেছে। খাগড়াছড়ির একটা স্কুল থেকে এটি শুরু করেছে ইস্টিশন। আমার মনে হয়েছে, তাহলে এই কার্যক্রম এর কলেবরটাই বরং বৃদ্ধি পাক। আমি প্রাথমিকভাবে ৪/৫ টা স্কুলে লাইব্রেরি করার জন্য ৫০,০০০ টাকার বই দেয়ার প্রস্তাব করি। আসলে দেনমোহর এর নাম দিয়ে অনেকসময় একটা চাপ ও তৈরি করা হয় ক্ষেত্রবিশেষে, আমি সেটাও হোক তা চাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার প্রস্তাব শোনার পর আমার সঙ্গীবন্ধুটি বললেন বাচ্চারা বই পড়বে এমন একটা ভালো কাজে আমি বরং আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে চাই। এক লাখ টাকার বই আমরা ১০ টা স্কুলে দিতে চাই। তাহলে ১০ টা স্কুলের বাচ্চারা সৃজনশীল বই পড়ার সুযোগ পাবে। আর আমাদের মতো করে আরও দম্পতি যদি এই কাজটিতে উৎসাহী হয়, তাহলে আরও কিছু বাচ্চাদের শৈশব আনন্দময় হবে।
প্রশ্ন : বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় সাদামাটা পরিবেশ হওয়ার চিন্তা কেন আসল?
অনুরণন সিফাত : আমরা আসলে বিয়েটাকে আনুষ্ঠানিকভাবে করার পক্ষপাতি ছিলাম না। এটা তো আসলে একটা সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ মাত্র। কিংবা সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে দুটো মানুষ একসাথে থাকবে সেটার একটা সামাজিক স্বীকৃতি। আমরা চেয়েছি আমাদের কাছের মানুষ গুলো যাদের ভালোবাসায় আমরা জড়িয়ে আছি তারা আমাদের পাশে থাকুক। তাই যতোটা সম্ভব ছোট পরিসরে আয়োজনটা করা। আরও ছোট করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলোর ইচ্ছাকেও গুরুত্ব দিতে হয়েছে। তাই ছোট পরিসরে সাদামাটা করে বিয়েটা করা। আর ইদানীংকার এত আড়ম্বর এর ভিড়ে দুটো মানুষ ভালোবেসে একাত্ম হচ্ছে সেই জিনিসটাই হারিয়ে যায়। আত্মার যোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা এই সুন্দর সময়টুকু হারাতে চাইনি। স্নিগ্ধতা থাকুক, সোঁদা মাটির গন্ধ থাকুক, মানুষের ভালোবাসা থাকুক এটুকুই চাওয়া ছিল। আমরা বরং বিশ্বাস করতে চেয়েছি -‘তোমার হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় তোমার হোক’। আর যদি বলা হয়, ইস্টিশনে কেন? ইস্টিশন তো শুধু বুকশপ নয় কিংবা আমার একার একটা স্বপ্নের জায়গা এমন তো নয়। আমার স্বপ্নের সাথে পথ হেঁটেছে অনেকগুলো মানুষ। হ্যাঁ, আমি ভিত্তিটা করেছি, জায়গাটা করে দিয়েছি। কিন্তু অনেকগুলো মানুষের আবেগ, প্রচেষ্টা, ভালোবাসা আর অনেক লড়াই আর পরিবর্তনের স্বাক্ষী এটা। তাই বিয়ের জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা তো আর হয় না। মেয়েদের বিয়ে তো বাড়ি থেকে হয়। আমার বিয়েবাড়ি আমি ইস্টিশনকেই বেছে নিয়েছি। একদিনের জন্য হোক বা একশো দিনের জন্য হোক, এটাই আমাদের একান্ত নিজেদের ঠিকানা। আর ইস্টিশন মাস্টারের বিয়ে তো ইস্টিশন থেকেই তো হওয়া উচিত।
মোজাহিদুল ইসলাম রাকিব : বিয়ে একটি সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি, আমি বিষয়টাকে এভাবেই দেখি। সেই জায়গা থেকেই কিছু কাছের মানুষকে ডেকে এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল। এ জন্যই সাদামাটা আয়োজন।
প্রশ্ন : দুজনের ভবিষ্যৎ চিন্তা বলুন।
মোজাহিদুল ইসলাম রাকিব : ভবিষ্যতের যাত্রা মানেই অনিশ্চিত যাত্রা। আর জীবনের যাত্রা তো শূন্যে গিয়ে শেষ হয়। আমার কাছে মনে হয়, এই শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার আগে মানুষ এই যাত্রাটাকে একটু অর্থবহ করতে চায়। আর এই যাপিত জীবনকে অর্থবহ করতেই কেউ টাকার পেছনে ছোটে; কেউ পাহাড়, কেউ সমুদ্র জয় করে। কেউ বিজ্ঞানের আবিষ্কারের নেশায় ছোটে। আমি ইতিবাচক কিছু কাজ করে যেতে চাই। সেটা লেখালিখি হতে পারে। এর বাইরেও যদি কোনো ইতিবাচক কাজ করতে ভালো লাগে, সেটা করব। এই টুকুই।
অনুরণন সিফাত : এটা একটু কঠিন প্রশ্ন। খুব ভেবেচিন্তে কিছু করবো এমনটা ভাবিনি। ব্যক্তিগতভাবে বললে আমি সবসময় সুন্দরের সাথে থাকতে চেয়েছি, শুদ্ধতার চর্চা করতে চেয়েছি। সাথের মানুষটিও তাই। আমরা যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি ইতিবাচক কাজ করে যেতে চাই দুজনে। পরিবর্তন তো আসলে খুব মোটা দাগে আসে এমন নয়। একদিনেও বিপ্লব হয় না। আমাদের ছোট্ট ছোট্ট ইতিবাচক কাজ পরিবর্তনের পথকে প্রলম্বিত করুক। আমরা দুজনেই টুকটাক লেখালেখির সাথে জড়িত আছি। বই পড়তে ভালোবাসি, বই পড়–ক সেটা চাই। ইস্টিশনও প্রকাশনা জগতে পা দিয়েছে এ বছরের শুরু থেকে। সে জগতটাকে আমরা আরও ঋদ্ধ করতে চাই। ও হ্যাঁ, কেউ যদি এরকম স্কুলে লাইব্রেরি করে দিতে আগ্রহী হয়, সেটা দেনমোহর বা অন্য কোনভাবে, ইস্টিশন সানন্দে সেটাতে সহযোগিতা করবে। পরিবর্তনের পথে লড়াইয়ের সঙ্গী পাওয়াটা মুশকিল। আমার মনে হয় আমি পেয়েছি । তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে আর ভাবি না, যা হবে দেখা যাবে। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা একসাথে লড়তে চাই। সুন্দরে আর ভালোবাসায় একটা যৌথ খামার হোক, চাষাবাদ হোক স্বপ্নদের - সমান পৃথিবীর স্বপ্ন। আমাদের শুভকামনায় রাখবেন যেন এই অবিশ্বাসের যুগে বিশ্বাসটুকু বেঁচে থাকে।
প্রশ্ন : বই বিতরণের প্ল্যান?
উত্তর (উভয়ের) : বিয়ের দিন মানে ২৯ তারিখেই আমরা দুটো স্কুলে বই তুলে দিতে চেয়েছি। দূরত্বের কারণে সেটা হয়ে উঠতে পারে নি। সব বই ইস্টিশনে এসে পৌঁছেছে। স্কুল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা প্রান্তিক এবং সুবিধা বঞ্চিত স্কুলগুলোর কথা ভেবেছি। লামা এবং আলিকদমের ৩ টি পাহাড়ি স্কুল, রঙ্গপুরের একটি স্কুল, রাজশাহীর একটি স্কুলকে নির্বাচন করে হয়েছে। তাদের কাছে বই পাঠিয়ে দেয়া হবে। তাছাড়াও ঢাকাড় একটি পথশিশুদের স্কুল এবং আরও কিছু স্কুল সিলেকশন এর কাজ এখনো চলমান। প্রতিটি স্কুল পাচ্ছে ১০০ টিরও বেশি বই আর বই রাখার জন্য একটি তাক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আমরা কিছু মাধ্যমিক স্কুলেও বই দেয়ার পরিকল্পনা করেছি। সে লিস্টটাও বিবেচনায় আছে।